কুষ্টিয়ার যুদ্ধ-১
২৫ মার্চ রাতেই পাকিস্তানী বাহিনী কুষ্টিয়া দখল করে নেয়। মুক্তিযোদ্ধারা [যারা চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর ছিলেন] ২৮ মার্চ সিদ্ধান্ত নিলেন কুষ্টিয়া মুক্ত করবেন। সর্বপ্রকার প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে ৩০ মার্চ ভোর ৪টা ৪৫ মিনিটে অপারেশন শুরু হয়। অপারেশনের নাম দেওয়া হয় অপারেশন ফার্স্ট লেগ। পরিকল্পনা অনযায়ী তিনদিক থেকে একসঙ্গে আক্রমণ শুরু হয়। সুবেদার মোজাফফর তাঁর বাহিনী নিয়ে পুলিশ লাইনের ঘাঁটি আক্রমণ করেন। ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী তাঁর বাহিনী নিয়ে শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অর্থাৎ সার্কিট হাউজের দিক থেকে জেলা স্কুলের মূল ঘাঁটি আক্রমণ করেন। আর নায়েবসুবেদার মনিরুজ্জামান তাঁর বাহিনী নিয়ে পূর্বদিক থেকে অয়্যারলেস স্টেশনের উপর হামলা চালান। প্রতিটি আক্রমণকারী বাহিনীর পেছনে কমপক্ষে ৫ হাজার ল্কের সমাবেশ এবং জয়বাংলা ধ্বনি পাকিস্তানী বাহিনীকে দিশেহারা করে ফেলে। ই.পি.আর-এর মতো আধাসামরিক বাহিনী পাকিস্তানী বাহিনীকে আক্রমণ করতে পারে, এমন কোনো ধারণাই তাদের ছিল না। তাই মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণকালে পাকিস্তানী সেনাদেরকে ঘুমন্ত ও অপ্রস্তুত অবস্থাতেই পেয়েছিল। কাজেই পাকিস্তানী বাহিনীর কাছ থেকে প্রত্যাশিত প্রাথমিক প্রতিরোধও আসেনি। পাকিস্তানী সেনাদের অধিকাংশই কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধরাশায়ী হয়। সকাল ৯টার দিকে আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। আক্রমণ শুরু হবার কিছুক্ষণের মধ্যেই মেহেরপুর থেকে এক কোম্পানি মুজাহিদ সুবেদার মজাফফরের বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়। দুপুরের মধ্যেই ডিসিকোর্ট, থানাসহ অনেক জায়গা মুক্তিবাহিনী দখলে চলে আসে। কিন্তু তখনো জেলাস্কুল, পুলিশ লাইন ও অয়্যারলেস স্টেশন পাকিস্তানী বাহিনীর দখলে ছিল। দুপুর দেড়টার দিকে চারজন পাকিস্তানী সেনাকে একটা আর.আর প্রস্তুত করতে দেখা যায়। যুদ্ধরত নায়েবসুবেদার মতিন পাটোয়ারী সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানী বাহিনীর ঐ পজিশনে আঘাত হানার নির্দেশ দেন। তাৎক্ষণাৎ একটি রকে লাঞ্চার, তিনটি এল.এম.জি. ও একটি ২ ইঞ্চি মর্টার একই সঙ্গে আর.আর.-এর উপর আঘাত করে। ঘটনাস্থলেই চারজন পাকিস্তানী সেনা নিহত হয়। বিকেলে জেলাস্কুল ও পুলিশ লাইনে তুমুল যুদ্ধ হয়। কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলার পর পাকিস্তানী বাহিনী পুলিশ লাইন ত্যাগ করে নিকটবর্তী টেলিফোন এক্সচেঞ্জে আশ্রয় নেয়, সেখানেও প্রচণ্ডভাবে আঘাত করা হয়। এসময় একটি দুঃসাহসিক ঘটনা ঘটে। ১৩/১৪ বছরের একটি ছেলে হঠাৎ টেলিফোন এক্সচেঞ্জের পেছন দিকের পাইপ পেয়ে এক্সচেঞ্জের ছাদে ওঠে। তারপর যে জানালা দিয়ে পাকিস্তানী বাহিনী গুলি চালাচ্ছিল, ছেলেটি অপর একটি পাইপ বেয়ে সেই জানালার কাছে যায়। তারপর গায়ের জামাটা খুলে পাকিস্তানী সেনাদের মেশিনগানের নলের উপর ফেলে দিয়ে ম্যাচ ঠুকে আগুন ধরিয়ে দেয়। বারুদের সংস্পর্শে এসে সে-আগুন সঙ্গে সঙ্গে পুরো এক্সচেন ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানী সেনারা দ্রুত এক্সচেঞ্জ ভবন ত্যাগ করে জেলস্কুলের মূল ঘাঁটিতে আশ্রয় নেয়। পড়ে পুলিশ লাইন থেকে ১৩ জন পাকিস্তানী সেনার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসার পর অয়্যারলেস স্টেশনটি বিস্ফোরকের সাহায্য উড়িয়ে দেওয়া হয়। সন্ধ্যার মধ্যে মূল ঘাঁটি জেলাস্কুল ছাড়া সমগ্র কুষ্টিয়া শহর প্রতিরোধ বাহিনীর দখলে আসে। প্রতিরোধ-যোদ্ধারা চারদিক থেকে জেলাস্কুলকে ঘিরে আঘাতের-পর-আঘাত হানতে থাকে। মেজর শোয়েব আর কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে অয়্যারলেস মারফত যশোর সেনানিবাসের সাহায্য প্রার্থনা করেন প্রত্যুত্তরে যশোর থেকে মেজর শোয়েবকে অয়্যারলেস-এ বলা হল :
Troops here already committed, No reinforcement possible. Air strike called off due to poor visibility… Try to live on your own. Khoda Hafiz!
মুক্তিযোদ্ধাদের অয়্যারলেসে এই বার্তাটি ধরা পড়ে যায়। সারাদিনের যুদ্ধশেসে অফিসারসহ মাত্র ৬৫ জন পাকিস্তানী সেনা তখনো জীবিত ছিল। এ প্রসঙ্গে Siddiq Salik Zuvi Witness to Surrender বইয়ে লিখেছেনঃ Major Shoaib collected the remnants of this command to regornagize them. He found that only 65 had survived out of 150. মুক্তিযোদ্ধারা জেলাস্কুল ঘাঁটি দখল করতে অন্যরকম পরিকল্পনা আটে। ঠিক হলে, চতুর্দিক আগুন ধরিয়ে দিয়ে শত্রুদের নিপাত করা হবে। সে-অনুযায়ী জেলাস্কুলের চতুর্দিকে কেরোসিন, খড়ের গাদা ইত্যাদি জড়ো করা হয়। কিন্ত হঠাৎ রাত ৮টার দিকে অবশিষ্ট পাকিস্তানী সৈন্য জেলাস্কুলের ঘাঁটি থেকে কয়েকটি গাড়িতে চড়ে তীব্রবেগে গুলিবর্ষণ করতে করতে কুষ্টিয়া-যশোর সড়ক দিয়ে ঝিনাইদহের দিকে দ্রুত পলায়ন করে। এসময় রাস্তাঘাট সব অন্ধকার ছিল। দূরে-কাছে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না বলে গুলিবর্ষণ বন্ধ ছিল। এমনি এক প্রত্যাশিত সুযোগ পাকিস্তানী সৈন্যরা জেলাস্কুল থেকে পালাতে সক্ষম হয়। ফলে পাকিস্তানী বাহিনীর সর্বশেষ অবস্থানও মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। জেলাস্কুল থেকে পলায়নকারীরা মুক্তিবাহিনীর ঘেরাও থেকে বেরিয়ে এলেও বাঁচতে পারেনি। মুক্তিবাহিনীর এক অংশ আগে থেকেই শৈলকূপার গাড়াগঞ্জের সেতুটি ভেঙ্গে ফেলে শূন্য জায়গায় বাঁশের চাটাই দিয়ে ঢেকে আলকাতরা মাখিয়ে পীচঢালা পথের মতো করে তাঁর দুপাশে অ্যাম্বুশ করে বসে ছিল। তীব্রগতিতে ছুটে আসা পাকিস্তানী বাহিনীর গাড়িগুলোর প্রথম ২টি জিপ নিচে পড়ে যায়। তৎক্ষণাৎ মুক্তিবাহিনী আঘাত হানতে শুরু করলে মেজর শোয়েবসহ কয়েকজন ঘটনাস্থলে নিহত হয়, অবশিষ্টরা বিভিন্নদিকে ছড়িয়ে পড়লে গ্রামবাসীরা গণপিটুনিতে নিহত হয়। আলমডাঙ্গা থানার কালিদাশপুর গ্রামের নিকট দিয়ে তিনজন পাকিস্তানী সৈন্য পলায়নকালে তাদের একজন শফিউর রহমান জোয়ারদার সুলতানের বন্দুকের গুলিতে আহত হয়। পরে সে কালিদাশপুর ব্রিজের কাছে এবং অপর দুজন আলমডাঙ্গা রেলস্টশনের কাছে গণপিটুনিতে নিহত হয়। এসময় পাকিস্তানী সেনারা এতই মনোবল হারিয়ে ফেলেছিল যে, অত্যাধুনিক আগ্নোয়াস্ত্র হাতে থাকলেও ব্যবহার করতে সাহস পায়নি। কুমারখালি থানার সুলতানপুর গ্রামের ডা. আলাউদ্দিনের বন্দুকের গুলিতেও তিনজন পাকিস্তানী সেনা নিহত হয়। কুশ্তিয়াকে শত্রুমুক্ত এই যুদ্ধে যারা শহীদ হন, তারা হলেনঃ কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর থানার মশান গ্রামের নাজির শেখের ছেলে গোপাল শেখ ও হাচেন আলীর ছেলে আশরাফ আলী; দৌলতপুর থানার মিরপুর গ্রামের আলম হোসেনের ছেলে দেলোয়ার হোসেন; কুমারখালি থানার দুধকুমার গ্রামের ওমেদ আলীর ছেলে হামেদ আলী; মেহেরপুর সদর থানার নাছিরউদ্দিনের ছেলে মোঃ. ফজলুর রহমান ও আব্দুর রহমানের ছেলে আব্দুর রশীদ। আহত ১১ জন হলেনঃ মোঃ. আবদুল মোমেন, মোঃ. আনসার আলী, মোঃ. পাতান আলী, আব্দুর রশীদ, রবিন ও জামাত আলী। এছাড়া আরো প্রায় ৫০জনকে চুয়াডাঙ্গায় এনে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। কুষ্টিয়া থেকে মুক্তিযোদ্ধারা যে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও যানবাহন উদ্ধার করে, তা হলঃ
ক. ১০৬ মিলিমিটার রিকয়েল্লেস রাইফেল/আর. আর. (জিপ আরহী) ৫টি
খ. ৭.৬২ মিলিমিটার চাইনিজ মেশিনগান ৮টি
গ. ৭.৬২ মিলিমিটার চাইনিজ হালকা মেশিনগান ১৯টি
ঘ. ৭.৬২ মিলিমিটার চাইনিজ সাব-মেশিনগান ৩১টি
ঙ. ৭.৬২ মিলিমিটার চাইনিজ রাইফেল ৮৯টি
চ. জিপ গাড়ি ১২টি
ছ. ১ টন ডজ গাড়ি ৫টি
জ. ৩ টন বড় মোটরগাড়ি ৭টি
ঝ. বড় (লং ডিসট্যান্ট) সিগন্যাল সেট ৪টি
ঞ. সব রকমের প্রচুর পরিমাণ গোলাবারুদ।
ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী সাফল্যের সঙ্গে কুষ্টিয়া জয় করে সেখানে কিছু সৈন্য রেখে অবশিষ্টদের নিয়ে ঝিনাইদহের দিকে রওনা হন। এই বাহিনীর কিছু সৈন্য মাগুরা, কিছু সৈন্য ঝিনাইদহের দক্ষিণে বিষয়খালি ও কিছুসংখ্যক সৈন্য কোটচাঁদপুরে প্রতিরক্ষায় রাখাঁ হয়। কুষ্টিয়া থেকে ফিরে মেহেরপুরের এক প্লাটুন আনসারকে চুয়াডাঙ্গায় পাঠানো হয়। তাঁদেরকে মাথাভঙ্গা নদীর ব্রিজের কাছে মোতায়েন করা হয়। মুক্তিযোদ্ধারা চুয়াডাঙ্গায় আকন্দবাড়িয়া, বেলগাছি, দামুড়হুদা ও আলমদাঙ্গাতেও প্রতিরক্ষাব্যূহ রচনা করে। এই প্রতিরক্ষার প্রধান কারণ ছিল যশোর সেনানিবাস থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দক্ষিন-পশ্চিম রণাঙ্গনের সদর দপ্তর চুয়াডাঙ্গা আক্রমণের সকল পথ রুদ্ধ করা। সেই সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুল ঘাটি যশোর সেনানিবাস আক্রমণের ভাবনা। ১ এপ্রিল আহত অবস্থায় পাকিস্তানী-লেফটেন্যান্ট আতাউল্লাহ শাহ্ ধরা পড়েন। প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাঁকে চুয়াডাঙ্গায় আনা হয়। ২ এপ্রিল কুষ্টিয়ার যুদ্ধে প্রাপ্ত সমরাস্ত্র চুয়াডাঙ্গায় আনা হয়। এই যুদ্ধে সম্পর্কে সুকুমার বিশ্বাস লিখেছেনঃ কুষ্টিয়ার যুদ্ধের বুঝি তুলনা হয় না। আমাদের পেছনে লাখে লাখে লোক ঢাল, তলোয়ার, লাঠি, সড়কি, বল্লম নিয়ে প্রস্তুত হয়েছিল। তারা বাংলাদেশ রক্ষার জন্য, দেশ থেকে শত্রুসৈন্য বিতাড়িত করবার জন্য বদ্ধপরিকর। তাদের চখে-মুখে দেখেছি আগ্নিফুলঙ্গ। যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে যুদ্ধ করার চাইতেও আমাকে অবাক করলো মেয়রা। এহিয়ে গেলাম, দেখি স্থানীয় ছেলেরা শত শত ডাব নিয়া হাজির, তাদের সঙ্গে বাড়ির ঝি-বৌরা যার যার মতো রুটি, ভাত মাংস এমনকি পোলাও পর্যন্ত এনে হাজির করেছে। বাড়ির বৌ, মেয়ে যারা কোনদিন বাড়ির বাইরে বের হতো না, তারাও যুদ্ধের ময়দানে হাসিমুখে খাবার এনে ভাইদের মুখে ধরেছে। তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী লিখেছেনঃ সাধারণ মানুষের এই সময়কার সাহসিকতা পৃথিবীর ইতিহাসেও বিরল। সয়ংক্রিয় মারণাস্ত্রের বিরুদ্ধে বাংলার গ্রামের আবাল-বৃধ বণিতা সমষ্টিগতভাবে রুখে দাড়ায়। আমরা ১ এপ্রিল থেকে অনবরত গ্রামের লোকজনের কাছ থেকে অশ্ত্রশস্ত্র পেতে থাকি, যা তারা পাকসেনাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। পাকিস্তানী সামরিক জান্তা কর্তৃক বাংলার উপর ক্র্যাক ডাউনের এক সপ্তাহের মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বাহিনীর কুষ্টিয়া বিজয় ছিল সামরিক দিক দিয়ে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই যুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনীর একটি অতি শক্তিশালী ব্যাটালিয়ন যুদ্ধের অনুপযোগী হয়ে পরে। ফলে ব্যাটিলিয়নকে পুনর্বিন্যাস করার জন্য এর অবশিষ্টাংশকে পশ্চিম- পাকিস্তানে নিয়ে যেতে হয়। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর মনোবল আকাশ্চুম্বী হয়।
[১০৮] রাজিব আহমেদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত