খাজুরিয়ার যুদ্ধ, ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর
২০ জুন ১৯৭১ তারিখ সোমবার, সাবসেক্টর কমান্ডারের নির্দেশ ১নং ও ৩নং প্লাটুনকে পাঠানো হল কামতা ও গল্লাকের কাছে। তারা হাজীগঞ্জ ও চাঁদপুর থেকে আগত পাকবাহিনীকে প্রতিহত করবে। কমরেড প্লাটুনকে দেওয়া হল খাজুরিয়ার কাছে ওয়াপদা বেড়ি বাঁধের উপর রামগঞ্জ, নোয়খালী থেকে আগত পাকবাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য। পাকবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার মিয়া তাসকিনউদ্দিন ফেনিতে নিয়োজিত ছিলেন।তিনি সময় সুযোগ পেলেই বৃহত্তর নোয়খালী জেলার চৌমুহনী সোনাপুর রুট দিয়ে আক্রমণ চালাতেন। এই দুর্ধর্ষ ব্রিগেডিয়ার একাধিকবার মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করে না। কারণ, প্রতিবারই তাঁকে অগণিত লাশ ফেলে রেখে অসংখ্য আহত সৈনিক নিয়ে পশ্চাদপসারণ করতে হয়েছিল। সেক্টরের যে কোন যুদ্ধে তাই প্লাটুনের সবাই তাঁর আগমন পথ আগলে বসে থাকতো। অনেক সময় লক্ষীপুর হয়ে রামগঞ্জ, রায়পুরের পথ ধরে সাব-সেক্টরের আঘাত হানত ব্রিগেডিয়ার মিয়া। তাঁকে সহয়তা করত লাকসামে নিয়োজিত ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি ও ব্রিগেডিয়ার আসলাম নিয়াজি। আবার তাদের সাহায্য এগিয়ে আসত কুমিল্লায় অবস্থানরত পাকিস্তান কমান্ডো ব্রিগেডের ৩নং কমান্ডো ব্যাটিলিয়ান কমান্ডার লেঃ কর্নেল জেড, এ খান এবং ১১৭ নং পদাতিক ব্রিগেডের ব্রিগেডিয়ার শেখ মঞ্জুর হোসেন। নির্দেশ অনুযায়ী প্লাটুন কমান্ডারগণ সেকশন কমান্ডারদের নিয়ে খুব ভোর থেকেই ডিফেন্স নিয়ে অবস্থান নেন। ২নং প্লাটুনকে দেয়া হল সোনাপুর অভিমুখের রাস্তাকে ডিফেন্স করার জন্য।
পাঠান সাহেব নিজ এক প্লাটুন রিজার্ভ রেখে দিলেন। হঠাৎ খুব সম্ভব জনতার কেউ খবর পৌঁছায় খাজুরিয়ায় পাকবাহিনীকে কমরেড প্লাটুনের লোকজন আক্রমণ করেছে। এইদিকে স্পষ্ট ব্রিটিশ এলএমজি ও রাইফেলের আওয়াজে বুঝা যায় যুদ্ধ বেঁধে গেছে। খবর শোনার সাথে সাথে সেকশান কমান্ডার অর্ডার করেন ফল-ইন এবং খাজুরিয়া অভিমুখে মুভ করার জন্য। সবাই পজিশন ছেড়ে এলএমজি, রাইফেল, রাউন্ডের বাক্স, ২ইঞ্চি মর্টার বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জাম কাঁধে নিয়ে খাজুরিয়ার দিকে দৌরাতে লাগল। সবাই প্রাণপণ দৌড়াচ্ছি। সাথে জনতাও দৌড়াচ্ছে। দৌড়াতে দৌড়াতে খাজুরিয়া বাজারে সিংহ গেইটের সামনে বিরাট একটি গাছের (বর্তমানে সেই প্রকান্ড গাছটি নেই) কাছে সবাই চলে আসে। জানা যায় পাকবাহিনী মহামায়া থেকে খাজুরিয়া এসে খাজুরিয়া রাজ বাড়ির সিংহ গেইটের সামনে কড়ই গাছের নিচে বসে দুপুরের খাবার কাচ্ছে। লোকজন খবর পেয়ে পাকবাহিনী মহামায়া থেকে খাজুরিয়া এসে খাজুরিয়া রাজ বাড়ির সিংহ গেইটের সামনে কড়ই গাছের নিচে বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছে। লোকজন খবর পেয়ে পাকবাহিনীকে আক্রমণে এগিয়ে আসে। তারা নিশ্চিত মনে খাবার খাচ্ছিল। এই খবর স্থানীয় একজন কুখ্যাত দালাল দৌড়ে গিয়ে পাকবাহিনীকে বলল, আপনারা রুটি খাচ্ছেন আর এদিকে মুক্তিবাহিনী আপনাদের ঘিরে ফেলেছে। অবস্থা বেগতিক দেখে পাকবাহিনী পালাতে শুরু করে। এই অবস্থায় বেঙ্গল রেজিমেন্টের গফুর বেলুচ (কমান্ডো), নায়েব সুবেদার আব্দুস সাত্তার (হারেস), হাবিলদার মতিন, নায়েখ নুরুল ইসলাম, সিপাহি কাসেম, বোরহান চৌধুরী, হাফিজুর রহমান মিন্টু, বিডি পোদ্দার, আব্দুল লতিফ, মহিউদ্দিন খান, আলাউদ্দিনসহ আরো অনেকেই পলায়নরত অবস্থাতেই পাকবাহিনী পিছন থেকে আক্রমণ করে। গুলিতে কয়েকজন পাকসেনা জখম হয়। মুক্তিবাহিনী পাকবাহিনীকে ঘেরাও করেছে এই সংবাদ যখন চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল সেদিন খাজুরিয়া বাজারে, নোয়খালী, রূপসা, কড়ইতলী, পাইকপাড়া, চান্দ্ররা, গাজীপুর, গল্লাক, বাসরা, ষোল্লা, রামগঞ্জ, হতে হাজার হাজার জনতা দা, কুড়াল, টেঠা (বর্শা), খাবর, বল্লম, লাঠিসহ বিভিন্ন ধরনের দেশী অস্ত্র নিয়ে পাকবাহিনীকে খতম করতে ছুটে আসে। সেদিন চাঁদপুর সাব সেক্টর-২, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনার অবতারণা হয়। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত বিপ্লবী গণপ্রতিরোধের অগ্নিশিখা আর কোন অঞ্চলে এভাবে জ্বলছে কি না জানা নেই। বিশেষ করে গ্রামের জনসাধারণের মাঝে এই জাগরণ ছিল একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। জনতা আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে শ্লোগান দিতে থাকে, নারায়ে তকবীর, আল্লাহু আকবার, জয় বাংলা, জয় বাঙ্গাল, এদিন পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে জন্তার মাঝে যে তেজ, যে ক্ষোভ, তীব্র আক্রোশ, ঘৃণা দেখা গেছে সত্যি তা উপলব্ধি করার বিষয়। সেদিনের এক গণ প্রতিরোধ যুদ্ধ থেকে প্রমাণিত হয়, ট্রেনিং এবং অস্ত্রই যুদ্ধের প্রধান নিয়ামক শক্তি নয়। জনগণ বাড়ি বাড়ি হতে শতশত ডাব নারিকেল এনে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাজুরিয়া বাজারে স্তুপ করে। মুক্তিযোদ্ধারা কমরেড প্লাটুন সহ দীঘির পাড়ে এবং স্থানীয় মাদ্রাসার বিশ্রাম নিচ্ছিল। এমন সময় ঝড়ের বেগে কোথা থেকে সাব-সেক্টর কমান্ডার জহিরুল হক পাঠান এসে হাজির। তাঁর সাথে কমরেড কলিমউল্লা ভূঁইয়া, জীবন কানাই চক্রবর্তী, আমির হোসেন (পারভেজ)। পাঠান সাহেব এসেই উর্দুতে বলে উঠলেন, বেগারতও তোম লোগ কিউ আপনা আপনা পজিশন ছোড়কে আয়া? দুশমনকা পিছ লেনেকিলিয়ে কোন বোলা? আপলোক লাড়নেকা আদমী নেহি। ইয়ে জাংগি তারিকা নেহি হায়। পাঠান সাহেব তাঁর যুদ্ধ কৌশল অনুযায়ী যা বললেন তা ঠিক। কারণ এইভাবে সব কিছু না জেনে দুশমনের পিছু দৌড়ালে মৃত্যু অনিবার্য। দুশমন একটু লুকিয়ে পিছনে দু-একবার ব্রাশ ফায়ার করলে হাজার হাজার জনতা শেষ হয়ে যেতে পারতো। পাঠানের গালি খেয়ে সবাই কিছুটা সতর্ক হলো। উন্নত সাজ-সরঞ্জাম। তারা ওয়ারলেস করে তাদের পশ্চাৎ বাহিনীর মাধ্যমে আরও সমস্যা তৈরী করতে পারতো। আসলে যতটা ভাবি ঠিক তা নয়। ইতিমধ্যে বাঙালিদের হাতে মার খেয়ে তাঁরাও অনেকটা কোনঠাসা হয়ে গেছে। পাঠান সাহেব রাগ করছিলেন। কারণ পাঠান ও কলিম উল্লা ভূঞা রাতেই খবর পেয়েছিলেন। পাকবাহিনী হেডকোয়ার্টারে ত্রি-মুখী আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে কারণে তাদের প্রতিহত করার জন্য ডিফেন্স এই ভাবে সাজানো হয়েছে। পাকবাহিনী তাদের পরিকল্পনা অনুসারে একটি গ্রুপ মুন্সিরহাট হয়ে ওয়াপদার রাস্তা দিয়ে গল্লাকের দিকে অগ্রসর হয়েছে। ১ নং প্লাটুন কমান্ডার সুবেদার হক ও ৩নং প্লাটুন কমান্ডার সুবেদার সিরাজুল হক এ খবর শুনে পজিশন ছেড়ে পিছনে চলে এসেছে। তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করে ডিফেন্স বসানোর জন্য। যা ছিল চাঁদপুর এরিয়া কমান্ডার সুবেদার জহিরুল হক পাঠানোর যুদ্ধ পরিকল্পনার পরিপন্থি। এখবর পাঠানের কাছে পৌঁছার সাথে সাথে সাথে পাঠান কলিমউল্লা ভূঁইয়াকে সাথে করে সেখানে ছুটে আসেন। এবং ১নং প্লাটুন সবাইকে পুনরায় যার যার পজিশনে ফিরে যেতে নির্দেশ দেন। ৩নং প্লাটুন অবশ্য ঠিক স্থানে রাস্তার ডান পাশে গল্লাক বাজারে একটু আগে ও বাজারে মাথায়। তিনি সবাইকে কড়া নির্দেশ দেন যদি কেউ যুদ্ধ ছেড়ে এক ইঞ্চি পিছনে আসলে পিছন থেকে গুলি করে সবাইকে মেরে ফেলা হবে। পাকবাহিনী তখন প্রায় কামতা বাজার পর্যন্ত চলে এসেছে। ১ নং প্লাটুনের তিনটি সেকশানকে পাঠানো হয় কমান্ডার সিরাজের নেতৃত্বে রাস্তার বাম ও ডান পাশে এবং কলিমউল্লা ভূঁইয়াকে রাস্তার উপর পজিশনে।
পাকবাহিনী বেশ দূরত্ব রেখে সিঙ্গেল লাইনে এগিয়ে আসছিল। এই অবস্থায় লোকজনও ডিফেন্স করে প্রস্তুত। যেই পাকবাহিনী ডান পাশের বাঁধের বাঁকা রাস্তা ছেড়ে সোজা লাইনে এসে পড়ল এবার তাদের দীর্ঘ সিঙ্গেল লাইন অনেকটা ওঁত পেতে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের রেঞ্জের ভিতর। সুবেদার পাঠান আক্রমণের সংকেত দেন। পূর্বের পরিকল্পনা অনুযায়ী পাঠান সাহেবই প্রথম গুলি ওপেন করেন। তাঁর সাথে সাথে বাকিরাও প্রচণ্ডভাবে আক্রমণ আরম্ভ করেন। এই অবস্থায় পাকহানাদারের দল যখন রাস্তার ডান পাশে সরে যায় তখন ডান পাশের অবস্থান থেকে সুবেদার সিরাজ আক্রমণ করেন। উভয় পক্ষে তুমুল লড়াই চলছে। এরি মধ্যে পাঠান সাহেব খাজুরিয়ার দিক থেকে স্পষ্ট গুলির শব্দ শুনতে পান। তিনি ভাবলেন তাঁর নির্দেশ মতই কমরেড গ্রুপ সেখানে পাকবাহিনীকে প্রতিহত করবে। এদিকে রাস্তার ওপর একটি সেকশান কলিম উল্লা ভূঁইয়ার নেতৃত্বে সোজা আক্রমণ চালায়। ত্রি-মুখী আক্রমণের সামনে পাকবাহিনী অনেকটাই কোন ঠাসা হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। প্রায় এক ঘন্টা উভয় পক্ষে লড়াই চলে। যুদ্ধে প্রায় ৭/৮ জন পাকসেনা নিহত ও বহু হতাহত হয়। পাকবাহিনী মুন্সির হাট এসে নিহত এবং আহত পাকসেনাদের লঞ্চে করে চাঁদপুর পাঠিয়ে দেয়। বাকীরা হাজিগঞ্জে চলে যায়।
[৫০] রিয়াজ আহমেদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত