You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.12 | গিরি চৌধুরী বাজার অভিযান, পটিয়া, চট্টগ্রাম - সংগ্রামের নোটবুক

গিরি চৌধুরী বাজার অভিযান, পটিয়া, চট্টগ্রাম

ডিসেম্বর প্রথমদিকে মিত্রবাহিনীর অগ্রাভিযান শুরুর পর অন্যান্য অঞ্চলের মতো চট্টগ্রামেও পাকবাহিনী পিছু হটতে থাকে। কক্সবাজার, টেকনাফ, বান্দরবনসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের পাকবাহিনী চট্টগ্রামে শহরে চলে আসার পরিকল্পনা করে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধাগণ পিছু হটে আসা পাকবাহিনীকে আক্রমণ করে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করার সিদ্ধান্ত নেন। পাকবাহিনীর ওপর অ্যাম্বুশ করার জন্য পটিয়া থানা থেকে দুই কিলোমিটার দক্ষিণে, পটিয়া বিসিক শিল্পনগরীর দক্ষিণ-পূর্ব পাশে এবং চট্টগ্রাম কক্সবাজার সড়কের ওপর এই বাজার অবস্থিত। চট্টগ্রাম-কক্সতবাজার সড়কের ওপর এই বাজারে একটি ব্রিজ ছিল। এই ব্রিজ ভেঙে পাকসেনাদের গতিরোধ করে ক্ষয়ক্ষতি করার কৌশল অবলম্বন করা হয়। গিরিচৌধুরী বাজারের ১০০ গজ পূর্ব্দিকে ছিল চট্টগ্রাম-দোহাজারি রেললাইন। কক্সবাজার, টেকনাফ, বান্দরবনসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামে অবস্থানরত পাক সৈন্যরা যেন চট্টগ্রাম শহরের দিকে আসতে না পারে সেজন্য তাদের যাতায়াতের পথে প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিরোধ সৃষ্টি করাই ছিল এই অপারেশনের উদ্দেশ্য। মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান ইসলামাবাদীর নেতৃত্বে প্রিন্সিপাল নূর মোহাম্মদ, মহসিন খান, হাবিবুর রহমান ও শামসুদ্দিন এই অপারেশনের পরিকল্পনা করে এভাবেঃ গিরিচৌধুরী বাজার অবস্থিত ব্রিজটি আগেই ভেঙে ফেলা হবে। এতে পাকবাহিনী কনভয় বাধার সম্মুখীন হবে। পরবর্তী থেমে যাওয়া পাকসৈন্যদের ওপর পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে অ্যাম্বুশ করা হবে। এজন্য পুরো দলকে মোট দুটি উপদলে বিভক্ত করা হয়। প্রথম দলঃ মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদীনের নেতৃত্বে এই দলে ছিলেন-অজিত, আবুল হোসেন, শফিউল আলম প্রমুখ। তাঁদের কাছে অস্ত্র ছিল একটি এলএমজি, একটি এসএমজি, তিনটি রাইফেল ও দুটি গ্রেনেড। এই দলের কাজ ছিল ব্রিজের পশ্চিমপাশে তৈরি করা বাঙ্কারে অবস্থান নিয়ে শত্রুর ওপর গুলিবর্ষণ করা। অপারেশন শেষে দ্রুত পশ্চিমদিকে গ্রামের মধ্যে নিজেদের প্রত্যাহার করবে। দ্বিতীয় দলঃ মুক্তিযোদ্ধা মঞ্জুরের নেতৃত্বে এই দলে ছিলেন-স্বপন, সোলেয়মানসহ ৭ জন। তাঁদের অস্ত্র ছিল একটি স্টেনগান, একটি জি-৩ রাইফেল, একটি এসএলআর ও ৪টি গ্রেনেড। এই দলের কাজ ছিল ১ম দলের ১০০ গজ দক্ষিণে রাস্তার পশ্চিমপাশে একটি পুকুরপাড়ে পজিশন নিয়ে শত্রুর ওপর গুলিবর্ষণ করবে। শত্রু ব্রিজের সন্নিকটে এসে পড়লেই কেবল গুলি করা হবে। পরবর্তীতে ১ম দলের প্রত্যাহারের সময় কভারিং ফায়ার দিবে। এরপর গ্রামের মধ্যে দিয়ে প্রত্যাবর্তন করবে।
১২ ডিসেম্বর সকাল আনুমানিক ৬টার দিকে ৫ জনের ১ নম্বর দল এবং ৭ জনের ২ নম্বর দলকে পটিয়া বিএডিসির একটি পিকআপে করে যথাক্রমে বাঙ্কারের কাছে ও পুকুরপাড়ে নামিয়ে দিয়ে আসে। সকালবেলা গেরিলারা নাস্তা করেনি বিধায় স্থানীয় একজন সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা (জলিল) বাঙ্কারের সামনের চায়ের দোকান থেকে চা নাস্তা নিয়ে আসেন। সহযোগী একজন মুক্তিযোদ্ধা বাঙ্কারের সাথে অবস্থিত বটগাছের পাশে বসে সবাইকে-চা-পরিবেশন করছিলেন। এমতাবস্থায় হঠাৎ করে তাঁরা দেখেন বাঙ্কার থেকেপ্রায় ৪০০/৫০০ গজ দূরে বাজারের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া চত্তগ্রাম-দোহাজারি রেললাইনের ওপর দিয়ে মানুষজন ছুটাছুটি করেছে। দেখে গেরিলারা সজাগ হয়ে ওঠেন। ইত্যবসরে দেখা যায়, ৩/৪টি বিআরটিসি বাস দ্রুতগতিতে ভাঙ্গা ব্রিজের দিকে এগিয়ে আসছে। গাড়িগুলো ব্রিজের সামনে এসে হঠাৎ ব্রেক করে দাঁড়িয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর খাকি পোশাকধারী একজন পাকসেনা অস্ত্রহাতে গাড়ি থেকে নেমে এদিক সেদিক তাকাতে তাকাতে ব্রিজটির দিকে এগিয়ে আসে। পূর্বপরিকল্পপনা অনুযায়ী পাকসেনাদের ওপর ২ নম্বর গ্রুপ থেকে ফায়ার করার কথা থাকলেও ফায়ার ওপেন হচ্ছে না দেখে ১ নম্বর গ্রুপ থেকে জয়নাল আবেদীন ফায়ার ওপেন করেন। ১ নম্বর দল ব্রিজের ওপর দাঁড়ানো ঐ পাকসেনাকে লক্ষ্য করে গুলি শুরু করার পরপরই গাড়ির ভেতর থেকে- ‘ইয়া আলী’ শব্দ করে দরজা ও জানালা দিয়ে সশস্ত্র পাকসেনারা গাড়ি থেকে নেমে পজিশন নিয়ে বাঙ্কার লক্ষ্য করে পাল্টা গুলি করা। শুরু করে। গাড়ি থেকে বাঙ্কারের দূরত্ব আনুমানিক ১০০ গজ। ইতোমধ্যে ২ নম্বর গ্রুপও পাকসেনা ও তাঁদের গাড়ি লক্ষ্য করে ফায়ার শুরু করে। প্রায় ২ ঘন্টা প্রচণ্ড গুলি বিনিময়ের পর হঠাৎ ১ নম্বর দল বাঙ্কার থেকে দেখতে পায় যে, দোহাজারির দিক থেকে ট্রেনে করে আরো পাকসেনা আসছে। তাছাড়া সংঘর্ষরত পাকসেনারা ক্রুলিং করে পুকুরের দিকে ও বাঙ্কারের দিকে এগিয়ে আস্তে থাকে। দুপক্ষের যুদ্ধের এ পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাবারুদ প্রায় ফুরিয়ে এলে আত্নরক্ষার জন্য তাঁরা পিছু হটতে বাধ্য হন। পড়ে দুই গ্রুপই আনোয়ারায় মিলিত হয়। এই অপারেশনে ১ম দল ১ টি এসএমজি, ৩টি রাইফেল ও ২টি গ্রেনেড ব্যবহার করে এবং ২য় দল ১টি স্টেনগান, ৪টি রাইফেল, ১টি জি ফোর রাইফেল ও ১ টি এসএলআর বাভয়ার করে। গ্রামের প্রত্যক্ষদর্শীমতে এই সংঘর্ষে ১১ জন পাকসেনা নিহত হয় ও বেশ কয়েকজন আহত হয়। পাকসেনাদের ২টি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। গেরিলাদের তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত