You dont have javascript enabled! Please enable it!

কুমিল্লায় ইপিআর বাহিনীর বিদ্রোহ, কুমিল্লা

সিলেটে সেক্টরেরে অধীনে কুমিল্লার কোটবাড়িতে ১ নং ইপিআর-এর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। এই উইং-এর বাঙালি সৈনিকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেয়। উইং কমান্ডার মেজর করব আলী অবাঙালি হলেও উইং হেডকোয়ার্টারে অবস্থানরত নির্দোষ বাঙালি ইপিআরদের পাকিস্তান সেনাবাহিনী বর্বর হামলার শিকার হতে দেননি। যদিও তিনি সবাইকে রক্ষা করতে পারেনি, তবুও তিনি উইং-এর অধিকাংস বাঙালি ইপিআরকে অন্যত্র সরে যেতে সহায়তা করেছিলেন বলে অনেকে জানিয়েছে।
উইং চারটি কোম্পানি এবং একটি সাপোর্ট প্লাটুন ছিল। একটি কোম্পানি উইং হেডকোয়ার্টারে, একটি আখাউড়াতে, একটি নয়নপুরে এবং একটি পরশুরাম এলাকাতে অবস্থান করছিল। ঢাকায় ইপিআর হেডকোয়ার্টার পিলখানা এবং পুলিশ হেডকোয়ার্টার রাজারবাগে হামলার খবর ২৬ মার্চ এসব কোম্পানি হেডকোয়ার্টার এমন কি বিওপিগুলোত পর্যন্ত পৌঁছে যায়। ইপিআর সেক্টরগুলোতে বাঙালি ইপিআরদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী হামলার খবরও এখানে এসে পৌঁছাতে থাকে। উইং হেডকোয়ার্টারের ১২৫ জনের মতো বাঙালি ইপিআর কমান্ডিং অফিসার মেজর করব আলীর অনুরোধে প্রায় নিরস্ত্র অবস্থায় অবস্থান করতে থাকে। কমান্ডিং অফিসারের অনুরোধে উইং হেডকোয়ার্টারের বাঙালি ইপিআররা নিরস্ত্র থাকতে বাধ্য হলেও সীমান্ত এলাকায় বাঙালি ইপিআররা প্রতিরোধ শুরু করে।
নায়েক সুবেদার গোলাম আম্বিয়া সিঙ্গার বিওপিতে থাকা অবস্থায় ২৬ মার্চ বেলা সাড়ে এগারোটায় একজন বাঙালি সিগন্যাল সিপয়াইয়ের কাছ থেকে পাকিস্তানী বাহিনীর পীলখানা আক্রমণের খবর পেয়ে কর্নালবাজার প্লাটুন কমান্ডার নায়েক সুবেদার মোহাম্মদ হোসেনের সঙ্গে পরামর্শ করেন এবং উভয়ে পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার সিদ্ধান্ত নেন।
আখাউড়া ছিল কোম্পানি হেডকোয়ার্টার। সেখানে পাঞ্জাবি কোম্পানি কমান্ডার শের মোহাম্মদ বেশ কিছুদিন পূর্ব থেকে অবাঙালি ইপিআরদের একত্র করে কোম্পানি হেডকোয়ার্টারে পাকা বাঙ্কার করে অস্ত্রশস্ত্রসহ অবস্থান করছিলেন। নায়েক সুবেদার গোলাম আম্বিয়া এবং নায়েক সুবেদার মোহাম্মদ হোসেন যৌথভাবে কোম্পানি হেডকোয়ার্টারে শত্রুমুক্ত করতে অগ্রসর হন। কমান্ডারদ্বয় বিওপিগুলোতে যে কিছুসংখ্যক অবাঙালি সৈনিক ছিল, তাদেরকে বন্দি করে ২৮ মার্চের মধ্যে আখাউড়া সিনেমা হলের কাছে সবাইকে একত্র হতে বলেন। অপর দিকে কোম্পানি হেডকোয়ার্টারে যে কিছুসংখ্যক বাঙালি ইপিআর ছিল তাদের অধিকাংশই পালিয়ে গিয়ে বিদ্রোহী বাঙালীর সঙ্গে যোগ দেয়। ইপিআর বাহিনীর এই দলটির সঙ্গে ছাত্র, শ্রমিক, আনসার, মুজাহিদ এবং কিছু পুলিশ মিলিত হয়। আর হাজার হাজার জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে।
২৯ মার্চ ৪টা ৩০ মিনিটে বাঙালি ইপিআর বাহিনীর এই দলটি আখাউড়া কোম্পানি হেডকোয়ার্টার আক্রমণ করে। রাত প্রায় বারটা পর্যন্ত উভয়পক্ষে গুলিবিনিময় হয়। অবাঙালি ইপিআররা বিপদ বুঝতে পেরে রাতের অন্ধকারে কোম্পানি হেডকোয়ার্টার ছেড়ে পালাতে শুরু করে। পালাবার পথে কিছু সংখ্যক সদস্য ভারত সীমান্তে বিএসএফ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং কয়েকজন জনতার হাতে করুণভাবে মৃত্যুবরণ করে। এখানে জনার স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ যুদ্ধ অংশগ্রহনের একটি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ঘটনাটি ছিলঃ
আখাউড়া হেডকোয়ার্টার থেকে রাতের অন্ধকারে অবাঙালি ইপিআর বাহিনীর একটি ছোট্ট দল কুমিল্লার পথে পালাতে গেলে আখাউড়া থেকে প্রায় চার মাইল দূরে জনতা তাদেরকে ঘিরে ফেলে। উপায়ান্তর না দেখে অবাঙালি ইপিআররা একটি মসজিদে আশ্রয় নেয় এবং মসজিদের জানালা দিয়ে অনবরত গুলি চালিয়ে বেশ কিছু নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। কিছুতেই অবাঙালি সৈনিকরা বাইরে আনা যাচ্ছিল না। এমতাবস্থায় জনতা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং মসজিদের ছাদ ছিদ্র করতে থাকে। পড়ে ঐ ছিদ্রপথে কয়ে বস্তা শুকনা মরিচ মসজিদের ভিতর ঢুকিয়ে তারা আগুন লাগিয়ে দেয়। শুকনা মরিচের গন্ধে অবাঙালি ইপিআররা কাশতে কাশতে অস্ত্র ফেলে বাইরে এসে প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করে। কিন্তু জনগণ তখন বাঁধনহারা। স্বাভাবিকভাবে তাদের মৃত্যু ঘটল উত্তাল জনতার হাতে। এ ভাবে আখাউড়া মুক্তিযোদ্ধাদের পুরোপুরি দখলে আসে। এখানে বেশ কিছু অস্ত্র, গোলাবারুদ, ওয়্যারলেস সেট, রেশনসামগ্রী বাঙালি ইপিআরদের হস্তগত হয়।
২ এপ্রিল বিকেলে ব্রাক্ষণবাড়িয়া থেকে মেজর খালেদ মোশাররফ টেলিফোনে নায়েক সুবেদার গোলা আম্বিয়াকে তাঁর কোম্পানি নিয়ে উজানিসার এবং গঙ্গাসাগর নামক স্থানে ডিফেন্স নিতে বললেন।
এদিকে ১ নং উইং-এর সহকারী উইং কমান্ডার ক্যাপ্টেন ফারুকী এক প্লাটুনের কিছু বেশী ইপিআর সৈন্য নিয়ে ফেনী শহরে সিও অফিসে অবস্থান করছিলেন। ২৫ মার্চের পর পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেন ফারুকী অবাঙালি ইপিআরদের সহায়তায় জনসাধারণের ওপর অত্যাচার শুরু করে। এই ঘটনা সম্পর্কে ‘দৈনিক বাংলা’ইয় এক নিবন্ধে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আবদুর রউফ বলেছেনঃ ‘ফেনী শহরে অবস্থিত দলটি জনসাধারণের ওপর অত্যাচার আরম্ভ করে। এতে জনসাধারণ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং ২৭ মার্চ তারা সৈন্য দলটিকে ঘিরে ফেলে। হানাদারবাহিনী গুলি ছুঁড়ে চারজনকে হত্যা করে এবং দশজন আহত হয়।
২৬/২৭ মার্চ কুমিল্লা উইং হেডকোয়ার্টারের একটি প্লাটুন নায়েক সুবেদার আফতাবউদ্দিনের নেতৃত্বে পরশুরাম শালধর বাজার বিওপিতে পৌঁছায়। সেখানে অবস্থানরত নায়েক সুবেদার বাদশা মিয়ার প্লাটুন আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। উভয় প্লাটুন নিয়ে তাঁরা ফেনীর দিকে অগ্রসর হন। ইপিআর বাহিনীর এই দলটি ফেনীতে পৌঁছে ছাত্র, আনসার, পুলিশ, অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকদের একত্র করে এক শক্তিশালী মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলে। মুক্তিযোদ্ধাদের এই দলটি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আবদুর রউফের নেতৃত্বে সিও অফিসে অবস্থানরত পাকিস্তানিদের ওপর আক্রমণ করে। সংঘর্ষে ক্যাপ্টেন ফারুকীসহ অধিকাংশ অবাঙালি ইপিআর মুক্তি পায় এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন ইনাম যোগ দেন। এরপর মুক্তিযোদ্ধাদের এই দলটি ফেনী, বিলোনিয়া এবং নোয়খালীর বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল কুমিল্লা সেনানিবাসে। ১৯৭০ সালের মে মাসে এই ব্যাটালিয়ন লাহোর থেকে কুমিল্লা সেনানিবাসে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৭১-এর ২৭ মার্চ। পুরো ৫০০ সৈন্যের একটি ব্যাটালিয়ন নিয়ে মেজর (পরবর্তীকালে কর্নেল) শাফায়ত জামিল মুক্তিযুদ্ধ যোগ দেন। ’৭১-এ এটিই ছিল সবচেয়ে বড় নিয়মিত বাহিনী নিয়ে যুদ্ধে যোগদানের ঘটনা।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!