গড়ইখালী রাজাকার ক্যাম্প দখল, পাইকগাছা, খুলনা
পাইকগাছা থানাধীন একটি ইউনিয়ন গড়ইখালী। এখানে রয়েছে একটি বড় বাজার। এর অবস্থান শিবসা ও মিনহাজ নদীর মোহনায় দাকোপ ও পাইকগাছা থানার সীমান্তে। অবস্থানগত কারণে যুদ্ধের জন্য এর গুরুত্ব ছিল অনস্বীকার্য। ফলে এ বাজারের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে নিকটবর্তী আমিরপুর ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা সচেষ্ট হয়। এ ক্যাম্পের অধিনায়ক স.ম. বাবর আলী এ ব্যাপারে গড়ইখালী নিবাসী মুক্তিযোদ্ধা সোহরাব হোসেন সানাকে সতর্ক থাকতে বলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও জুন মাসের ২০/২২ তারিখের সন্ধ্যায় হঠাৎ খুলনা থেকে এক দল রাজাকার এসে গড়ইখালী বাজারে অবস্থিত গড়ইখালী ইউনিয়ন কমিউনিটি সেন্টারে ক্যাম্প স্থাপন করে। বাজারে রাজাকারদের উপস্থিতি খবর ছড়িয়ে পড়লে এলাকায় এক ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। লোকজন বাজার ছেড়ে পালাতে থাকে। এসময় সোহরাব ও তাঁর এক সহযোদ্ধা দ্রুত বাজার ত্যাগ করে কুমরখালী গ্রামের একটি পরিত্যাকগ বাড়িতে রাত কাটান। সকালে তিনি গোপনে গড়ইখালী হাই স্কুলে এসে রাজাকারদের গতিবিধি ও অবস্থান পর্যবেক্ষণ করার জন্য চাচাত ভাই রফিউদ্দিন সানাকে বাজারে পাঠান। এ সময় এখানকার পিস কমিটির সেক্রেটারি ছিল সোহরাবের নিকট আত্মীয় তাছের আলী গাজী। রফিউদ্দিনের সাথে দেখা হলে তিনি তাঁকে কৌশলে সোহরাবের সাথে দেখা করতে নিয়ে আসেন। সোহরাব তাঁকে জানান যে, তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা রাজকার ক্যাম্প আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং তাতে আশেপাশের ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে। এতে তাছের আলী ভীতসস্ত্রস্ত হয়ে রাজাকার কমান্ডার নওশের আলীর সাথে বৈঠকে বসেন এবং এতে মোবারক আলী বিশ্বাস, তাছের আলী, গাজি তমিজ উদ্দিন জোদ্দার, ডেপুটি রাজাকার কমান্ডার মফিজ উদ্দিন মোল্লা উপস্থিত হয়। আলোচনার শুরুতে মেশিনগানসহ ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সহস্রাধিক মুক্তিযোদ্ধার প্রস্তুতি ও আক্রমণের ভয়াবহ কথা তুলে ধরেন। তিনি আরো জানান যে, মুক্তিযোদ্ধারা গড়ইখালী বাজার ঘিরে রেখেছে, যে কোনো মুহূর্তে তারা আক্রমণ চালাতে পারে, কেবল তাঁর হস্তক্ষেপে তা সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। সুতরাং যুদ্ধ এড়ানোর পথ বের করা জরুরি। এ কথা শুনে রাজাকার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার স.ম.বাবর আলীর সাথে আলোচনায় বসতে আগ্রহ প্রকাশ করে এবং সে মোতাবেক পরের দিন রাত ১১টায় গড়ইখালি হাইস্কুল ভবনের নিচ তলায় সোহরাবের নিজস্ব কক্ষে বৈঠকের আয়োজন করা হয়। আলোচনায় বসার পূর্বে স.ম.বাবর আলী আমিরপুর ক্যাম্প থেকে সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নিয়ে এসে আলোচনা স্থানের চারপাশে গোপন সর্তকতামূলকভাবে মোতায়েন করেন, যাতে রাজাকাররা কোন চাতুর্যের আশ্রয় নিয়ে তাদের কোনো ক্ষতি করতে না পারে। বৈঠকে বাবর আলীর সাথে তার দুই সহযোগী গাজি রফিকুল ইসলাম ওঁ আবুল কালাম আজাদও অংশ নেন। বৈঠকে মুক্তিযোদ্ধার পক্ষ থেকে রাজাকারদের অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দেয়ার প্রস্তাব করা হলে রাজাকার কমান্ডার তা প্রত্যাখান করে উভয় বাহিনীর সহবস্থানের প্রস্তাব দেয়। এ প্রস্তাব প্রত্যাখান করে স.ম.বাবর আলী স্পষ্টভাবে তাদেরকে নিঃশর্ত আত্মমসমর্পন করতে বলে। তিনি আরো বলে যে, আত্মসমর্পণ করলতে তাদের কোন ক্ষতি করা হবে না, অন্যথায় তাদের ক্যাম্প ধ্বংস করে দেয়া হবে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের কঠোর মনোভাব সত্ত্বেও রাজাকার নেতা বারবার সহবস্থানের প্রস্তাব দিতে থাকে। আত্মসমর্পণে রাজী না হওয়ায় এবং সহাবস্থানের মনোভাবে অনমনীয় থাকায় স.ম.বাবর আলীর ইঙ্গিতে বাইরে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধারা ফাঁকা গুলিবর্ষণ করেন। এতে রাজাকার নেতা ভীতসস্ত্রস্ত্র হয়ে আত্মসমর্পণ করতে রাজী হয়। বাবর আলী রাজাকার মফিজ মোল্লাকে জিম্মি করে রেখে তমিজউদ্দিন জোদ্দার ও মুক্তিযোদ্দা আজিজ সানাকে রাজাকার ক্যাম্পে পাঠান এবং ঘন্টাখানেকের মধ্যে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে এলে মফিজ মোল্লাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এর পরপরই রাজাকাররা সকলেই এ এলাকা থেকে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে আর কখনো তারা এই এলাকায় আসেনি। তবে কয়েকটি অস্ত্র তারা লুকিয়ে রাখে এবং যাবার সময় তা দিয়ে ক্যাম্প ভবনে কয়েক রাউন্ড গুলি করে। অবশ্য তাদের হাতে আটক থাকা দাকোপের ১০ জন লোককে তারা সাথে নিয়েযায়। এদের মধ্যে একজন পালিয়ে বাঁচতে সক্ষম হলেও বাকিদের খুলনায় অবস্থিত পাকসেনারা হত্যা করে। এভাবে প্রায় বিনা রক্তপাতে এ এলাকার প্রথম অভিযান সফল হয়। রাজাকারদের বেশ কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। এ ঘটনায় তাদের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। খুলনার গুরুত্বপূর্ণ এই এলাকার উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হঅয়ায় পরবর্তী অপারেশন সমূহের উপর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত