গাজীপুরের যুদ্ধ-৩, চাঁদপুর
[অংশগ্রহণকারীর বিবরণ]
সম্ভবতঃ ১৮-১০-৭১ তারিখ। আমি গাজীপুর ব্রিজের (তৎকালীন কাঠেরপুর) চিনে কলিমউল্লাহ ভূঁইয়ার নৌকায়। সময় দুপুর ১২টা। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। হঠাৎ খবর আসল পাকবাহিনী লঞ্চ দিয়ে চান্দ্রাবাজার ও গাজীপুর হয়ে ফরিদগঞ্জে যাবে। এই লঞ্চে খাদ্য, ঔষধ ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস আছে। ইতিমধ্যে আমরা ফরিদগঞ্জ নিত্য প্রয়োজনীয় খাবার সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছি। পাকবাহিনীকে আমাদের ২নং প্লাটুনের ১নং সেকশান কমান্ডার নায়েক মোহাম্মদ আলী টি, কে (রাজারগাও) তার সেকশানের অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদেরসহ লোহাগড় ও চান্দ্রাবাজারে নদীর বাঁকে আক্রমণ করে। টিকে ওস্তাদ ও তার লোকজন জীবনপণ চেষ্টা করেও লঞ্চটির গতিরোধ করতে পারেননি। সাধারণ বুলেটে লঞ্চটির কোন ক্ষতি না করতে পেরে বুঝতে পারলেন এটি একটি স্টিলবডির লঞ্চ। ওস্তাদ পুনরায় চান্দ্রাবাজার থেকে তার লোকদের নিয়ে দৌড়ে এসে গাজীপুরের রাজাপুরের বাঁকে (সেখানে বর্তমানে হজু কোম্পানি ইটের ভাটা) পুনরায় আমাদের সাথে সমন্বয় রেখে এম্বুশ করেন। আমরা হাবিলদার মতিনের (নোয়াখালি) কমান্ডে ১৫ জন গাজীপুর রাস্তার ওপর ব্যাঙ্কার করে পজিশন নেই। আমরা পূর্বেই মরহুম শহীদ মেম্বারের বাড়ি (অবঃ ইপিআর সদস্য) থেকে শুরু করে গাজীপুর চরবসন্ত পর্যন্ত ব্যাপক এরিয়া নিয়ে পজিশন নেই। গাজীপুরের ঈদগাহ মোড়ে আছেন কলিমউল্লাহ ভূঁইয়া, নায়েক সিদ্দিক করিম (মহামায়া), সিপাহী রহমত (বারিথূবা), সিপাহী শাহআলম (রাজাপুর), সিপাহী করিম (ভাওয়াল), সুবেদার আব্দুল হক (মতলব), গফুর ওস্তাদ (আলীপুর), বোরহান চৌধুরী, হাফিজুর রহমান মিন্টু, তরিক উল্লা পাঠান, নয়ন আরো অনেকে। শহীদ মেম্বারের বাড়ির এখানে আচে হাবিলদার মতিন, হাবিলদার গোলাম মওলা (বর্তমান অনারারী ক্যাপ্টেন ৪২ বেঙ্গল ঢাকা, পাছই), সিফাই ওয়ালি উল্লা পাটওয়ারী, হেদায়ে উল্লাহ (উত্তর বালিয়া), নায়েক বাসার, সফিকুর রহমান পাঠান, ফিরোজ, নজির আহম্মদ, আলাউদ্দিন, আমি (লেখক) এবং আরো অনেকে। নায়েক মোহাম্মদ আলীর সেকশানে আছে ল্যান্স নায়েক নুরুল ইসলাম, হাবিলদার খালেক, সিপাহী দেলোয়ার, সিপাহী আহসান, হাবিলদার আব্দুল মান্নান, মতি ভাই, শাহ্ আতিকুর রহমানসহ আরো অনেকে। আমরা সবাই নিজ নিজ পজিশনে আছি। লঞ্চটি আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। লঞ্চটি মাথায় একটি পাকিস্তানী পতাকা উড়ছে। লঞ্চটি যতই এগিয়ে আসছে আমাদের প্রাণের স্পন্দন ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। পূর্বেই কথা ছিল প্রথম বারে ফায়ার করব আমরা, যারা বরাবর হাবিলদার মতিনের সাথে আছি। দ্বিতীয় বারে ফায়ার ওপেন করা হবে নায়েক মোহাম্মদ আলী টিকে ওস্তাদের সেকশান থেকে। গাজীপুরের সোজা গেলে সুবেদার আব্দুল হক ও কলিমউল্লাহ ভূঁইয়ার লোকজন আক্রমণ করবে। লঞ্চটি এগিয়ে আসছে আমরা প্রস্তুত। তবে আমাদের ভয় সবচেয়ে বেশী, কারণ যদি লঞ্চটি সোজা এসে আমাদের পাড়ে ভিড়ে? তা হলে আমরা নির্ঘাত পাকবাহিনী হাতে মারা যাব। এই অবস্থায় অনেক সময় ব্যায়নেট ফাইট করতে হয়। কিন্তু আমাদের অনেকেরই ব্যায়নেট নৌকায়। বিভিন্ন ধরনের অদ্ভুত চিন্তা করছি। গানবোট প্রায় কাছে এসে গেছে, এখনই পাকবাহিনী ডানে গাজীপুরের দিকে মোড় নিবে। হঠাৎ হাবিলদার ওস্তাদ অর্ডার করলেন, ফায়ার। অমনি আমাদেরও সবগুলি হাতিয়ার গর্জে উঠল। আমাদের প্রচণ্ড আক্রমণে পাকবাহিনীর গানবোটের বালির বস্তা ছিড়ে সব ধোঁয়ায় আছন্ন হয়ে গেল। এদিকে ডান দিকে থেকে অনবরত গুলি করে যাচ্ছে টিকে ওস্তাদের সেকশানে। ৫ মিনিট বালির ধোঁয়ার জন্য লঞ্চটিকে আমরা স্পষ্ট কিছুই দেখতে পারলাম না। এবার পাকবাহিনীও পাল্টা আক্রমণ করল কিন্তু তাদের গুলি যাচ্ছে অনেক উপর দিয়ে। আমাদের গুলিতে লঞ্চটির বডি থেকে আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে কিন্তু ছিদ্র হচ্ছে না। লঞ্চটি ডানে মোড় নিয়ে আমাদের গুলির তোড়ে প্রায় ৪/৫ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকে। যখন গুলিতে লঞ্চের কিছুই হচ্ছে না এবার মতিন ওস্তাদ সবাইকে চিৎকার দিয়ে বলতে লাগলেন ফায়ার বন্ধ করে এটা গানবোট, এটা গানবোট। সেদিন থেকে আমরা দুষ্টামি করে মতিন ওস্তাদকে গানবোট ওস্তাদ বলে ডাকতাম। লঞ্চের চালককে বলতে হবে একজন দক্ষ চালক। তিনি এত বিপদের মাঝেও লঞ্চটি সঠিক নিয়ন্ত্রণ রেখে ধীরে ধীরে সামনে নিয়ে গেলেন। যেই লঞ্চটি গাজীপুরের মোড়ে এল শুরু হল সামনে এবং পিছন থেকে কেচকা মাইর। এত গুলির পরও লঞ্চটির আমরা কিছুই করতে পারলাম না। তবে কলিমউল্লাহ ভূঁইয়ার সেকশান থেকে কয়েকটি ২ ইঞ্চি মর্টারের গোলা নিক্ষেপ করা হয় কিন্তু টার্গেট মত পৌঁছনি। শেষ পর্যন্ত আমাদের অবাক করে পাকবাহিনী লঞ্চটি নিয়ে ফরিদগঞ্জ পৌঁছে। লঞ্চটি সেদিন রাত্রেই গাজীপুর হয়ে চাঁদপুর পৌঁছে। আমরা গাজীপুরে প্রস্তুত কিন্তু আক্রমণ করিনি। রাতে আমাদের সাথে ডিফেন্সে পাঠান সাহেব ছিলেন। তিনি অর্ডার করলেন সবাই প্রস্তুত থাক, তারা কোন প্রকার অসুবিধা না করলে আক্রমণ করা হবে না। কারণ আমাদের কাছে রকেট লাঞ্চার নেই। রকেট লাঞ্চার ছাড়া স্টিল বডির লঞ্চ পানিতে নিমজ্জিত করানো মুশকিলের বিষয়।
[৫০] ডা. মোঃ দেলোয়ার হোসেন খান