কোটচাদপুর থানায় অ্যাম্বুশ, যশোর
মহেশপুর ও পার্শ্ববর্তী প্রায় দু’কিলোমিটার এলাকায় টেলিফোন যোগাযোগের তাঁর কেটে দ্রুততার সাথে সবাই মুক্তাঞ্চলে চলে আসে মুক্তিবাহিনী। পথে হুশুরখালী নামক গ্রামের প্রান্তে বয়ে যাওয়া খরস্রোতা খালের মুক্তাঞ্চলে সীমানায় নৌকা রেখে শুয়ে পরে সবাই। ক্লান্তিতে ঘুম চলে আসে। ভোর হয়ে আসছে তখন। হঠাৎ খালের অপর প্রান্ত থেকে একজনের চিৎকারে সবার ঘুম ভেঙ্গে যায়। এক বিধ্বস্ত যুবক। পারাপারের জন্য ডাকছে। কোন কিছু না ভেবে তাঁকে সাহায্যের জন্য নৌকা নিয়ে এগিয়ে যায়। কাছাকাছি যেতেই হঠাৎ এস এল আর তাক করে ‘হ্যান্ডস আপ’ বলে চিৎকার দিয়ে ওঠে অজ্ঞাত সেই যুবক। হতভম্ব সবাই। তখনও সকালের ঘুমের ঘোর কাটেনি। দু’একজন ঘুমাচ্ছিলও। জুবকের অপর ঝাঁপিয়ে পড়ার পূর্ব মূহূর্তে সে তাঁর পরিচয় দেয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা। সেম সাইড হয়ে যাচ্ছিল একটু হলে। হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে তরুণ যোদ্ধা। কারণ জিজ্ঞাসায় সে নৌকায় বসে ভয়ংকর এক ঘটনার কথা শোনায়। কোটচাঁদপুর থানায় সফদারপুর নামক স্থানে এক ব্যক্তির বাড়িতে এক সেকশন মুক্তিযোদ্ধা বিশেষ উদ্দেশ্যে অবস্থান নিয়েছিল। ওরা বুঝতে পারেনি বাড়িওয়ালা পিস কমিটির সদস্য। মুক্তিযোদ্ধারা খবর পেয়েছিল যশোর থেকে একটি বিশেষ ট্রেনে এক কোম্পানি খান সেনা উত্তরবঙ্গে যাবে। মাইন দিয়ে পুরো ট্রেনটি উড়িয়ে দেয়ার এক দুঃসাহসিক পরিকল্পনা করে বীর যোদ্ধারা। অপারেশন সফল করার লক্ষ্য নিয়ে একদিন আগেই চলে আসবে ঘটনাস্থলের কাছা কাছি। ট্রেন লাইনটির পাশে আশ্রয় নেয় অপরিচিত এক বাড়িতে। বাড়ির মাইল কিছু বুঝতে না দিয়ে জামাই আদরে থাকতে দেয় দলটি। অপারেশন দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত গোপনে ভুরিভোজ দেয় বাড়িওয়ালা। এক ফাঁকে একজন যোদ্ধাকে নিয়ে ট্রেন লাইনের সিগন্যালের কাছে গিয়ে মাইন পোঁতার স্থানও নির্ধারণ করে আসে আশ্রয়দাতা। এ সুযোগে তারা সফদারপুর রেলস্টেশন ঘুরে আসে। বিশেষ ট্রেনটির সময় জেনে নেয় মুক্তিযোদ্ধারা। পরিকল্পনা মোতাবেক আউটার সিগন্যাল ট্রেনটি থামানো হবে। পূর্ব থেকে পেতে রাখা মাইনের বিস্ফোরণ ঘটানো হবে সাথে সাথে। তারপর অ্যামবুশে থাকা যোদ্ধারা ঝাঁপিয়ে পড়বে আক্রন্ত ট্রেনের খান সেনাদের ওপর। সবকিছু জেনে গোপনে বাড়িওয়ালা বিস্তারিত তথ্য পাঠায় নিকটবর্তী কোটচাঁদপুর আর্মি ক্যাম্পে। খবর পেয়ে হায়েনার মত ছুটে আসে হানাদাররা সাথে রাজাকারের দল। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত ঘনিয়ে আসে। হায়নার দল সন্তর্পণে ঘিরে ফেলে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল। ওৎ পেতে থাকে শিকারীয় ন্যায়। মুক্তিযোদ্ধারাও উদগ্রীব হয়ে আছে আক্রমণের নেশায়। ঘড়ির কাঁটা রাত বারোটা বাজার সংকেত ধ্বনী দেয়। মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশন বেরি যাবার মুহূর্তে হানাদারদের চাইনিজ এল এম জি’র ব্রাশ ফায়ারে লুটিয়ে পড়ে অর্ধেক যোদ্ধা। আহত হয় অন্যরা। উপর্যুপরি গুলি চলতে থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর। এক সময় আশ্রয় নেয়া মাটির দেয়ালের ঘরটি ভেঙে পড়ে। আহত হয়েও মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণপণ যুদ্ধ করে। শেষ মুহূর্তে পালাতে পারে মাত্র একজন। আসার সময় বিশ্বাসঘাতক বাড়িওয়ালাকে শেষ গুলিটি করে কিছুটা প্রতিশোধ নেয় বীর যোদ্ধা।
সব শুনে মন ভীষণ খারাপ হয়ে যায় সবার। তাকে ক্যাম্পে যেতে অনুরোধ করে সবাই। বিনয়ের সাথে বিদায় নেয় সে। তাড়াতাড়ি নতুন একটি দল নিয়ে প্রতিশোধ নিতে ফিরতে হবে। এস এল আর কাঁধে নিয়ে বীর যোদ্ধা চলে যায় গ্রামের কাদা মাখা পথ ধরে।
[৫৭] রিয়াজ আহমেদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত