কোদালকাঠির যুদ্ধ, কুড়িগ্রাম
কোদালকাঠি ব্রক্ষপুত্র নদের চরাঞ্চলের একটি গ্রাম। এটি কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী থানায় অবস্থিত হলেও গাইবান্ধা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এই যুদ্ধের গুরুত্ব অনেক। গাইবান্ধা জেলায় অপারেশন পরিচালনার জন্য কোদালকাঠি শত্রুমুক্ত রাখা অপরিহার্য ছিল। এই যুদ্ধ সম্পর্কে ১১নং সেক্টরের অধিনায়ক কর্নেল আবু তাহের স্মৃতিচারণ করেছেনঃ “১১ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার হিসেবে যখন আমি দায়িত্ব গ্রহণ করি তখন বেশ অনেকগুলো চরের সমন্বয়ে গঠিত বিশাল রৌমারী এলাকা মুক্ত ছিল। এর প্রতিরক্ষা আমাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছিল, কারণ মুজিবনগর থেকে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারক আমরা সেখানে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। মেজর জিয়ার ব্রিগেডের দুটো বেঙ্গল রেজিমেন্ট এই মুক্তাঞ্চল প্রতিরক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিল। শুধুমাত্র কোদালকাঠি চর ছাড়া ব্রক্ষপুত্রের পূর্বপারের সকল এলাকা মুক্ত ছিল। কোদালকাঠিতে শত্রুসৈন্যের অবস্থান স্থানীয় গ্রামবাসীদের জন্য ত্রাসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ সকল শত্রুসৈন্য প্রায়ই পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে ঢুকে পড়ে গ্রামবাসীদের উপর অত্যাচার চালাতো। ব্রক্ষপুত্রের পূর্বাঞ্চলকে সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত করার জন্য সুবেদার আফতাবের নেতৃত্বে দুই কোম্পানী মুক্তিযোদ্ধা সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকের এক রাতে গোপনে কোদালকাঠিতে অনুপ্রবেশ করে এবং শত্রুব্যুহের মাত্র কয়েকশত গজ দূরবর্তী ঝাউবনে ট্রেঞ্চ খনন করে তাতে অবস্থান করতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিখাগুলোর সামনেই শত্রুনিধনের উপযোগী বিস্তৃত খোলা জায়গা ছিল। আমাদের কৌশলের মূল উর্দ্দেশ্য ছিল, এই মুক্তিযোদ্ধাদের পরিক্ষাগুলোতে উপস্থিতি টের পেয়ে যখন শত্রুসৈন্য তাদেরকে উৎখাত করার জন্য আক্রমণ চালাবে, তখন আক্রমনোদ্যত শত্রুসেনাদের খোলা জায়গায় পেয়ে আমরা তাদের নিশ্চিহ্ন করবো। পরের দিন আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী শত্রুর প্রচন্ড আক্রমণ ঘটে এবং তা তড়িৎগতিতে প্রতিহত করা হয়। শীঘ্রই সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় এবং তারপর তৃতীয় আক্রমণ ঘটে-সেগুলোও সাহসের সঙ্গে মোকাবেলা করা হয়। নিধন এলাকা শত্রুসৈন্যের মৃতদেহে ভরে ওঠে। যে ক’জন শত্রুসৈন্য পরিখা পর্যন্ত এগুতে পেরেছিল তাদের বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করা হয়। আমাদের অবস্থানের দু’প্রান্তে স্থাপিত মেশিনগান সেদিন আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। মেশিনগান দুটির আড়াআড়ি গুলিবর্ষণে বেশির ভাগ শত্রুসৈন্য মারা পড়েছিলো। তৃতীয় আক্রমণ প্রতিহত করার পর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের পরিখা থেকে বেরিয়ে আসে এবং শত্রুদের উপর মরণ আঘাত হানার জন্য এগিয়ে যায়। খুব অল্প সংখ্যক শত্রুসৈন্যই অপেক্ষমাণ গানবোটে পালিয়ে যেয়ে সক্ষম হয়। এই যুদ্ধের পর থেকে কোদালকাঠি ও রৌমারী এলাকা সর্বসময় মুক্ত থাকে এবং সেখানে বাংলাদেশের পতাকা উড়ে।”
[৫৮০] ড. মোঃ মাহবুবর রহমান
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত