You dont have javascript enabled! Please enable it!

খাদিম হোসেন রাজা, মেজর জেনারেল
[অংশগ্রহণকারীর বিবরণ]

পাকিস্তানি বাহিনী হেমু থেকে পরাস্ত হয়ে বিভিন্ন রাস্তায় সিলেট থেকে ৮ কি.মি দূরে খাদিম নগরে তাদের শেষ আস্তানায় উপনীত হয়। আমরা হেমু আক্রমণের পর পায়ে হেঁটে সিলেটের উদ্দেশ্যে চিকনাগুল থেকে পাহাড়ি দুর্গম পথে বর্তমান জালালাবাদ সেনানিবাসে পেছন দিয়ে রাবার বাগান হয়ে খাদিম নগর চা বাগানের পৌছি। এ সময়টা ছিল ডিসেম্বর ১৯৭১-এর ১২ তারিখ থেকে ১৫ তারিখের মধ্যে। রাস্তায় পীরের বাজার ও পরগানা বাজারের পাক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আমরা গুঁড়িয়ে দেই। চিকনাগুলে আমাদের সঙ্গে থাকা ক্যাপ্টেন এস ডি সিং ও ক্যাপ্টেন হেগডে আর্টিলারি গোলায় মারাত্মক আহত হন, সঙ্গে আমার সঙ্গের মুক্তিযোদ্ধা হাশেম শহীদ হয়। এখানে ইপিআরের কয়েকজন সঙ্গী আহত ও শহীদ হন। অনেক মুক্তিযোদ্ধা এসকল আক্রমণে আহত হন। তবু চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য সবাই মরণপণ যুদ্ধে হাসিমুখে প্রস্তুত। প্রতিনিয়ত মুক্তাঞ্চল থেকে আমরা পাক বাহিনীর গণহত্যা, নিপীড়ণ ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের বিবরণ পেতে থাকি। যা সকলের বজ্র কঠিন শপথ নিতে সাহায্য করে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার জন্য।
চিকনাগুল চা বাগানের পিছনে আমরা একটা চমকপ্রদ ঘটনার সম্মুখীন হই। একজন পাকিস্তানী সৈন্য হঠাৎ দু’হাত উঁচু করে অনেক দূর থেকে আমাদের দিকে আসতে থাকে। আমাদের সহযোদ্ধারা তাকে আত্মসমর্পণ করায়। আমাদের প্রশ্নের উত্তরে সে বলে, ম্যয়ে রং রুট হ্যায় (অর্থাৎ আমি রিক্রুট সৈন্য), হাম-পাঞ্জাবকা রেহেনেওয়ালা হ্যায় (অর্থাৎ আমি পাঞ্জাবের অধিবাসী)। যাক, প্রাথমিক অনুসন্ধানে তাঁর কাছে কিছু তথ্য পাওয়া গেল। তাঁকে পেছনে পাঠিয়ে দেয়া হল যুদ্ধবন্দি হিসেবে। এভাবে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আমরা ১৬ ডিসেম্বর ভোর প্রায় ৫টায় খাদিমনগর চা বাগানে পৌছি। এতো ভোর বেলা ম্যানেজারের বাংলোর সামনে অকস্মাৎ বাগানের ম্যানেজার ইউরোপিয়ান সাহেব (যুক্তরাজ্যের অধিবাসী) মিত্র ও মুক্তিবাহিনী দেখে ভীষণ ঘাবড়ে গেলেন। আমি উনাকে প্রচুর সাহস দিলাম, কারণ যে কোনো চেঁচামেচিতে আমাদের উপস্থিতি প্রকাশ হয়ে পড়বে। ইংরেজিতে কথা বলার সুবিধা পাওয়া গেল। তিনি আশ্বস্ত হয়ে আমাদের বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সহায়তা করেন। মাত্র ৫০০ মিটার দূরে পাক প্রতিরক্ষা স্থান। যাক, আমরা চূড়ান্ত আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিলাম। আমাদীএর ২টি কোম্পানি পাক অবস্থানে আঘাত হানবে। সামনে সিলেট শহর। এ বাঁধা অতিক্রম করলে আমরা সিলেট শহরে প্রবেশ করতে পারব চূড়ান্ত বিজয়ের লক্ষ্যে। আমাদের এসল্ট লাইন ছিল বাগানের সামনের কাঁচা রাস্তা, যা খাদিমনগর-বড়জান চা বাগান রাস্তা নামে পরিচিত। সকলে প্রস্তুত। ইত্যবসরে একটা মজার ঘটনা ঘটলো। আমাদের গুর্খা কোম্পানির সিনিয়র জেসিও সুবেদার মেজর থাপ্পা সবাইকে উৎসাহ দিতে গিয়ে হঠাৎ কেঁদে ফেললো। আমাকে যা বললো হিন্দিতে, তাঁর বআংলা অনুবাদ মোটা মুটি এরুপঃ সাহেব, গত ৬ ডিসেম্বর ছিল আমার অবসরের দিন। শুধু বাংলাদেশের যুদ্ধের কারণে আজও আমি চাকুরি করছি। যদি আমার কিছু হয় তবে আমার পরিবারকে দেখার কেউ থাকবে না। সে আমার কাছে এসে এক কাপ রাম নিয়ে বলল, সাহেব যুদ্ধের পূর্বে এটা পান করুন, প্রচুর সাহস পাবেন। আমি প্রত্যাখান করায় সে একটু বেশিই অবাক হলো। যাক শুরু হলো মরণপন যুদ্ধ। শত্রুর আশপাশেই স্থানীয় অনেক আবাস্থল ও হজরত শাহ্‌ ফারহানের (সিলেটিরা বলে শাহপরাণ) মাজার। তাই আমরা কোনো আর্টিলারি ফায়ার সাপোর্ট ছাড়াই আক্রমণ শুরু করলাম। পাক বাহিনী তাদের শেষ মরণ কামর দিল কিন্ত হঠাৎ আক্রমণে ও প্রথম ২/৩টি বাংকার দখল করার পর তারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করল। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বিভিন্ন প্রকার গাড়িতে করে তারা সব কিছু ফেলে প্রাণ নিয়ে পালাতে থাকল। এক বাংকারে এক মৃত পাঞ্জাবি হাবিলদার ও তাঁর সঙ্গের ২ জন মৃত সৈন্যসহ প্রচুর অশ্ত্রশস্ত্র আমাদের একজন সহযোদ্ধাকে পাহারায় রেখে আমরা সামনে এগুতে লাগলাম। খাদিমনগর চা বাগান ও সিলেত-তামাবিল রাস্তার সংযোগস্থলে এসে আমাদের আক্রমণ শেষ হলও। কয়েক জন সৈন্য আহত হলো, সঙ্গে আমার ৫ জন মুক্তিযোদ্ধাও আহত হন। মাত্র ৩/৪ কি.মি. দূরে এমসি কলেজ, সেখানে পাক আর্মির জড়ো হওয়ার সংবাদ পেলাম। চারিদিক থেকে অনেক স্থানীয় অধিবাসী আমাদেরকে অভিনন্দন জানাতে আসলেন। কেউ কেউ নিজ বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে উৎসুক নয়নে আমাদেরকে দেখলো এবং হাত নেড়ে অভিনন্দন জানালো। ততক্ষণে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা বীরদর্পে প্রায় প্রত্যেক বাড়ির সামনে উড়ছিল।
[৪১] জয়ন্ত কুমার সেন

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!