You dont have javascript enabled! Please enable it!

খায়রুল কোম্পানি, গাইবান্ধা

[গাইবান্ধার নজরুল ইসলাম এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছে কীভাবে তিনি গঠন করেছিলেন খায়রুল কোম্পানি] আমরা ১১ নং সেক্টরের মাইনকারচর সাব সেক্টরের ১১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা প্রথম ব্যাচে ভারতের হিমালয় রাজ্যের তুরা ট্রেনিং ক্যাম্পে ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে সাফল্যজনকভাবে একমাসব্যাপী গেরিলা ট্রেনিং সমাপ্ত করি। ট্রেনিং এর পর বাংলাদেশী রৌমারী সীমান্ত ভারতে মাইনকাচরে বিএসএফ ক্যাম্পের সাথের কামাক্ষা মন্দির এর পাশের টিলার উপর আমরা মুক্তিযোদ্ধারা তাবু খাটিয়ে অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করি। পরবর্তী পর্যায়ে এই টিলার উপরেই ১১ নং সেক্টরের অধীনে মাইনকারচর সাব সেক্টরের হেডকোয়ার্টার স্থাপিত হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা ১১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়েই মাইনকাচর সাবসেক্টরের গোড়াপত্তন হয়। এই সাব সেক্টরের প্রথম সেক্টর কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব পালন করে বিমান বাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার জনাব শফিকউল্লাহ ও পরবর্তী সেক্টর কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করে বিমান বাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হামিদুল্লাহ খান। প্রাথমিক পর্যায়ে ১১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা কতগুলি সেকশনে বিভক্ত হয়ে অপারেশন করার জন্য আমরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করি। অনুরূপ একটি সেকশন ১১ জন মুক্তিযোদ্ধারা কমান্ডারের দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়ে আমি খায়রুল আলম রৌমারীর ভিত্র দিয়ে চিলমারী বন্দরের নদীর অপর পাড়ের চরে অবস্থান নেই। তখন বর্ষাকাল ছিল। ছোট একটি নৌকায় আমাদের ১১ জনের একটি দল নিয়ে অবস্থান করছিলাম দিবারাত ঐ নৌকায়। পালাক্রমে রাতে দুইজন পাহাড়ায় নিয়োজিত থাকত বাকী ৯ জন নৌকায় নিদ্রা যেতো। নৌকা এত ছোট ছিল যে পা গুটাতে হত। এইভাবে দুইতিন দিন অবস্থানের পর বুঝে উঠতে পারছিলাম না কিয়াবে কোথায় কি অপারেশন করব। এই দিকে ২/৩ দিন আমাদের সাথে খাবার না থাকায় আমরা অর্ধাহারে অভুক্ত ছিলাম! এমতাবস্থায় স্থানীয় সামাদ মেম্বারকে আমাদের কষ্টের কথা জানালে উনি আমাদের জন্য কিছু খাবারের ব্যবস্থা করে দেন। হঠাৎ করে খবর আসে চীলমারী থেকে পাকসেনারা কুড়িগ্রামের দিকে চলে গেছে। থানায় কেবল মাত্র পুলিশ বাহিনী অবস্থান করছিল। আমি চিন্তা করলাম চিলমারী থানা অপারেশনের এটাই একটি উত্তম সুযোগ। এই সু্যোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। আমার সঙ্গী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পরামর্শ করে তাদের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও আমি দিনেরবেলা থানা অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নেই। আমি যুক্তি দেখাই যে, রাতেরবেলা পুলিশ বাহিনী থানায় চারদিকে বাঙ্কারে অবস্থান নেয়। কাজেই রাতেরবেলা অপারেশন করে কর্তকার্য হওয়া একবারেই অসম্ভব। আমাদের কাছে ভারী অস্ত্র বলতে একটি মাত্র এলএমজি এবং আমার সাথে একটি সাব মেশিনগান, অন্য আটজন মুক্তিযোদ্ধার হাতে ৮টি ভারতীয় এসএলয়ার। তবে প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধার সাথে পর্যাপ্ত সংখ্যক গুলি ও হ্যান্ডগ্রেনেড ছিল। কাজেই এই অস্ত্র দিয়ে বাঙ্কারে অবস্থানকারী পুলিশকে পর্যুদস্ত করা একেবারেই অসম্ভব। আমার সিদ্ধান্ত মোতাবেক পরদিন দুপুরে খাওয়ার পর আনুমানিক বেলা ১২টার সময় নৌকায় করে আমরা নদীর অপর পাড়ে চিলমারী বন্দরের দুই মাইন ভাটিতে একটি রাস্তা, যা নদীর পাড় থেকে সরাসরি থানার দিকে চলে গেছে। সেই রাস্তার উদ্দেশ্যে নদী পাড়ি দেই। আনুমানিক বেলা ২টার দিকে নদীর অপর পাড়ে রাস্তার নিকট নৌকা ভিরাই। নদী ওপাড়ের রাস্তা থেকে থানার দূরত্ব প্রায় দুই মাইল হবে। আমি সিদ্ধান্ত নেই নৌকা থেকে নামার পর এক দৌড়ে থানার দিকে ছুটে যেতে হবে, পথে কোন দেরী করা অথবা আসতে দৌড়ানো চলবে না। কারণ আমাদের আক্রমণের খবর কোনক্রমেই যেন থানায় পৌঁছাতে না পারে। অর্থাৎ কোন লোক সাইকেল অথবা দৌড়ে যাতে আমাদের আক্রমণের খবর থানায় পৌঁছাতে না পারে। যদি কোনক্রমে আমাদের থানা আক্রমণের খবর থানা আক্রমণের পূর্বে পৌঁছে তবে আমাদের মৃত্য ও পরাজয় অনিবার্য। আনুমানিক ২টার দিকে আমরা নৌকা থেকে নেমে রাস্তার ডান পাশে পাঁচজন ও রাস্তার বামপাশে ৬ জন রাস্তা দিয়ে না দৌড়ে রাস্তার পাশের জমি দিয়ে সোজা থানার দিকে দৌড়াতে থাকি। কারণ রাস্তার উপর দিয়ে ১১ জন সোজা দৌড়ানো নিরাপদ নয়। তাতে আমরা ১১ জনই সরাসরি শত্রুর গুলির আওতায় চলে আসতে পারি। অপর রাস্তার যে কোন এক পাশ দিয়ে ১১ জন একসাথে দৌড়াতে থাকি তাতে ১১ জনই অনুরূপভাবে সরাসরি শত্রুর গুলির আওতায় সরাসরি চলে আসতে পারি। সুতুরাং রাস্তার দুই পাশের নিচু জমি দিয়ে দুইভাগে দৌড়ে থানায় পৌঁছানো সবচেয়ে নিরাপদ। কমান্ডার হিসাবে আমার অবস্থান ছিল বামপাশের পাঁচজনের পর ও ডান পাশে পাঁচজনের আগে অর্থাৎ দুই দলের মঝামাঝি আমি দৌড়াতে থাকি। এই অপারেশন আমাদের জীবনের সকলেরই প্রথম অপারেশন। এবং কাহারও কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। বলতে দ্বিধা নাই। থানা যতই নিকটবর্তী হচ্ছে সকলেরই অজানা ভয় ও আশংকায় দৌড়ে গতি কমে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় দলের কমান্ডার হিসাবে দলের সকলের সামনে আমি দৌড়াবার সিদ্ধান্ত নেই এবং সকলকে অনুরোধ করি আমাকে অনুসরণ করতে। ফলে দৌড়ের গতি আবার বেড়ে যায় এবং সকলে আমাকে অনুকরণ করতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অর্থাৎ বেলা আড়াইটার দিকে আমরা থানায় পৌছি এবং থানা থেকে ১৫/২০ গজ দূরে জমির আইলে কেউ কিছু না বুঝার পূর্বেই অবস্থান নেই এবং থানাকে লক্ষ্য করে আমরা সকলে একত্রে গুলি বর্ষণ করি। প্রায় পাঁচ মিনিট এক নাগাড়ে বিরামহীনভাবে হাজার রাউন্ডের উপর গুলি থানার উপর বর্ষণ করি। থানা ছিল সম্পূর্ণ টিনের তৈরি। ফলে থানা ঘরটির অবস্থা জালের মত ছিদ্র হয়ে যায়। ৫ মিনিট পর আমি সকলে গুলিবর্ষণ করতে নিষেধ করি এবং একজনকে নির্দেশ দেই থানার ভিতরে পর পর তিনটি হ্যান্ডগ্রেনেড চার্জ করার জন্য যাতে থানার ভিতর থেকে আমরা আক্রমণের শিকার না হই। গ্রেনেড চার্জ হওয়ার পর এলএমজিম্যান হুদাকে আরও পাঁচজন সহ থানায় প্রবেশকারী সংযোগ সড়কে অবস্থান করতে বলি যাতে থানার বাহিরে যেন কেউ আক্রমণ অথবা অনুপ্রবেশ করতে না পারে। আমি চারজনসহ থানার ভিতর প্রবেশ করি ও থানার অস্ত্রাগার ভেঙে পাঁচটি রাইফেল (৩০৩) ব্যায়নেটসহ, প্রচুর গুলো ও কয়েকটি হেলমেট পাই। এই সমস্ত নিয়ে আমরা সকলে আবার নৌকার দিকে রওয়ানা হই। ফিরতি পথে হাজার হাজার গ্রামবাসীর সাথে আমাদের করমর্দন এবং আমাদের থানা জয়ের উল্লাস জীবনের প্রথম অপারেশনের সাফল্য সবকিছু মিলে যে আনন্দ উল্লাসের অনুভূতি ছিল তা বিশ বছর পর আজও আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। এই থানা জয়ের সাফল্যে পরবর্তী পর্যায়ে আমার নিজের নাম অনুসারে খারুল আলম কোম্পানীর গোড়াপত্তন হয়। এর কয়েকদিন পর কর্নেল তাহের ও উইং কমান্ডার হামিদুল্লা খান আমাকে রৌমারীতে ডেকে পাঠান এবং প্রায় ১০০ জন মুক্তিযোদ্ধার দায়িত্ব আমার উপর ন্যস্ত করা হয় ও নবগঠিত কোম্পানীর নাম রাখা হয় খায়রুল আলম কোম্পানী। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে আমার নাম নজরুল ইসলাম কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সময় আমার ও আমার পরিবারের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে খায়রুল আলম ছদ্ম নামে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করি। যুদ্ধশেষে আমরা কোম্পানীর অধীনে প্রায় ৫০০ মুক্তিযোদ্ধা ছিল।
এই বর্ণনা থেকে আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতা এবং গেরিলা অপারেশনে নানা কৌশল রচনার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাই।
[৫৮০] ড. মোঃ মাহবুবুর রহমান

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!