কেউন্দিয়ার যুদ্ধ-১, বরিশাল
যারা এতদিন বাঁশের লাঠি দিয়ে যুদ্ধ করেছে তারা আজ পেয়েছে ৩০৩ রাইফেল। কাউখালী থানা লুটের রাইফেল। রাইফেল হাতে নিয়ে গোপনে এই মুক্তিযোদ্ধার দল আশ্রয় নিয়েছে সেঁওতা গরঙ্গল গ্রামে। এখানে তাদের হাইড আউট। কিছুদিন আগেই মোক্তাদিরুল ইসলাম বেলাল, সাফায়েত, মিন্টু, নসু, নুরুল আমিন ও অন্যদের পাকসেনারা গুলি করে মেরেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের এদের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তারা সুযোগ খুঁজতে থাকে পাকসেনাদের আক্রমণ করার জন্য। কাউখালী থানা থেকে পুলিশ ও রাজাকারের দল প্রায়ই কেউন্দিয়া গ্রামে আসে। এলাকার দালালদের সহযোগিতায় তারা গ্রামের বাড়ি-বাড়ি সার্চ করে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরার জন্য। এটা খানসেনাদের এক রুটিন কার্যক্রম এবং খবরাখবর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে নিয়মিত পৌঁছে দেয়। এইভাবে এই কিশোর বাহিনী পুরো এলাকা জুড়ে একটা সুন্দর কার্যকরী গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। তারা ইনফরমার হিসেবে কাজ করে পাকসেনাদের দৈনন্দিন গতিবিধির সংবাদ মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করে। তাদের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক এত কার্যকরী ছিল যে, কাউখালী থানা বা সেনাক্যাম্প থেকে অপারেশনে বের হওয়া মাত্র তারা কাউখালীর ইনফর্মার দ্বারা সংবাদ পেত এবং সেটা তড়িৎ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে পৌঁছে দিত। পুলিশ, রাজকার ও পাকসেনাদের তৎপরতা সংগ্রহ করতে গিয়ে একদিন দালালদের চোখে পড়ে যায় কচুয়া কাঠীর আযাদ পুলিশও চলে আসে তড়িৎগতিতে। কিন্তু আযাদ পালাতে চেষ্টা করা মাত্রই পুলিশ গুলি ছোড়ে, আযাদ পড়ে যায় মাটিতে, থানার ওসি নির্মমভাবে আযাদকে হত্যা করে। তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা অধিক সতর্কতা অবলম্বন করতে থাকে। ওরা দিনেরবেলা বের না হয়ে রাতের আঁধারে দালালদের গতিবিধি সম্পর্কে তথ্য নিতে শুরু করে দেয়। তাদের কাছ থেকে যখন মুক্তিযোদ্ধারা সংবাদ পেল যে, প্রাইয় পুলিশ ও রাজাকারদের দল গ্রামে আসে এবং গ্রামে অপারেশন করার আগে রুটিন মাফিক কেউন্দিয়া স্কুলের মাঠে সমবেত হয়। এই খবর জানতে পেরে পনা, নান্না এবং অন্যান্যরা প্লান করে যে, তারা স্কুলের সামনে এ্যাম্বুশ করে পুলিশদের আক্রমণ করবে। একদিন সুযোগ এসে যায়। জুন মাসের মাঝামাঝি। কাউখালী থাকা থেকে পুলিশ ও রাজাকারের দল যখন অপারেশনের জন্য তৈরি হচ্ছে, তখনই কিশোর গোয়েন্দা দল সংবাদ পেয়ে যায়। তারা সুপারি বাগান ও জঙ্গলের ভিতর দিয়ে নিজেদেরকে আত্মগোপন করে তড়িৎ সংবাদটা আবদুল হাই পনা, দুলাল, নান্নার দলকে সরবরাহ করে। মুক্তিযোদ্ধার দলটি তো এই সংবাদের অপেক্ষাতেই ছিল। তারা সকলেই যার যা অস্ত্র আছে তাই নিয়ে ঘন জঙ্গল ও সুপারি বাগানের ভিতর দিয়ে গোপন রাস্তা ধরে স্কুলের সামনে খালের অপর পাড়ে পজিশন নেয়। কেউনিদ্যা স্কুলের সামনে দিয়ে চলে গেছে একটি খাল গ্রামের ভিতর এঁকেবেঁকে। খালের অপর পাড় ঘন সুপারি বাগান ও জঙ্গলে ঘেরা। এই এলাকার খালে জোয়ার-ভাটার খেলা চলে। খালের পাড়ে ঠিক স্কুল বরাবর বাঁধা ছিল একটি বড় নৌকা। নৌকার মালিক ছিল আহমদ মৃধা। একজন অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক। এই নৌকাটি বেশ বড়। নৌকায় করে মৃধা কাঠের আমদানি-রফতানি ব্যবসা করত। বর্তমানে মৃধার ব্যবসা ছেড়ে যোগ দেয় মুক্তিযুদ্ধে। এই নৌকাকে আড় করে মুক্তিযোদ্ধারা পজিশন নিয়ে এ্যাম্বুশ পেতে বসে থাকে। এখন শুধু শত্রুর অপেক্ষা। জুন মাসের সকাল। সূর্য উঠেছে প্রচণ্ড তেজ নিয়ে সুপারি গাছের ফাঁক গলে সূর্যের আলো পড়েছে সর্বত্র। সামনের বাজারের দোকানপাট বন্ধ। তারাও পাকসেনা ও পুলিশদের আগমনের সংবাদ পেয়েছে। বেলা প্রায় দশটা। পুলিশ ও রাজাকারের দল ধীর গতিতে এগিয়ে আসছে। এক সময় পুলিশের দলটি বাজারের ভিতরে এসে পড়ল। মুক্তিযোদ্ধারা অপেক্ষা করছে। আসুক ওরা রাইফেলের ফায়ারিং রেঞ্জের মধ্যে। ধীরে ধীরে শত্রুর দলটি এসে দাঁড়াল স্কুলের সামনের রাস্তার উপরে। এদিকে তখন জোয়ারের সময়। খালের পানি বেড়ে গিয়ে যে নৌকার আড়ালে মুক্তিযোদ্ধারা পজিশন নিয়েছিল সেই নৌকা আরো উঁচুতে ভেসে উঠে দুই পক্ষের মধ্যে আড়ালের সৃষ্টি করল। এমনি আড়াল, যে ফায়ার করা যায় না শত্রুর উপরে। বাধ্য হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা প্রথমে গ্রেনেড মারল নৌকার উপরে। প্রচণ্ড শব্দে, আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে গ্রেনেড ফাটল। উড়ে গেল নৌকা তার ছই সহ। পুলিশের দল প্রথমে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা আর দেরি করল না। সঙ্গে সঙ্গে শুরু করল বৃষ্টির মত ফায়ার। মুক্তিযোদ্ধাদের এই প্রথম অস্ত্র হাতে শত্রুর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধ। মূহর্মুহ ফায়ার করে চলেছে তারা। পুলিশের দলটি কোনোমতেই পজিশনে যেতে পারল না এবং একটি ফায়ারও করতে পারল না তার আগেই ধরাশায়ী হলো তারা। পুলিশের দলের সদস্যরা গুলি খাওয়া ঘুঘু পাখির মতো টপটপ করে মাটিতে পড়তে লাগল। তাদের মরণ চিৎকারে আকাশ বাতাস বিদীর্ণ হলো। গুলির তীব্রতায় টিকতে না পেরে পুলিশ ও রাজাকারের দল ছত্রভঙ্গ হয়ে স্কুলের পিছনে গ্রামের ভিতরে দৌড় দিল। পুলিশদের ছত্রভঙ্গ হতে দেখে মুক্তিযোদ্ধারা “জয় বাংলা” শ্লোগানে আকাশ বাতাস মাতিয়ে দিল। পুলিশদের এই দুর্দশা ও মুক্তিযোদ্ধাদের শ্লোগান শুনে গ্রামের লোকজন চারদিক থেকে “জয়বাংলা” শ্লোগান দিতে দিতে ছত্রভাঙ্গা পুলিশদের ধাওয়া শুরু করল এবং তাদের ঘিরে ধরল। কবির জমাদ্দার একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা। তার হাতে তখনো রাইফেল আসেনি। সে অস্ত্র পায়নি কারণ সকলকে দেবার মতো অস্ত্র ছিল না। কাউখালী থানা লুঠ করার সময় ব্যবহৃত সেই কালো বাঁশের লাঠিটি তার হাতে। বনবন করে লাঠি ঘুরিয়ে কবির জমাদ্দার ধাওয়া করল এক পুলিশকে। দুলালদের বাড়ির পুকুর পাড়েই পেয়ে গেল তারে। পুলিশটি রাইফেল চালানোর আগেই খটাশ করে কবিরের লাঠির আঘাত লাগল তার মাথায়। মাথা ফেটে ঝরছে রক্ত। মাটিতে লুটে পড়ার আগেই আরো লাঠির বাড়ি এসে লাগল তার দেহে। এবার লুটে পড়ল সে মাটিতে। কবির জমাদ্দারের রোখ যেন চেপে গেছে। সে জানে কেমন নির্দুয়ভাবে গ্রামের ছেলেদের এরা গুলি করেছে। এই কথা মনে হতেই মাথায় রক্ত উঠে গেল কবিরের। সে লাথি দিয়ে পিটিয়েই মেরে ফেললো পুলিশটিকে। এদিকে গ্রামের লোকজন দা, কুড়াল, লাঠি দিয়ে এবং যার যা ছিল তাই নিয়ে আক্রমণ করল শত্রুদের। চারদিকে শুধু আর্তনাদ আর গোঙানির শব্দ। এই দলের সাতেহ ছিল পুলিশের একজন অ্যাসিসটেন্ট সাব-ইন্সপেক্টর। এই ইনেসপেক্টর এই গ্রামে প্রথম অপারেশনে এসেছিল এবং নির্দয়ভাবে গুলি করে মেরছিল গ্রামের তরতাজা যুবক বেলালকে এবং সাফায়েতকে। এই নরপশুকে পেয়ে গ্রামবাসীরা জিদের বশে কুপিয়েই তাঁকে মেরে ফেলে। সাথে মরল এক দালাল। আক্রমণ যখন শেষ হলো তখন দেখা গেল মোট ১২ জন পুলিশকে মুক্তিযোদ্ধারা গুলি করে মেরেছে। আহত হয়েছে অনেক। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে আহত হলো মোফাজ্জেল আলী জমাদ্দার, আবদুর রব খান ও আনু মিস্ত্রি।
[১৪৭] হামিদুল হোসেন তারেক
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত