খেলাফত বাড়ি তথা বসিগ্রাম ঘাঁটি আক্রমণ, কুমারখালী
চাকুলিয়ায় প্রথম ব্যাচে গণবাহিনীর (কুমারখালী) ৩৫ জন প্রশিক্ষণ নেন। তাদেরকে প্রথমে পর্যবেক্ষণের জন্য হালকা কিছু অস্ত্র দিয়ে পাঠানো হয়। তারা ফিরে গেলে ১০/১২ জনের একটি দল করে ২টি এস.এম.জি ২টি এস.এল.আর, ৫টি রাইফেল আর বাকিদের অস্ত্র ছাড়াই পাঠানো হতো। তবে প্রচুর পরিমাণে গুলি, গ্রেনেড ও বেয়নেট তাদের দেয়া হতো। জুলাই মাসের মধ্যেই বদরুল ইসলাম বদর (সুলতান), মোকাদ্দেস হোসেন (শালঘর মধুয়া), লুৎফর রহমান (ডাঁশা) প্রমুখ কমান্ডারের নেতৃত্বে দলগুলো আসতে থাকে। গড়াইয়ের দক্ষিণাঞ্চলে কুমারখালী, খোকশা এবং শৈলকুপার বিভিন্ন গ্রুপের দায়িত্ব দেয়া হয় (ভারতের কৃষ্ণনগর ক্যাম্প থেকে) লুৎফর রহমানের ওপর। তিনি খোকশার চাঁদট, মোড়াগাছা প্রভৃতি জায়গাতে রাজাকারদের অবস্থানের ওপর সফল আক্রমণের চালিয়ে বেশ কিছু অস্ত্র যোগাড় করেন। এছাড়া আওয়ামী লীগ নেতা আ. মজিদ (যদুবয়রা) চিঠির মাধ্যমে (তিনি তখন ভারতে) প্রতিরোধ যুদ্ধে ব্যবহৃত কিছু অস্ত্রের সন্ধান দেন। এসব কিছুর ফলে স্থানীয় তরুণদের সাহায্যে তিনি বেশ বড় একটা দল গঠন করেন। পান্টি ইউনিয়নের অত্যাচার,লুট ও নারী নির্যাতনের নায়ক শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান খেলাফত হোসেনের বাড়ি আক্রমণের উদ্দেশে তিনি লাঙ্গল বাঁধের চেয়ারম্যান খেলাফত হোসেনের বাড়ি আক্রমণের উদ্দেশে তিনি লাঙ্গল বাঁধের চেয়ারম্যান (শৈলকূপা থানা) মুক্তার হোসেনের সহায়তায় মাগুরার আকবর হোসেন সাথে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন। ২২ জুলাই রাতে আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয় এবং লুৎফর রহমান তাঁর অধীনস্থ প্রায় ১১টি উপদলের প্রধান আ. মাসুদ ফুল, আলাউদ্দিন মিয়া, ওমর আলী (গণেশপুর), আ. মালেক (গণেশপুর), ইকবাল (শৈলকুপা), সোবহাব (পান্টি), কিয়ামউদ্দিন (বল্লভপুর) প্রমুখের সহযোগিতায় গোপনে প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তাঁরা পাংশার নটাভাঙ্গা, কসবা মাজাইল, সুবর্ণকোলা প্রভৃতি গ্রাম থেকে নৌকাযোগে এসে বনগ্রাম, গোঁসাইডাঙ্গাতে অবস্থান নেন। আকবর হোসেন আসতে না পারলেও তারা খুবই শক্তিশালী এই অবস্থানটি দখল করার জন্য বিভিন্ন আগে বিভক্ত রাত একটার দিকে রওয়ানা হন। চারদিক থেকেই গ্রামটি (বসিগ্রাম) ঘিরে ফেলে আসতে আসতে ক্লোজ হতে বলা হয়। কমান্ডার লুৎফর রহমান পশ্চিমে অবস্থান নেন, কারণ এই দিকে পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল বেশি। তিনি প্রথমে ‘ফায়ার ওপেন’ করার পর গুলি করতে বলা হুলেও হারিকেন জ্বালিয়ে তাস খেলতে থাকা কিছু টহল রাজাকারকে দেখে এক স্থানীয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা গুলি করেন। সাথে সাথেই বিভিন্ন দিক থেকে একযোগে গুলি শুরু হয়। ‘Same side’ যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দেয়। এ সুযোগ রাজাকার খিলাফত পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। মুক্তিযোদ্ধারা রুস্তম নামক এক রাজাকারকে কুপিয়ে হত্যা করে এবং লুটকৃত দ্রব্যাদিসহ খিলাফতের বাড়িটি জ্বালিয়ে দেয়। এভাবে অভিযান শেষ করে কমান্ডারের নির্দেশে সবাই পূর্ব থেকেই ঘাটে রাখা নৌকায় আবার পাংশার উদ্দেশে রওয়ানা দেয়। কিন্তু সেকশন কমান্ডার ইকবাল ও মালেকের গ্রুপ পথ ভুল করে সান্দিয়ারা চাষী ক্লাবের দিকে জায়। ওয়াপদা অফিসের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ওয়াপদার কর্মকর্তার স্ত্রী বাইরে বেরিয়ে এসে ইঙ্গিতে মুক্তিযোদ্ধাদের জানায় যে খেলাফত চাষী ক্লাবে আত্মগোপন করেছে। সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে আসা যোদ্ধা ইকবাল মুহূর্তের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নেন খেলাফতকে ধরার। তিনি চাষী ক্লাবের দরজায় আঘাত করে তাঁকে বের হয়ে আসতে বলেন। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়া-শব্দ না পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা দরজা ভেঙেই দুই স্ত্রী পরিবেষ্টিত খেলাফতকে দেখতে পায়। সহযোগী যোদ্ধারা সাথে সাথেই গুলি করতে চাইলেও ইকবাল তাদেরকে কেন্দ্রের নির্দেশ অনুযায়ী জীবন্ত নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। ফলে দুই স্ত্রীর হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে ধ্বস্তাধস্তি হতে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের। এ সময় পাশে ছাগলে ঘরে লুকিয়ে থাকা খেলাফতের বড় ছেলে শহিদুল ইসলাম ঝন্টু পালিয়ে যাওয়ার সময় ধস্তাধস্তির দৃশ্য দেখতে পায়। সে তৎক্ষণাৎ অসতর্ক মুক্তিযোদ্ধাদেরকে লক্ষ্য করে খুব কাছে থেকে হাতের স্টেনগানের সাহায্যে গুলি করে। গুলিতে সাথে সাথেই ইকবাল ও কিছু সময়ের মধ্যেই আনসার, কুদ্দুস, গোপাল, লুৎফর শহীদ হন। এছাড়া গুরুতর আহত হন মালেক, ওয়াজেদ আলী, সুলতান উদ্দিন, আ, জলিল এবং আ. সাত্তার। খিলাফর ও তাঁর ছেলে সহজেই পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। গ্রামবাসীদের সহায়তায় আহতদের প্রথমে গণেশপুর, সেখা থেকে পাংশা ও তারপর ভারতে চিকিৎসা করা হয়। জুলাইয়ের শেষে অথা আগস্টের প্রথমে থানাতে মুজিববাহিনীর প্রথম দলটি প্রবেশ করে। মির্জা জিয়াউল বারী নোমান কুষ্টীয়া-৩ অঞ্চল অর্থাৎ কুষ্টিয়া সদর, শৈলকুপা, কুমারখালী ও খোকশার দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তিনি সদরের কিছু অংশ এবং খোকশা কুমারলীর দক্ষিণঞ্চলের দায়িত্ব প্রদান করেন জাহিদ হোসেন জাফরকে। গড়াই নদী দ্বারা দু’ভাগে বিভক্ত হওয়ার থানাকে কৌশলগত কারণে নদীর উত্তর ও দক্ষিণ আলাদা করা হয়। উত্তরের কমান্ডারগণ ছিলেন আবদুল্লাহেল বাকী (কয়া), খুশী (দূর্গাপুর), খলির (আমবাড়িয়া), হাবিব (মহেন্দ্রপুর এলাকায়), আ, রাজ্জাক (শিলাইদহ এলাকায়) এবং দক্ষিণের লুৎফর রহমান (ডাঁশা), মোকাদ্দেস হোসেন (শালাঘর মধুয়া), বদর (দমদমা এলাকায়), জাফির (পান্টি), আ.মাসুদ ফুল (নগর কয়া) এবং জাহিদ হোসেন জাফর (পান্টি) শামসুজ্জোহা (কুশলীবাসা)
[৫৯৪] এ.টি.এম. যায়েদ হোসেন
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত