গলেয়ার আক্রমণ, পঞ্চগড়
পঞ্চগড় জেলা সদর থেকে উত্তরে গলেয়া নামক স্থানে পাকিস্তানিরা শক্ত ঘাঁটি স্থাপন করেছে। মুক্তিবাহিনীর অবস্থান শত্রু ঘাঁটির পূর্ব দিকে ভারতীয় সীমান্ত ফাঁড়ি সাকতি বিওপি থেকে পূর্ব-দক্ষিণে। পেয়াদাপাড়ার উল্টোদিকে গলেয়া বাজারে শত্রুদল ঘাঁটি গেড়েছে পানি মাছ ঘাঁটি স্থাপনের পাশাপাশি। তালমা ব্রিজ পেরিয়ে জেলা বোর্ডের উঁচু রাস্তার সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে গলেয়া বাজারে সাথে। হাঁড়িভাসা বাজার যেমন বেরুবাড়ি শরণার্থী শিবিরের উল্টোদিকে, তেমনি সাকাতি শরণার্থী শিবিরের উল্টোদিকে অবস্থান গলেয়া বাজারে। উত্তর পাশ থেকে পঞ্চগড় গ্যারিসনের আক্রমণ ঠেকানোর জন্য শত্রুরা পানিমাছ এবং গলেয়া বাজারের অগ্রবর্তী ঘাঁটি স্থাপন করেছে। পানিমাছ থেকে যেমন নিয়মিত পাকিস্তানীরা হাঁড়িভাসার দিকে অভিযান চালিয়ে বেরুবাড়ি শরণার্থী শিবিরের জন্য হুমকির সৃষ্টি করে রেখেছে, তেমনি গলেয়া শত্রুঘাটি সাকাতি শরণার্থী শিবিরের জন্য প্রচণ্ড রকমের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। গলেয়া ঘাঁটিতে রাজাকার ও শত্রু মোটামুটি শক্তভাবে গেড়ে বসেছে এবং আশপাশের এলাকায় অত্যাচার চালিয়ে কায়েম করেছে ত্রাসের রাজত্ব। ১১ অক্টোবর রাতে গলেয়া পাকিস্তানী ঘাঁটিতে আক্রমণ করা হয়। গত রাতের মন্ডলের হাট আক্রমণের অনুরূপ ধারাতেই আজকের অভিযানে রওয়ানা দেয়া হয় দলবলসহ রাত আটটার দিকে। পোয়াদাপাড়ায় দলে সমবেত করে চূড়ান্ত ব্রিফিং শেষে রওয়ানা দেয়া হয়। অতিক্রম করতে হয় অনেকটা দূরের পথ। আজকের সিদ্ধান্ত হচ্ছে তিন স্কোয়াডের সম্মিলিত শক্তি দিয়ে যে করেই হোক গলেয়া ঘাঁটি থেকে শত্রুদলকে উৎখাত করতে হবে। গলেয়া শত্রুঘাঁটি অভিমুখে মুক্তিযোদ্ধারা তিন দিক দিয়ে এগিয়ে চলে। যুদ্ধ চলা অবস্থায় শত্রুর যে জায়গাটি দুর্বল প্রতিপন্ন হবে সে দিকেই প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে শত্রুর প্রতিরক্ষা লাইন ভেদ করতে হবে। আর এটা করতে পারলে শত্রু তাদের অবস্থান ছাড়তে বাধ্য হবে। তারপরই সম্মিলিতভাবে ঝড়ের বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রুর ঘাঁটি দখলে নিয়ে বাদবাকি কাজগুলো করতে হবে। কমান্ডার মাহাবুবের অবস্থান আজ বাঁয়ে, মাঝখানে আহিদার। ডানে বদিউজ্জামান। খলিল-মতিয়ারসহ পুরনো কজন সাথী রয়েছে তাঁর সাথে। মোট ৪৫ জন যোদ্ধা অংশগ্রহণ করছে আজকের যুদ্ধে। গাইড হিসেবে এবং গোলাবারুদসহ অন্যান্য জিনিসপত্র বহন করার জন্য আরো ৮ থেকে ১০ জন স্থানীয় লোক এসেছে। আজকের দলটা সত্যিই ভারী আর শক্ত। যুদ্ধের সময় প্রতিটি স্কোয়াডের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু প্রত্যেক দলের লক্ষ্য থাকবে একটাই। আর সেটা হচ্ছে অপারেশনে সফলতা অর্জন। অবস্থা বেগাতিক দেখলে কিংবা সিদ্ধানহীনতাঁর কারনে কোনো দলই ভয় পেয়ে অন্যদের ফেলে পালিয়ে যাবে না। পিছিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ে হবে যৌথভাবে। আর সেটা অপারেশন সফল বা বিফল যাই হোক না কেন। প্রায় তিনশ গজ দূরে থাক্তেই গুলি শুরু করে দেয় মাঝখানে থাকা দলটা। আরো কিছুটা এগিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর থাকে না। তাই দৌড়েই চলে উঁচু রাস্তাটা লক্ষ্য করে। ডানদিকের দল থেকেও গুলিবর্ষণ শুরু হয়ে যায় তাঁর পরপরই। পাকবাহিনী এবার মহাব্যতিব্যস্ত হয়ে তাদের প্রতি আক্রমণ শুরু করে। গুলির স্রোত বয়ে চলে সামনে গোলাগুকিরত মুক্তিযোদ্ধাদের দুটো দলে উদ্দেশে। শরুর আক্রমণের মুখে মুক্তিযোদ্ধারাও জবাব দিয়ে চলে সাধ্যমতো বাঙ্কার-ট্রেঞ্চে, সুরক্ষিত শত্রুর অবস্থানে। তাদের বিরতিহীন গুলিবর্ষণ চলতে থাকে আগুনের ফুল্কি তুলে। বোঝা যায়, এই গুলি এলোপাতাড়ি ছুঁড়ছে রাজাকারের দল। মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুঘাটির মোটামুটি পেছনে এসেই পৌঁছেছে। মুক্তিবাহিনীর সামেনেই চলতে থাকে আক্রমণ প্রতি আক্রমণের তাণদবলীলা। আরো দুই-তিনটা মর্টারের শেল উড়ে আসে। শম্ভু, মালেক, মজিদ আর খলিলকে দিয়ে এবার একটা কমান্ডো দলে মতো গঠন করা হয়। প্রত্যেকের কোমরে আরো দুটো করে গ্রেনেড গুজে দেয়া হয়। খলিল আর শম্ভুর হাতিয়ার নিয়ে ওদের দুটো স্টেনগান দিয়ে দ্রুত এগিয়ে যেতে বলা হয় রাস্তার ঢাল দিয়ে। শত্রুঘাটির ভেতরে ঢুকে গ্রেনেড হামলা চালাবে ওরা এবং সম্ভব হলে স্টেনগানের বার্স্টের সাহায্যে মেশিনগান বসানো দুটো বাঙ্কারের দখল নেবে। খলিল তাঁর দল নিয়ে এগিয়ে যায়, অবশিষ্ট ছেলেদের দিয়ে কভার দিতে দিতে এগোতে থাকে মাহাবুব দ্রুত। প্রায় ৫০ গজের ভেতরে এসে মাটিতে বুক লাগিয়ে অবস্থান নেয় একরামুলকে ডানে রেখে। মধূসূদন তাঁর এলএমজি থেকে গুলি ছোড়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলে। মতিয়ার সতর্ক থাকে তাঁর এসএলআর নিয়ে মাহবুবের পাশ ঘেঁষে। বিশ্বস্ত চাঁদ মিয়া ঠিক মাহবুবের পেছনে। তাঁর অবস্থাতেই এ রকম যে, যুদ্ধ নয়, অন্যদের কভার দেয়া নয়, তাঁর প্রধানতম কাজ হচ্ছে একমাত্র মাহাবুবকে কভার দিয়ে শত্রুর হাট থেকে বাচিয়ে রাখা। এ অবস্থাতেই প্রায় ৫-৭ মিনিট কেটে যায়। আর তারপরই হঠাৎ করে শত্রুর গুলিবর্ষণ থেমে যায়। চিৎকার, হুড়োহুড়ি আর শোরগোল তুলে পালাতে থাকে শত্রুপক্ষের লোকজন বাজারের অপরদিকের খোলা মাঠের দিকে। শত্রু পালিয়ে যাচ্ছে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পরপরই ছেলেদের এগিয়ে যেতে বলা হয়। দোকান ও বাজারের ভিটি এসবের আড়াল নিয়ে। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের তরফ থেকে গুলিবর্ষণে চাপ অব্যাহত। মতিয়ার, খলিল, শম্ভুর হাট থেকেও ছুটে যায় সামনের দিকে একইভাবে গ্রেনেড। বিস্ফোরণের পর বিস্ফোরণ। এরপর সামনের দিকে ছুটে গিয়ে শুরু হয় শত্রুর বাঙ্কার দখলের পালা। বলতে গেলে খুবই স্বল্প সময়ের ব্যবধানে ঘটে যায় প্রায় অবিশ্বাস্য ঘটনাটি। আর ঘটনার পরপরই ক’জন জয়বাংলা শ্লোগান দিয়ে ওঠে। অল্পক্ষণের ভেতরেই জয়বাংলা শ্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে দখল করা শত্রুঘাঁটি গলেয়া বাজার। দূরে সামনের দিকে থেকে গুলিবর্ষণ থামিয়ে দিতে যুদ্ধরত দু দলের ছেলেরাও মুখর হয়ে ওঠে জয়বাংলা শ্লোগানে শ্লোগানে। দৌড়ে আসতে থাকে তারা গলেয়ার দিকে। একটা ট্রেঞ্চ থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে আনে ২ জন রাজাকারকে। তারা পালানোর ফুরসতই পায়নি। কিছু বলার আগেই গুলিতে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় রাজাকার দুজনের শরীর। মুহূর্তে তারা লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। ওরা এসে পড়েছে সবাই। এবার সম্মিলিতভাবে শত্রুঘাঁটিগুলো নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার কাজ শুরু হয়। বাঙ্কারগুলো উড়িয়ে দেয়া হয় চার্জ লাগিয়ে লাগিয়ে। দোকানের চালাগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। একটা বড়সড় যেটা সম্ভবত তাদের মূল আশ্রয়কেন্দ্র সেটাও চার্জ দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয়। বেশিক্ষণ সময় লাগে না এসব করতে। দূর থেকে অর্থাৎ তালমা পানিমাছ থেকে শত্রুর গুলিবর্ষণ শুরু হয়। সম্ভবত গলেয়া ঘাঁটি ধ্বংসের ব্যাপারে আঁচ করতে পেরেই নিজেদের ঘাঁটি রক্ষার কারণেই তারা শুরু করেছে গুলিবর্ষণ এই ঘটনাটি।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত