You dont have javascript enabled! Please enable it! কুলাঘাট অপারেশন, কুড়িগ্রাম - সংগ্রামের নোটবুক

কুলাঘাট অপারেশন, কুড়িগ্রাম

আজকের জেলার সদর লালমনিরহাট তখন ছিল কুড়িগ্রাম জেলারই একটি থানা। সাখেন পাকসেনা বাহিনীর একটি শক্ত ঘাঁটি। লালমনিরহাট থেকে কুলঘাট হয়ে ধরলা নদী অতিক্রম করে ফুলবাড়িতে আক্রমণ করার প্রচেষ্টা চালাত মাঝে মধ্যে। নদী তীরের গ্রামগুলোতে হানা দিত প্রায়ই। এই যে গ্রামে প্রবেশ, এর উদ্দেশ্য ছিল একাধিক। প্রথম, নারী নির্যাতন চালাত তারা অবলীলায়। পিতার সামনে কন্যাকে, স্বামীর সামনে স্ত্রীকে, ছেলে-মেয়ের সামনে মাকে ধর্ষণ করত প্রকাশ্য দিবালোকে। এর প্রতিবাদ যে-ই করেছে তার বুকেই বিদ্ধ হয়েছে আমেরিকান বুলেট। বহু রমণীকে ধরে নিয়ে গেছে তাদের ক্যাম্পে। কাউকে আটকে রেখেছে কয়েকদিন। কুরে কুরে খেয়েছে দেয়। তারপর হয়তো ক্ষতবিক্ষত দেহে ছেড়ে দিয়েছে এক সময়। কাউকে কাউকে ফিরে আসতে হয়নি কখনো। অবশেষে জীবন সংহার করছে তাদের। কত রমণীকে রেখেছে তাদের বাঙ্কারে, কতজনকে ক্যাম্পে। ভোগ করেছে ভাগাভাগি করে। দ্বিতীয়, লুটপাট করত তারা প্রতিটি গ্রামে। সোনা-গহনা থেকে শুরু করে টাকা পয়সা এবং অস্থাবর সম্পত্তি নিয়ে যেত। এমনকি গরু-ছাগল, হাঁস –মুরগি পর্যন্তও লুটপাটের তালিকায় থাকত তৃতীয়ত, মুক্তিযোদ্ধা আওয়ামী লীগ এবং হিন্দু ইত্যাদি অভিধায় আখ্যায়িত করে লোকজন ধরে নিত বাড়ি থেকে। তারপর হত্যা করত যেখানে ইচ্ছে সেখানে। এ ধরনের উৎপাত চলছিল অনেক দিন ধরে। অবশেষে পাকিস্তানীদের শায়েস্তা করার লক্ষ্যে প্রণীত হয় একটি অপারেশন পরিকল্পনা। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি এ অপারেশন পরিচালিত হয়েছিল। কোম্পানি কমান্ডার সিরাজ। গঠন করলেন একটি গ্রুপ। অতিক্রম করলেন, বিশাল ধরলা। তারপর গেলেন একটু উজানে। ভাগ করলেন তার গ্রুপকে দু’ভাগে। দুটি গ্রামের ব্যবধানে অবস্থান নির্ধারণ করলেন দু’গ্রুপের। রাতের আঁধারে মুক্তিসেনারা উত্তর-দক্ষিণের দুটি স্থানে অবস্থান গ্রহণ করেছে। সংবাদ পাকিস্তানীদের পা-চাটা রাজাকার শান্তি কমিটি কিংবা জামায়াতের লোকজন অবগত হয়নি। ফলে পাকসেনারা থাকলো অন্ধকারে। মুক্তিবাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেনি পাকসেনারা। তাই পরের দিন সকাল্বেলা তাদের নিজস্ব প্ল্যান অনুযায়ী বেরিয়ে পড়ে গ্রাম থেকে। পঁচিশ জনের দলটি সকাল ১০ টার দিকে ঢুকে গ্রামে। কিছু টের পাওয়ার আগেই ঢুকে যায় মুক্তিবাহিনীর অ্যাম্বুশের ভেতর। তারা এগিয়ে যাচ্ছে নদীর দিকে। কি তাদের উদ্দেশ্যে তা জানা যায়নি। কারণ, এর আজ্ঞেই মুক্তিসেনারা ঘেরাও করে তিন দিক থেকে-সামনে নদী, ডানে-বাঁয়ে ও পেছনে মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু এর কিছুই জানতে পারেনি। পাকসেনারা। সুবিধাজনক সময়েই তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলার দামাল ছেলেরা। দ্রাম দ্রাম, গুড়ুম-গুড়ম প্রচণ্ড শব্দ। অগুণতি গুলি। হতভম্ব হয়ে পড়ে পাকিস্তানী পশুরা। এমনটা তারা ভাবতেও পারেনি। চালায় পালটা গুলি। কিন্তু এর আগেই নিহত হয় ১২ জন পাকসেনা। একজন মুক্তিসেনাদের হাতে জ্যান্ত ধরা পড়ে। অন্যরা পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছিল। মকবুল খান নামক ধৃত পাকসেনাকে নিয়ে আসা হয় ফুলবাড়ি। সেখানে তাকে ঘিরে জড়ো হয় শত শত লোক। তারা প্রতিশোধ নিতে চায়। কিন্তু ভারতীয় সেনাসদস্যরা এসে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায় ভারতে। নিহত পাকসেনাদের এ সংখ্যা আখতারুজ্জামান মণ্ডল উল্লেখ করেছেন তাঁর গ্রন্থ ‘১৯৭১: উত্তর রণাঙ্গনে বিজয়’ গ্রন্থে।
[৪৭] তাজুল মোহাম্মদ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত