You dont have javascript enabled! Please enable it!

কুষ্টিয়ার যুদ্ধ-২

উত্তরে পদ্মা নদী, পুর্বদিকে গড়াই নদী দ্বারা বেষ্টিত কুষ্টিয়ার সমতলভূমি। ভৌগোলিক দিক থেকে কুষ্টিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। এ কারণে পাকসেনারা যুদ্ধের শুরুতেই তা দখল করে নেয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনালগ্নে বিভিন্ন সেনানিবাস এবং সশস্ত্র বাহিনীর অবস্থানভিক্তিক যে সমস্ত প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল, ‘কুষ্টিয়া যুদ্ধ’ তন্মদ্ধে অন্যতম। ১৯৭১-এর ৩০ মার্চ থেকে ১ এপ্রিল পর্যন্ত সংঘটিত এই যুদ্ধে পাকিস্তানী ২৭ বেলুচ রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়। ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস)-এর ৪নং উইং ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী জনতার সম্মিলিত বাহিনী পাকবাহিনীর গৌরব ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। বর্তমান বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ভারত সীমান্তবর্তী জেলা শহর কুষ্টিয়া একটি আদর্শ যোগাযোগ কেন্দ্র। এই জেলার সাথে দক্ষিণ-পশ্চিমে ভারতের নদীয়া, কৃষ্ণনগর প্রভৃতি এলাকা এবং পূর্বে ঝিনাইদহের হয়ে ফরিদপুর পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগ বিদ্যামান। উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এখান থেকে ২৫ কিলোমিটার উত্তরে এবং দক্ষিণাঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ সেনা ছাউনি যশোর সেনানিবাস এখা থেকে ৭১ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। এ সকল বিষয় বিবেচনা করলে কুষ্টিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। কুষ্টিয়া শহর হানাদারমুক্ত করার লক্ষ্যে ইপিআর ৪নং উইং-এর অধিনায়ক মেজর আবু ওসমান চৌধুরী ২৬ মার্চ থেকেই ব্যাপক গণসংযোগ শুরু করেন। ইপিআর ও মুক্তিকামী জনতার সমন্বয়ে স্বল্প সময়ে একটি বিশাল বাহিনী গড়ে ওঠে। ২৭ মার্চ বিকালে এই বাহিনীর প্রধান মেজর আবু ওসমান চৌধুরী কুষ্টিয়া পুনর্দখলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাঁর পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য ছিল ইপিআর ও জনতার সম্মিলিত বাহিনীর দ্বারা একই সাথে তিন দিক থেকে আক্রমণ করে পাকবাহিনীকে পর্যুদস্ত করা। ইপিআর বাহিনীর দায়িত্ব ছিল সরাসরি পাকবাহিনীর অবস্থান আক্রমণ করা, আর জনগণের দায়িত্ব ছিল আক্রমণের সময় রনহুঙ্কার দিয়ে পাকবাহিনীর মনবল ধ্বংস করা। কুষ্টিয়া শহর হানাদারমুক্ত করার লক্ষ্যে মেজর আবু ওসমান চৌধুরী তাঁর বাহিনীর বিভিন্ন দলকে নিন্মরূপ দায়িত্ব প্রদান করেনঃ
ক. ‘এ’ কোম্পানিঃ প্রাগপুরে অবস্থানরত এ কোম্পানি নেতৃত্বে ছিলেন সুবেদার মোজাফফর। প্রাগপুর ভেড়ামারার ২৪ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত একটি বিওপি। এই কোম্পানির দায়িত্ব ছিল ২৮ মার্চ ১২টার পূর্বে ভেড়ামারা হয়ে কুষ্টিয়া পৌঁছে শহরের উপকণ্ঠে প্রাথমিক অবস্থান নেয়া এবং পরবর্তীতে পশ্চিম দিক থেকে পুলিশ লাইন অবস্থানে আক্রমণ করা।
খ. ‘বি’ কোম্পানিঃ এই কোম্পানিটি ধোপাখালীতে অবস্থান করেছিল। ধোপাখালী একটি বিওপি, যা জীবননগর থেকে আনুমানিক ৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। এই কোম্পানির দায়িত্ব ছিল চুয়াডাঙ্গা-পোড়াদেহ কাঁচা রাস্তা ধরে যাত্রা করে কুষ্টিয়া এবং ওয়্যারলেস স্টেশনে অবস্থানরত পাকসেনাদের পশ্চিম দিক থেকে আক্রমণ করা। এই কোম্পানির অধিনায়ক ছিলেন সুবেদার খায়রুল বাশার।
গ. ‘সি’ কোম্পানিঃ বৈদ্যানাথতলায় (বর্তমান নাম মুজিবনগর) অবস্থানরত এই কোম্পানিটির দায়িত্ব ছিল চুয়াডাঙ্গা-পোড়াদহ কাঁচা রাস্তা ধরে কুষ্টিয়া পৌঁছা এবং পাকবাহিনীর জেলা স্কুল অবস্থানে দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ করা। এই কোম্পানির অধিনায়ক ছিলেন সুবেদার মুকিদ। তবে আক্রমণে এই কোম্পানির নেতৃত্ব দেন ব্যাটালিয়ন উপ-অধিনায়ক ক্যাপ্টেন এর আর আযম চৌধুরী।
ঘ. ‘ডি’ কোম্পানিঃ এই কোম্পানির দায়িত্ব ছিল প্লাটুনসহ কোটাচাঁদপুর ও কালিগঞ্জে প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়ে কোটচাঁদপুর, কালিগঞ্জ ও দত্তনগরে শত্রুর ক্ষুদ্র দলে অনুপ্রবেশ প্রতিহত করা। এই কোম্পানির অধিনায়ক ছিলেন সুবেদার মজিদ মোল্লা। তবে কালিগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিক অধিনায়কত্ব করেন ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুব উদ্দিন আহমদ।
ঙ. ‘ই’ কোম্পানিঃ এই কোম্পানির দায়িত্ব ছিল প্রথমত ঝিনাইদহ-যশোর সড়ক অবরোধের মাধ্যমে যশোর-কুষ্টিয়া সড়ক যোগাযোগবিচ্ছিন্ন করে যশোর সেনানিবাস থেকে কুষ্টিয়ায় রিইনফোর্সমেন্ট বন্ধ করা। দ্বিতীয়ত, একটি দল বিষখালীতে মোতায়েন করে চুয়াডাঙ্গা ইপিআর সদর দপ্তর রক্ষা করা। এই কোম্পানির অধিনায়ক ছিলেন সুবেদার রাজ্জাক। ঝিনাইদহে মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিক অধিনায়কত্ব করে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের অধ্যাপক জনাব শফিক উল্লাহ।
চ. জনতার দলঃ মেজর ওসমান কুষ্টিয়া আক্রমণে আক্রমণকারী প্রত্যেক ইপিআর কোম্পানির পেছনে বাঁশের লাঠি সজ্জিত কমপক্ষে ৫ হাজার জনতার সমাবেশ করার দায়িত্ব ডা. আসহাবের ওপর ন্যস্ত করেন।
ছ. সিগন্যাল যোগাযোগঃ পর্যাপ্ত ওয়্যারলেস ও ফিল্ড টেলিফোন না থাকায় টেলিফোন বিভাগের সাহায্যে পোড়াদহের খোলা প্রান্তরে ফিল্ড এক্সচেঞ্জ স্থাপন করা হয়। ফলে কুষ্টিয়া রণাঙ্গনের সাথে চুয়াডাঙ্গা ইপিআরের যোগাযোগ ও সমন্বয় সহজ হয়ে ওঠে। এ ছাড়া কুষ্টিয়ার সাথে বহির্বিশ্বের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে পোড়াদেহের সাথে সরাসরি আন্তর্জাতিক যোগাযোগ স্থাপন করা হয়।
জ. মেডিকেল দলঃ ডা. কোরেশী, ডা. করিম, ডা. সাইদুর রহমান ও ডা. আসহাবুল হকের সমন্বয়ে মেডিকেল দল গঠিত হয়। এ দলের দায়িত্ব ছিল রণাঙ্গনে ওষুধ সরবরাহ ও চিকিৎসা প্রদান করা।
ঝ. খাদ্য সরবরাহঃ ডা. আসহাবুল হকের নেতৃত্বে গঠিত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে যুদ্ধক্ষেত্রে খাদ্য সরবরাহের দায়িত্ব দেয়া হয়। আক্রমণের সময় (এইচ আওয়ার) প্রাথমিকভাবে ২৯ মার্চ ৪টায় এইচ আওয়ার নির্ধারণ করা হয়। কিতু ‘এ’ কোম্পানির একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় পতিত হলে কোম্পানিটি কুষ্টিয়াতে পৌঁছাতে দেরি করে। ফলে আক্রমণের সময় ২৪ ঘন্টা পিছিয়ে ৩০ মার্চ ৪টায় নির্ধারণ করা হয়। পাকসেনারা মূলত প্রতিরক্ষা মনোভাব নিয়ে শুধুমাত্র শহর এলাকাতে ৩-৪টি ক্যাম্প করে কুষ্টিয়াকে প্রতিরক্ষা করার চেষ্টা করে। এরা সাধারণত ডোমিনেশন টহল ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রতিরোধমূলক পাল্টা হামলা ধরনের যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। ৩০ মার্চ বিকেল ৪টায় ক্যাপ্টেন আযম চৌধুরী সার্বিক তত্ত্বাবধানে ত্রিমুখী আক্রমণ শুরু হয়। ‘এ’ কোম্পানির প্লাটুন নায়েব সুবেদার মতিন পাটোয়ারির নেতৃত্বে পুলিশ লাইনের ওপর আক্রমণ করে। এর কিছুক্ষণ পরই মেহেরপুর থেকে এক কোম্পানি আনসার ও এক কোম্পানি মুজাহিদ যোগ দেয়। উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল গোলাগুলি শুরু হয়। সারা দিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ঘাটে দুপুর দেড়টার দিকে। এই সময় হাজীবাড়ি ধ্বংস করার জন্য শত্রু ট্যাঙ্কবিধ্বংসী ১০৬ মি.মি. আরআর হাজীবাড়ির দিকে তাক করে। নায়েব সুবেদার মতিন একই সঙ্গে ১টি আর আর, ৩টি এলএমজি এবং ২ইঞ্চি মর্টারের গোলা নিক্ষেপ করে দখলদার বাহিনীর অস্ত্রটি ধ্বংস করে। এদিকে একই সময় ‘বি’ কোম্পানির নায়েব সুবেদার মনিরুজ্জামান পশ্চিম দিক থেকে জিলা স্কুলের ওপর আক্রমণ করে। এই ত্রিমুখী আক্রমণ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী হাজার হাজার যোদ্ধার চিৎকার পাকসেনারা হতভম্ব হয়ে পড়ে। ৩০ মার্চ বিকেল নাগাদ জিলা স্কুল ছাড়া অন্য ২টি শত্রু অবস্থানের (পুলিশ লাইন ও স্টেশন) পতন ঘটে। পুলিশ লাইন এবং ওয়্যারলেস স্টেশনের অধিকাংশ শত্রুসেনা নিহত হয়। অবশিষ্টরা জিলা স্কুলে সমবেত হওয়ার চেষ্টা করে। যুদ্ধের এ পর্যায়ে শত্রু দল অসহায় ও অক্ষম হয়ে পড়ে। অতিরিক্ত জনবল ছাড়া তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন অনুধাবন করে কুষ্টিয়ার পাকিস্তানী কমান্ডারবৃন্দ ওয়্যারলেসের মাধ্যমে যশোর সেনানিবাসের সাহায্য কামনা করে। কিন্তু যশোর সেনানিবাস থেকে সাহায্য প্রদানে অপরাগতা জানানো হয়। বলা হয় ‘ Reinforcement not possible. Try to live on your own’ বার্তাটি মুক্তিযোদ্ধাদের ওয়্যারলেসে ধরা পড়ে। ৩১ মার্চ ভোরবেলা ক্যাপ্টেন আযম চৌধুরী পুনরায় জিলা স্কুল আক্রমণ করেন। পাকসেনারা ভারী অস্ত্রের সাহায্যে পাল্টা জবাব দেয়। সারা দিনের আক্রমণে প্রচুর পাকসেনা হতাহত হয়। সন্ধ্যায় দিকে পাকবাহিনীর পাল্টা আক্রমণের তীব্রতা কমে আসে। জিল স্কুল এলাকায় আক্রমণের তীব্রতা কমিয়ে নিষ্কিয় হওয়ার ভান করে। এই সুযোগে সূর্যাস্তের পর অফিসারসহ অবশিষ্ট ৪০-৫০ জন পাকিস্তানী সেনা ২টি জিপ ও ২ টি পিকআপে করে পালানোর চেষ্টা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল তৎক্ষণাৎ তাদের পশ্চাৎগমন করে। পাকিস্তানী এই দলটি ঝিনাইদহের নিকটবর্তী গাড়াগঞ্জ ব্রিজে মুক্তিবাহিনীর পেতে রাখা অ্যাম্বুশে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধারা গাড়াগঞ্জ সেতুটি ধ্বংস করে সেখানে আলকাতরা মাখানো বাঁশের চাটাই বিছিয়ে অনতিদূরে ওঁৎ পেতে বসেছিল। রাতের আঁধারে পিচঢালা পথ মনে করে সেতুর উপর ওঠা মাত্রই প্রথম গাড়িটি নিচে পড়ে যায়। অন্য গাড়িগুলোও দুর্ঘটনায় পতিত হয়। মেজর শোয়েবসহ বেশ কিছু পাকসেনা ঘটনাস্থলে নিহত হয়। অন্যরা পালিয়ে যাওয়ার সময় গ্রামবাসী ও মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়। লে. আতাউল্লাহ শাহ্‌ ও সুবেদার আইয়ুব আহত অবস্থায় গ্রামবাসীদের হাতে ধরা পড়ে। ১ এপ্রিল কুষ্টিয়া শত্রুমুক্ত হয়।
[৫৭] তাজুল মোহাম্মদ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!