You dont have javascript enabled! Please enable it!

খাগডহর যুদ্ধ, ময়মনসিংহ

ময়মনসিংহ জেলা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব কোণে খাগডহর গ্রামটি অবস্থিত। এখানে ইপিআর উইং হেড কোয়ার্টার এর অবস্থান। ইপিআর সদস্যদের মধ্যে বাঙালি অবাঙ্গালিদের মিশ্রণ ছিল। ২৫ মার্চ ময়মনসিংহ উইং হেড কোয়ার্টারে কমান্ড স্তরে অবাঙালি ইপিআর সদস্যরা ছিল প্রাধান্য। পাকবাহিনী উইং কমান্ডার ক্যাপ্টেন কমর আলী আব্বাস সম্ভাব্য গোলাযোগের আভাসে সীমান্ত থেকে সমস্ত অবাঙালি সদস্যকে উইং হেড কোয়ার্টারে নিয়োজিত করে। একই সময়ে বাঙালি সদস্যরা কার্যকলাপের ওপর নজর রাখার নির্দেশ দেন।
২৫ মার্চ রাতের ময়মনসিংহের ইপিআর এর বাঙালি সদস্যগণ ঢাকার সংবাদ অবহিত হয়ে নিজেদের মধ্যে করণীয় বিষয়ে আলোচনার চেষ্টা চালায়। ২৬ মার্চ উইং কমান্ডার ক্যাপ্টেন কমর আলী আব্বাস কৌশল সমস্ত বাঙালি ইপিআর সদস্যোকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা চালান। তিনি অস্ত্রগারের দায়িত্ব অবাঙালি ইপিআর সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করতে নির্দেশ দেন। এই সময় নানা অজুহাত বাঙালি ইপিআর সদসযদেরকে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে কর্তব্য পালন থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা হয়।

২৬ মার্চ রাতে বাঙালি ওয়ারলেস অপারেট ফরহাদ উইং কমান্ডারের এক নির্দেশ সম্পর্কে অবহিত কন। এই নির্দেশে বলা হয়েছিল, ২৭ মার্চ রাতে বাঙালি সদস্যদের নিরস্ত্র করা হবে, এমনকি প্রয়োজনে তাদের হত্যা করা হবে। পাকিস্তানী উইং কমান্ডারের এই নির্দেশ জানতে পেরে ওয়ারলেস অপারেটর ফরহাদ বিষয়টি সুবেদার ফরিদউদ্দিনসহ অন্যান্য ইপিআর সদস্যদের জানিয়ে দেন। এর ফলে বাঙালি ইপিআর সদস্যগণ কোনো অবস্থায় অস্ত্র ত্যাগ না করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবেলার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।
২৫ মার্চ খাগডহর ক্যাম্পে আনুমানিক ১৩৮ জন অবাঙালি এবং ২২৫ জন বাঙালি ইপিআর সৈনিক কর্মরত ছিল। একই সময় ১৯৭০ এর নির্বাচনের সময় দায়িত্ব পালনে আগত ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক কোম্পানি সৈনিক (সে কোম্পানী) এই ইপিআর ক্যাম্পে অবস্থান করছিল। সেনাবাহিনীর এই কোম্পানীর কোম্পানী কান্ডার ছিলেন মেজর নুরুল ইসলাম শিশু (বাঙালি) এর তাঁর সঙ্গে অপর অফিসার ছিলেন লেঃ আবদুল মান্নান (বাঙালি)। উভয় অফিসার ময়মনসিংহ সিএন্ডবি ডাক বাংলোতে অবস্থান করতেন। মেজর নুরুল ইসলাম শিশু সেই সময়ে একই মাসে উপ-আঞ্চলিকে সামরিক প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করছিলেন।
২৭ মার্চ ক্যাপ্টেন কমর আলি আব্বাস বাঙালি সুবেদার ফরিদ উদ্দিনকে তাঁর অইসে ডেকে বিশ্রামে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। এরপর উইং কমান্ডারের অফিস থেকে বেরিয়ে সুবেদার ফরিদ উদ্দিন ইপিআরের অবাঙালি সৈনিকদের অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্রশস্ত্র বের করে ক্যাপ্টেন কমর আলী আব্বাসের বাসা নিয়ে যেতে দেখেন। উইং কমান্ডারের নির্দেশে এই অস্ত্র স্থানান্তরের বিষয়টি তার চিন্তায় নতুন মাত্রা যোগ করে। অল্প সময়ের মধ্যে সুবেদার ফরিদ উদ্দিন তাঁর সহকর্মীদের কাছে উইং কমান্ডারের মনোভাব এবং তাঁর বাসায় অস্ত্র নেয়ার বিষয়টি অবহিত করেন। এই আলোচনায় উপস্থিত বাঙালি হাবিলদার মিরাজ, আরিফ আহম্মদ, আব্দুল হাকিম সকলেই একমত হয়ে নিজেদের ব্যবহৃত অস্ত্র অস্ত্রগারে জমা না দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
একই ইপিআরের অবাঙালি হাবিলদা আজিম আকস্মিকভাবে অস্ত্রগারে কর্তব্যরত বাঙালি সিপাহী আফতাব, নান্নু এবং ইদ্রিসকে এল এমজি জমা দিতে নির্দেশ দেন। বাঙালি সৈনিকরা তাঁর নির্দেশ মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে এলএমজি নিয়ে ডিউটিতে থাকে। এর পাশাপাশি দু’জন অবাঙালি হাবিলদার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে টহল দিতে থাকে এবং তারা কয়েক দফা আফতাব এবং নান্নুকে ব্যারাকে ফিরে বিশ্রাম করতে বলে। কিন্তু সৈনিকদ্বয় তাদের কোথায় কর্ণপাত না করে যথারীতি প্রহরায় নিযুক্ত থাকে। সন্ধ্যার পর ইপিআর এর দুজন বাঙালি সদস্য অয়ারলেস অপারেট রেজা এবং জগলুল শাহ্‌ ক্যাম্পের পার্শ্ববর্তী খাগডহর বাজারে উপস্থিত হয়ে আন্দোলনরত স্থানীয় নেতৃবৃন্দের কয়েকজনের সঙ্গে অবাঙালি ইপিআরদের আক্রমণের বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। আলোচনায় খাগডহর ইপিআর ক্যাম্পে অবস্থানরত অবাঙালি সদস্যদের আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

এই আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয় যে, ছাত্র-জনতার পক্ষে ম. হামিদ, শফিউল ইসলাম প্রমুখরা যুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদান করবেন। সিদ্ধান্ত হয় যে, আক্রমণের সংকে হিসেবে রাত ১১টায় ক্যাম্পের পার্শ্ববর্তী অবস্থানে পৌঁছে পাকিস্তানীদের অবস্থান লক্ষ্য করে ২ রাউন্ড গুলি ছোঁড়া হবে। তার পূর্বে টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হবে।
পরিকল্পনা মোতাবেক রাত ১০ টায় ছাত্রনেতা ম.হামিদ, শফিউল ইসলাম, মইনুদ্দিন, সোলায়মান এবং ড্রাইভার হায়দার আলী ভেটেরিনারী ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের সামনে বিদ্যুৎ ও টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয়। রাত ১১টায় ম. হামিদ ও শফিউল ইসলাম দেশী বন্দুক থেকে ইপিআর ক্যাম্পের প্রতি দু’রাউন্ড গুলি ছোঁড়েন। এই সঙ্গে ক্যাম্পের চারপাশে অবস্থানকারী জনতা গগনবিদায়ী ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে চারদিক প্রকল্পিত করে তোলে।
খাগডহর ক্যাম্পে অবস্থানরত অবাঙালি ইপিআর সদস্যগণ জনতা এবং ইপিআরে বাঙালি সদস্যদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। এই ভেবে সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি ইপিআরদের প্রতি গুলিবর্ষণ করতে থাকে। সিপাহী মোস্তফা আরও একটি এলএমজি নিয়ে মূলভবনের সিঁড়ির মুখে পাহারায় থাকে যাতে ভবনের দো’তলা এবং তিনতলা থেকে কোনো অবাঙালি নিচে নামতে না পারে। নান্নু ও আফতাব এলএমজির সাহায্যে একটানা গুলি ছুঁড়তে থাকে যাতে শত্রু সৈন্যরা কোনোভাবে আর অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ব্যবহার করতে না পারে।
ক্যাম্পের বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত বাঙালি সদস্যরা যার কাছে যে অস্ত্র ছিল তাই নিয়ে অবাঙ্গালিদের উপর আক্রমণ চালায়। এই সময় জনতার একটি অংশ ইপিআর ক্যাম্পের ভিতর ঢুকে পড়ে। বাঙালি ইপিআর সদস্যরা অস্ত্রাগারের জানালা ভেঙে ভিতর থেকে অস্ত্র নিয়ে জনতার মধ্যে বন্টন করতে থাকেন। ইপিআর ক্যাম্পে অবস্থানরত ২য় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের নায়েক সুবেদার বড়ুয়া, নায়েক সুবেদার মোশাররফ হোসেন এবং সুলতান উদ্দিন তাদের সৈন্যদের নিয়ে ইপিআর সদস্যদের সঙ্গে একত্রিত হয়ে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মতো জনতা অগ্রসর হয়ে বাঙালি ইপিআরের পাশে এসে দাঁড়ায় এবং তাদের জন্য খাদ্য সরবরাহ করে। সারারাত উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ চলে।
২৮ মার্চ ভোরে ক্যাপ্টেন কমর আলী আব্বাস তার বাঙ্গাল থেকে ১০/১২ জন অবাঙালি ইপিআরসহ উইং হেড কোয়ার্টারে রিইনফোর্সমেন্ট এর চেষ্টা চালায়। সিপাহী হারুন, নান্নু, আফতাবসহ কয়েকজন ৩টি এমএমজিসহ উইং হেড কোয়ার্টারের অদূরে রেললাইনের উপর তাদের প্রতিহত করে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে ক্যাপ্টেন কমর আলী আব্বাসসহ সকল অবাঙালি সৈনিক নিহত হয়।

২৭ মার্চ রাত ১১টা থেকে ২৮ মার্চ সকাল নয়টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। যুদ্ধে প্রায় ১২১ জন অবাঙালি ইপিআর সদস্য নিহত হয়। সুবেদার মেজর জিন্নাতগুলসহ ১৭ জন অবাঙালি ইপিআর সদস্য নিহত হয়। সুবেদার মেজর জিন্নাতগুলসহ ১৭ জন অবাঙালি সদস্যকে আটক করে জেলখানায় রাখা হয়। খাগডহর ইপিআর ক্যাম্প থেকে ৩৫০০টি রাইফেল, ৪০টি এলএমজি, ৬টি ৩ইঞ্চি মর্টার উদ্ধার করা হয়।
[১৬] রিয়াজ আহমেদ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!