You dont have javascript enabled! Please enable it!

গঙ্গাজলী ব্রিজের লড়াই, রূপসাবাজার, ফরিদগঞ্জ

দিনটি ছিল বুধবার। ২নং প্লাটুনকে ডিফেন্স ছিল খাজুরিয়া গল্লাক ও রামগঞ্জের অবস্থানে। এগিয়ে রূপসার একটু আগে গঙ্গাজলী ব্রিজের কাছে দুইটি সেকশান নিয়ে ডিফেন্স করে আছে নায়েক সুবেদার হারেস (আলিপুর), তার সাথে আছে গফুর বেলুচ (বর্তমান অনারারি ক্যাপ্টিন অবঃ গেরিলা রেজিমেন্ট), বক্কা (হাজিগঞ্জ), সফিক, ফজলু, বোরহান চৌধুরী, জনাব ভূঁইয়া আরো অনেকে। মূলতঃ হারেস ভাইয়ের গ্রুপ ছিল ডিফেন্স। কিন্তু পাঠান সাহেব গোপনে খবর পেয়ে আমাদের প্লাটুন কমান্ডার আঃ রশিদ (কাসারা) ও কয়েকজন চৌকস মুক্তিযোদ্ধাকে সেখানে পাঠান। হাবিলদার রশিদের সাথে আরও ছিলেন জনাব আমিনুল হক মাষ্টার ও অন্যান্য সংগ্রাম কমিটির লোকজন। পাঠানের নির্দেশে নায়েক সুবেদার হারেসকে জানানো হলে তিনি তার লোকদের গঙ্গাজলী ব্রিজের উভয় দিকে এবং হাবিলদার রশিদ চলে যান রূপসা দেওয়ানজি বাড়ি ও দিঘির পাড়ে। হাতিয়ারের মধ্যে হাবিলদার রশিদের কাছে দুটি এবং নায়েক হারেসের কাছে দুটি ব্রিটিশ এলএমজি, বাকী রাইফেল। ওপি সাইকেলে খবর নিয়ে আসলো একদল পাকসেনা ও রাজাকার পায়ে হেঁটে রূপসার দিকে আসছে। পুনরায় খবর এলো পাকবাহিনী ও রাজাকারগণ রূপসার কাছে এসে গেছে। কিছুক্ষণ পর শুরু হল ৩ ইঞ্চি মর্টারের শেলিং। মাঝে মাঝে চাইনিজ রাইফেলের সিঙ্গেল ফায়ার। শত্রু রূপসা বাজারে আসলে একদম রূপসা দিঘীর পশ্চিম পাড়ে ডিফেন্স কএর এবং বাকীরা রাজাকারদের নিয়ে দোকানের তালা ভেঙে মালপত্র স্তুপ করতে থাকে। এ অবস্থায় সর্বপ্রথম আক্রমণ করেন। হঠাৎ আক্রমণে রাজাকার এবং পাকবাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। বাজারে উপযুক্ত পজিশানের স্থান না থাকতে রাজাকারগণ রূপসা দিঘতে লাফিয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পর শুরু হলো পাকবাহিনীর তরফ থেকে পাল্টা আক্রমণ। উভয় পক্ষে তুমুল লড়াই চলছে। একসময় হাবিলদার রশিদ নিজ অবস্থান ছেড়ে একটু সামনে গিয়ে দেওয়ানজি বাড়ির কাছ থেকে পাকবাহিনীকে একটানা ফায়ার করে যাচ্ছেন। তখন বেশীর ভাগ গুলি এদিকেই আসছিল। সম্ভবতঃ সেকারণেই জনাব আমিনুল হক মাষ্টার আর বেশীক্ষণ অবস্থানে থাকতে পারলেন না। এক টানা লড়াইয়ের মাঝে তিনি কখন যে পিছনে জঙ্গলে রূপসা দেওয়ানজি বাড়ির ডোবায় পরে হাবু ডুবু খাচ্ছিলেন। এক সময় তিনি বেহুস হয়ে ঝোপ জঙ্গল বিছিয়ে সেখানেই পরে ছিলেন। সেখানে সংগ্রাম কমিটির আরও দুধর্ষ কর্মী ছিলেন, তাদের মধ্যে জনাব মজিবুর রহমান বিএসসি (বর্তমান আষ্ট্রা হাই স্কুলের হেডমাস্টার), জনাব বুলা মাস্তান, জনাব আব্দুল হাই, জনাব নজির কবি রূপসা, জনাব নজির খলিফা, আব্দুল মান্নান, হারুন আর রশিদ, আরো অনেকে। তাদের অনেকেই তখন মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতার কাজে রূপসা বাজারের উত্তর পাশে লাউতলীর দিকে ছিল। প্রচণ্ড প্রতিরোধে পাকবাহিনী এবার পিছু হাঁটতে শুরু করে বাজার থেকে শ্লোগান দিয়ে এরপর জনগণ বের হয়ে এল। এদিকে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারাও বাজারের ভিতর দিয়ে এগিয়ে এলো। জনতা পাকবাহিনীর লটের মাল প্রায় ২০০ বুলেট এবং একটি চাইনিজ রাইফেল কুড়িয়ে পায়। রূপসা বাজারে রাস্তায় পাকবাহিনীর প্রচুর রক্ত পড়ে ছিল। পাকবেঈমানরা যাবার সময় রূপসা রশু মিঞার বাড়ি (রূপসা জমিদার বাড়ি) তে হানা দিয়ে জনাব নান্নু মিঞাকে ধরে নিয়ে যান। নান্নু মিঞা ছিলেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একজন অগ্নিপুরুষ, একজন বিশিষ্ট সংগঠক। নান্নু মিঞাকে ধরে নিয়ে গেছে এখবর যখন চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল। খপবর পাওয়ার সাথে সাথে জনতা ফরিদগঞ্জ, রূপসা, চানদ্রা, গাজীপুর, নোয়াখালী হতে বুলেট, কামান, বন্দুক ও মৃত্যুকে উপেক্ষা করে নান্নু মিঞার মুক্তির জন্য ফরিদগঞ্জ মিছিল করে এগিয়ে যায়। জনগণের প্রতিরোধের মুখে পাকবাহিনী সেদিন বাঙালি মুক্তি আন্দোলনের সৈনিক জনাব নান্নু মিঞাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এইভাবে সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখে একজন স্বাধীনতার বীরকে জনতা কতৃক ছিনিয়ে আনার ঘটনা ছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বিরল।
[৫০] ডা. মোঃ দেলোয়ার হোসেন খান

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!