You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.31 | কুষ্টিয়া-যশোরের সশস্ত্র প্রতিরোধ - সংগ্রামের নোটবুক

কুষ্টিয়া-যশোরের সশস্ত্র প্রতিরোধ
[অংশগ্রহণকারীর বিবরণ]

আমরা নিম্নিলিখিত কয়েকজন অফিসার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য তদানীন্তন এসডিপিও জনাব মাহবুবউদ্দিন আহমদের বাসায় (ঝিনাইদহে) একত্রিত হই। আর ছিলেন, ১। তৌফিক এলাহীম এসডিও মেহেরপুর, ২। কামালউদ্দিন সিদ্দিকী, এসডিও নড়াইল, ৩। ওয়ালিউল ইসলাম, এসডিও মাগুরা, ৪। শাহ্‌ মোহাম্মদ ফরিদ, এসডিও, গোয়ালন্দ
আলোচনায় আমরা এই সিদ্ধন্তে উপনীত হই যে, একটা সামরিক সংঘর্ষ অবধারিত। এই বৈঠকে নিজ নিজ এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আমি আমার এলাকায় সমস্ত থানার পুলিশদের প্রস্তুত রাখি। ২৫ শে মার্চ রাতে নূরুল হক এমপি আমাকে টেলিফোন জানালেন যে, ঢাকায় পাকসেনাবাহিনী শহরে বের হয়ে পড়েছে এবং জনগণের উপর আক্রমণ চালিয়েছে। আমি তাকে আমার বাসায় আসতে অনুরোধ করি। অনুসন্ধান করে জানতে পারলাম যে, ঢাকা টেলিফোন এক্সচেঞ্জ কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় সেনাবাহিনীর আক্রমণের খবর জানিয়েছে এবং কুষ্টিয়া এক্সচেঞ্জ মেহেরপুরে এই খবর জানিয়েছে। প্রথমে কুষ্টিয়ার সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু যোগাযোগ তার আগেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তারপর আমি পুলিশ অয়ারলেস থেকে ঢাকাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সাথে যোগাযোগ করি। একজন অজ্ঞাতনামা অপারেটর রাজারবাগ থেকে উত্তর দেয়, ‘যা বলার বলেছি তো, আর বিরক্ত করবেন না। আবার অনুরোধ করায় আর কোন উত্তর পাওয়ায় গেল না। ২৫ শে মার্চ রাত বারোটায় মাইকে কুষ্টিয়া শহরের জনগণকে ঢাকাতে পাকবাহিনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কথা জানিয়ে দেয়া হল। সেই মুহূর্ত থেকে আমি আর পাকিস্তানী সরকারী কর্মচারী রইলাম না। এবং জনগনের আন্দোলনের সাথে একত্মতা ঘোষনা করলাম। মেহেরপুর আনসার কমান্ডারকে আমি আদেশ দিই ২৬শে মার্চের মধ্যে মেহেরপুর মহকুমার সমস্ত আনসার ও মুজাহিদকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। আমার কাছে মনে হল সমস্ত জনতার মধ্যে এক অভাবনীয় পরিবর্তন এসেছে এবং প্রত্যেকে তার একক সত্ত্বাকে বিসর্জন দিয়ে এক সম্মিলিত সত্ত্বায় রূপান্তরিত হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেরণা এবং এর অবশ্যম্ভাবী বিজয়ের শক্তি এই জনতার নব রূপান্তরিত সত্ত্বার মধ্যে নিহিত ছিল। প্রত্যেকটা লোক এবং প্রত্যেকটা ছেলে আমার কাছে নতুন ভাবে ধরা দিয়েছিল। গায়ের বধূরা পর্যন্ত এই স্বতঃস্ফূর্ত গণজাগরণে অঙ্গাঙ্গীভাবে একত্মতা অনুভব করছিল। সেই মুহূর্তে আমি যেন দিব্যচক্ষে পৃথিবীর বড় বড় বিপ্লবকে চাক্ষুষ দেখতে পেলাম। সমগ্র পরিস্থিতিতে আমার ব্যক্তিগত মূল্যায়ন আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, আমাদের যে কোন জায়গা থেকে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করতে হবে। এবং শুধুমাত্র ভারতই আমাদের এই সাহায্য করতে পারে। দ্বিতীয়ৎ, ভারত-পাকিস্তানের ঐতিহাসিক বিরোধের পটভূমিকায় এটা স্পষ্ট ছিল যে, বাংলাদেশের যে কোন সামরিক বা গণঅভ্যুত্থান সমর্থন পাবেই। তাই ২৬শে মার্চ সকালে আমি দু’রকম চিঠি ভারতে পাঠাই। একটা চিঠি পাঠান হয়েছিল নদীয়া জেলা প্রশাসকের কাছে, যার একটা অনুলিপি পাঠাই লেফটেন্যান্ট কর্নেল চক্রবর্তী ‘সিও, ৭৬ বিএসএফ যা মেহেরপুর সীমান্তের ভারতে মোতায়েন ছিল-এর কাছে। দ্বিতীয় চিঠি আমি ভারতবর্ষের জনগণকে উদ্দেশ্য করে পাঠাই। দু’টো চিঠিতেই আমি আমার দস্তখত এবং সরকারী সিলমোহর ব্যবহার করি। দ্বিতীয় চিঠিটা ‘অমৃত বাজার’ এবন যুগান্তর, পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ২৭/২৮/২৯/৩০ মার্চ-এর সংখ্যাগুলোতে। ‘ডেষ্টিনেশন মুজিবনগর’ নামক বইটিতে একটি চিঠির ফটোষ্টেট কপি মুদ্রিত হয়েছে। প্রথম চিঠিটা নদীয়ায় জেলা প্রশাসক মিঃ মুখার্জীর কাছে লেখা হয়েছিল। কর্নেল চক্রবর্তী আমাকে বলেছিলেন যে, এই চিঠিটা দিল্লীতে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে অনতিবিলম্বে প্রেরণ করা হয়েছিল এবং তারই ফলস্বরূপ ২৯শে মার্চ আমি বেতাই বিওপিতে যায়। নদীয়া জেলা প্রশাসক এবং কর্নেল চক্রবর্তী আমাকে সাদরে গ্রহণ করে এবং স্থানীয় বিএসএফ-এর একটি ছোট দল গার্ড অব অনার পরিদর্শন করি। নদীয় জেলা প্রশাসক আমাকে বাংলাদেশের আনঅফিসিয়াল দূত হিসেবে মর্যাদা দেন। আমাদের বৈঠক এক ঘন্টাকাল স্থায়ী হয়। আপ্র্যায়ন মাধ্যমে মিঃ মুখার্জী আমাকে জানান যে, আমার চিঠির উত্তরে ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়া আমাকে শীঘ্রই জানান হবে এবং তাঁর উর্ধধতন কর্তৃপক্ষের কাছে থেকে নির্দেশের অপেক্ষা করছেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি আমাদের সংগ্রামে ভারতের জনগণের ও সরকারের সমর্থনই জানান। পড়ে বলেন, আমি যেন ৩০শে মার্চ আবার চুয়াডাঙ্গা সীমান্তে চেংখালী চেক পোষ্টের অদূরে ভারতীয় বিওপিতে কোন একজন সামরিক অফিসারকে সাথে নিয়ে দেখা করি আমাদের সামরিক প্রয়োজন সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা করার জন্য। ইতিমধ্যে চুয়াডাঙ্গার তদানীন্তন ইপিআর- এর উইং কমান্ডার মেজর ওসমানের সাথে আমার যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ৩০শে মার্চ সকালে মেহেরপুর থেকে ১৮ মাইল দূরে চুয়াডাঙ্গায় মেজর ওসমানের সাথে এ ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করতে যাই। চূয়াডাঙ্গার মেজর ওসমান কুষ্টিয়া আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়ে অত্যন্ত ব্যস্ত থাকায় তিনি পরামর্শ দেন যে, আমি যেন আমার অতি প্রিয় ছেলেবেলার বন্ধু এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ কমরেড-ইন-আর্মস জনাব মাহাবুবউদ্দিন আহম্মদ (তদানীন্তন ঝিনাইদহের এলডিপিও)-কে সাথে নিয়ে যায়। আমি মাহবুবকে টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করি। কিন্তু অল্প সময় পরে হঠাৎ সে মেজর ওসমানের চুয়াডাঙ্গা অফিসে আবির্ভূত হয়। মাহবুবকে আমি ভারতীয় উর্ধবতন কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবহিত করি এবং তাকে বলি ঐদিন সন্ধ্যায় ভারতের চেংখালী চেকপোষ্ট বিওপি তো কিছু সামরিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমার সাথে আসতে এবং এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের সাথে বিশদ আলোচনা করতে। আমি তখন অত্যাধিক উত্তেজিত ছিলাম। আমি লক্ষ্য করলাম মাহবুবও কম উত্তেজিত ছিল না। কারণ একটূ পড়ে বুঝতে পারলাম মাহবুব আমাকে অদূরবর্তী একটি জীএর কাছে নিয়ে চলল এবং খুব গোপনে বলল (মেজর ওসমানও এ ঘটনা সম্বন্ধে তখনও অবহিত ছিলেন না) যে, ঐ জীপে ২জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বসে আছে এবং তারা হচ্ছে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ (বর্তমান অর্থমন্ত্রী) এবং ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম (বর্তমান খাদ্য প্রতিমন্ত্রী) আমরা দু’জনে জীপের ভেতরে প্রবেশ করলাম। শার্ট এবং লুঙ্গি পরিহিত এবং পুটুলি হাতে পরিশ্রান্ত ক্লান্ত এই দু’ব্যক্তিওই অবশ্য। পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। আলাপ-আলোচনার পর বুঝতে পারলাম তাঁরা বিভিন্ন জনপদ ঘুরে ঝিনাইদহে এসেছেন এবং সেখা থেকে মাহাবুব তাদেরকে মেহেরপুরে নিয়ে আসে এই উদ্দেশ্যে যে, তাদেরকে যেন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে পৌঁছানো যায়। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তান সরকারের বিশ্বাসঘাতকতা এবং সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ এবং আক্রমণকে পরাভূত করে বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য বন্ধু প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সাহায্য এবং সহযোগিতার ব্যবস্থা করা। সত্যি বলতে কি, তাঁদের এই বৃহত্তর প্রচেষ্টার তাৎপর্য আমি তখন উপলব্ধি করতে পারিনি। সিদ্ধান্ত হল যে, ভারত সরকারে উর্ধবতন কর্তৃপক্ষের সাথে আমাদের পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বৈঠকে মিলিত হব। জনাব তাজউদ্দীন আহমদ এবং ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলামের সীমান্তের ওপর দিকে যাবার ব্যবস্থা করা হবে। শর্ত হল একটা, আমরা যাঁদের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি তাদের কাছে এই দু’জনের পরিচয় গোপন রাখব। তাঁরা জানতে চাইলে আমরা বলব, এই দুই ব্যক্তি আমাদের পরিচিত। বিকালে সীমান্তের উদ্দেশ্যে দুটো জীপ গাড়ি রওয়ানা দেয়। পথে নানা রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছিল। আমরা ব্যারিকেড সরিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলাম। আমাদের গাড়িতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড্ডীয়মান ছিল। রাস্তার দু’পাশে জনতা মুহূর্মূহু জয় বাংলা জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে আমাদেরকে সম্ভর্ধনা জানাচ্ছিল। এই দুটো জীপ গাড়ি যেন তাদের কাছে স্বাধীনতা শক্তিশালী প্রতীক হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছিল। এরা অনেকেই আমাদেরকে চিনত। গ্রামবাসীরা বুঝতে পেরেছিল যে, আমরা কোন গোপন মহৎ সামরিক উদ্দেশ্যে সীমান্তে ঘোরাফেরা করছি। পথে পথে দেখতে পেলাম স্বতঃস্ফূর্ত জনতা প্রতিরোধ গড়ে তুলছিল, অস্ত্র বলতে ছিল হয়ত একটা দুটো শর্টগান। তখনই এদের মধ্যে জন্ম নিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের নিইক্লিয়াস, এবং আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম যে, ভবিষ্যত প্রস্তুতি, সামরিক প্রতিরোধ এবং সংঘর্ষে শক্তি এবং প্রেরণা এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অথচ দলবদ্ধ জনতাই জোগাবে। সন্ধ্যার পরে পড়ে আমরা চেংখালী চেকপোষ্টে পৌঁছলাম। বড় বড় শিরিষ গাছের সারি দু’পাশে থেকে রাস্তায় উপরে একটা লম্বা ছাতার মতো আবরণ সৃষ্টি করেছিল। কোন লোকালয় দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল না, চারদিক খাঁ খাঁ করছিল এবং অপসৃয়মান গোধূলীর আলোয় সমস্ত এলাকায় থমথমে আলৌকিক, অশরীরী পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। শুক্লপক্ষের ম্লান চাঁদের আলো পরিবেশকে আরো গভীরতর করে তুলেছিল। পেছনে গাড়ি দুটো রেখে আমি এবং মাহবুব ধীরে সতর্কতার সাথে অপরিচিত গন্তব্যস্থানের দিকে আন্দাজের উপর ভোর করে এগুচ্ছিলাম। বার বার আমাদের গায়ের লোম শিউরে উঠেছিল। প্রায় আধ মাইল চলার পর সামনে একটা পাকা ঘরে ধ্বংসাবশেষ দেখতে পেলাম, আমরা বুঝতে পারছিলাম না আমরা কোথায় যাচ্ছি। হঠাৎ সেই ভূতুড়ে ধ্বংসস্তুপ থেকে যেন এক অশরীরী আত্মার আওয়াজ শুনতে পেলাম ‘হলট’। যদিও আমরা একটু ভড়কে গিয়েছিলাম তবুও অনতিবিলম্বে ঝোপের আড়াল থেকে একটা মানুষের ছায়া বের হয়ে এল। এবং সেটা ছিল ভারতীয় বিএসএফ-এর একজন সিপাহী, আমাদের পরিচয় দেবার পর সে আমাদেরকে তাদের বিওপিতে নিয়ে চলল। আরো আধ মাইল চলার পর আমরা বিওপিতে পৌছালাম এবং আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন উচ্চাপদস্থ কর্মচারী জনাব গোলক মজুমদার এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল চক্রবর্তী। আনুষাঙ্গিক আলোচনার পর দুটো সিদ্ধান্ত নেয়া হলঃ ১। আমাদেরকে আগামীকাল থেকে সামরিক অস্ত্রসস্ত্র দেয়া হবে এবং ২। ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষের সাথে আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদদের যোগাযোগ করিয়ে দিতে হবে এবং যথাসম্ভব প্রচেষ্টা চালাতে হবে বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবের সাথে যোগাযোগ করার। তখনও তারা জানতেন না যে, আমাদের সাথে জনাব তাজউদ্দীন এবং ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম রয়েছেন। আমি এবং মাহাবুব নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে ঠিক করলাম যে, আমাদের সাথে যে তাজউদ্দীন রয়েছেন তা গোলক মজুমদারকে জনাব এবং গোলক মজুমদারকে জানালাম। গোলক মজুমদার আনন্দে উচ্ছ্বাসিত হয়ে তাড়াতাড়ি তাজউদ্দিন সাহেবকে তাঁর কাছে নিয়ে আসতে বললেন। আমরা তাজউদ্দীনকে তাঁর কাছে নিয়ে এলাম। তাঁরা একে অপরকে আন্তরিকভাবে করমর্দন এবং আলিঙ্গন করলেন। গোলক মজুমদার আমাদেরকে বলেছিলেন যে, কলকাতার দমদম বিমান বন্দরে একটি সামরিক জেট বিমান অপেক্ষা করছে। যদি কোন রাজনীতিবিদ আসে তবে তাঁকে যেন তক্ষুণি দিল্লীতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। হয়ত ঐ প্লেনেই জনাব তাজউদ্দীন এবং ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম দিল্লীতে গিয়েছিলেন। রাতে আমরা এক সাথে খাবার খাই। গোলক মজুমদার তাজউদ্দীন এবং ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলামকে নিয়ে যান। এবং আমরা চুয়াডাঙ্গা অভিমুখে যাত্রা করি। এই সাক্ষাৎকারের পর ভারত থেকে আমরা কম-বেশি অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ এবং জ্বালানি পেতে থাকি। আমি নিজে প্রায় এক পক্ষকাল ধরে একা সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র ভারত থেকে নিয়ে আসতাম। এই সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র চেংখালী চেকপোষ্টের বিপরীত দিকে ভারতীয় বিওপি থেকে নিয়ে আসতাম। আমি প্রায় প্রত্যেক সন্ধ্যায় ভারত সীমান্ত অভিমুখে চুয়াডাঙ্গা থেকে যাত্রা করতাম। সাথে থাকত ইপিয়ার-এর দুটো এসকর্ট পেট্রল, কয়েকটা ট্রাক এওং কোন কোন সময় দর্শনা চিনিকলের ট্রাক্টর এবং তার সাথে লাগানো ট্রলী। এই অস্ত্রশস্ত্র গ্রহণ করার সময় আমি ভারতীয় কাগজপত্র দস্তখত করে নিতাম এবং মেহেরপুরের এসডিওর সরকারী সীলমোহর ব্যবহার করতাম। মধ্যরাতের দিকে আমরা ভারতীয় বিওপিতে পৌছাতাম এবং চুয়াডাঙ্গা ফেরত আসতে আসতে অধিকাংশ সময়েই ভোর হয়ে যেত। এই সময় এক নাগাড়ে আমি দশ দিনের মতো বিছানায় গাঁ লাগাতে পারিনি। অস্ত্রশস্ত্র দেবার সময় অনেক সময় কর্নেল চক্রবর্তী থাকতে এবং সব সময় ক্যাপ্টেন মহাপাত্র থাকতেন। এপ্রিল মাসের ১০ তারিখ থেকে আমরা অস্ত্রশস্ত্র বেতাই বিওপি (যা মেহেরপুর মহকুমার সংলগ্ন ছিল) থেকে সংগ্রহ করতাম।
২৫ শে মার্চ রাতে মেহেরপুর চুয়াডাঙ্গা এবং কুষ্টিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। কুষ্টিয়া এবং চুয়াডাঙ্গা খবরাখবর আমরা নিতে থাকি। আমরা খবর পাই যে, চুয়াডাঙ্গায় অবস্থিত ইপিআর বাহিনী বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে এবং মেজর ওসমান চুয়াডাঙ্গায় নেতৃত্বে দিচ্ছেন। আমি জানতে পেরেছিলাম যে, চুয়াডাঙ্গার সাধারণ ইপিয়ার-এর জোয়ানরা সম্মিলিতভাবে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে এবং বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছে। চুয়াডাঙ্গার এই সিদ্ধান্তে ইপিয়ার-এর সাধারণ সৈনিকদের মূখ্য ভূমিকা এবং ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের এই সাহসিকতা এবং দেশপ্রেম বাংলাদেশের এই এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখা উচিত। চুয়াডাঙ্গায় অবস্থিত ইপিআর-এর ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী ভূমিয়া এই ঐতিহাসিম সিদ্ধান্তে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। মেজর ওসমান কুষ্টিয়া থেকে ২৭/২৮শে মার্চ চুয়াডাঙ্গা আসেন এবং তিনিও এই সিদ্ধান্তের প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানান। দু’জন সামরিক অফিসারের নেতৃত্বে খাকি পোশাক পরিহিত এবং সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই ইপিআর বাহিনী কুষ্টিয়া জেলা, পাবনা জেলার বহুলাংশে যশোরের কিয়দংশ, এমন কি ফরিদপুরের গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত বাংলার সাধারণ জনগণের চোখে স্বাধীনতার সূর্য সৈনিক হিসেবে প্রতীয়মান ছিল। আজ শহীদ হাবিলদার মেজএর মজিবুর রহমান, সুবেদার মুজাফর, সুবেদার মুকিত এবং আরো অনেক চেনা মুখের কথা বার বার মনে পড়ছে। সে দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে এরা আমার জন্যও আশার প্রতীক হিসেবে প্রোজ্জ্বল ছিলে। দু’এক দিনের মধ্যেই চুয়াডাঙ্গার সাথে মেহেরপুরের যোগাযোগ স্থাপতি হয় এবং আমি মেজর ওসমানের সাথে চুয়াডাঙ্গার সাক্ষাৎ করি। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ আলোচনার বিষয়বস্তু তাঁকে অবহিত করি। মেজর ওসমান আমাকে প্রয়োজনীয় সামরিক অস্ত্রশস্ত্র সম্বন্ধে ধারণা দেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, গোয়ালন্দের তৎকালীন এসডিও জনাব শাহ্‌ মোহাম্মদ ফরিদ সস্ত্রীকে মেহেরপুরে বেড়াতে এসে আটকা পড়ে যান। তাকে মার্চের ২৭/২৮ তারিখ গোয়ালন্দে ফেরত যাবার বন্দোবস্ত করি। জনাব ফরিদ তার স্বীয় মহকুমায় এই স্বাধীনতা সংগ্রামকে জোরদার করার জন্য অত্যাধিক উৎসাহ দেখা এবং এই দুর্যোগের সময় গোয়ালন্দে ফেরত যায়। তিনি পরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন এবং অমানুষিক ভাবে নির্যাতিত হন। তিনি ১৯৭১-এর ডিসেম্বর মাসে মুক্তি পান।
চুয়াডাঙ্গাতে ইতিমধ্যে কিছু সিদ্ধান্ত এবং কর্মসূচি নেয়া হয়েছিলঃ ১। ইপিআর উইং হেডকোয়ার্টার চুয়াডাঙ্গা এবং তার অধীনস্থ বিওপিতে সমস্ত অবাঙালি ইপিআরকে নিরস্ত্র করা, ২। কুষ্টিয়া জেলার পাকিস্তান সেনাবাহিনী মোতায়েন সম্বন্ধে বিশদ খবরাখবর সংগ্রহ করা, ৩। কুষ্টিয়ার উপর একটা আক্রমণ পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করা। এই মিশনের জনশক্তি যোগাবে একদিকে ইপিআর, অন্যদিকে আনসার, মুজাহিদ এবং সাধারণ ছাত্র-জনতা। আক্রমণ এবং অবরোধ মোটামুটি ত্রিমুখী হবে। এই দিকে জনাব মাহাবুবউদ্দীন আহম্মদ ঝিনাইদহ কুষ্টিয়া রাস্তা অবরোধ করবেন এবং ইপিআর, আনসার, মুজাহিদদের একটি দল কুষ্টিয়া অভিমুখে অগ্রসর হবে। অন্যদিকে মেহেরপুর থেকে ইপিআর, মুজাহিদ, আনসারের একটি দল কুষ্টিয়া অভিমুখে যাবে। অপরদিকে প্রাগপুর ভেড়ামারা-কুষ্টিয়া থেকে ইপিআর বাহিনী কুষ্টিয়া অভিমুখে অগ্রসর হবে। এই সম্মিলিত বাহিনীর নেতৃত্ব দেবে ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী। প্রথম সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল যেম এক আক্রমণ ২৯শে মার্চ ভোর পাঁচটার সময় শুরু করা হবে। পরে এই সিদ্ধান্ত ২৪ ঘন্টা পিছিয়ে দেয়া হয়।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের অনধিক দুই কোম্পানি সৈন্য কুষ্টিয়ার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো পাহারা দিচ্ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, ২২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেকি এবং সাপোর্ট ব্যাটালিয়নে একটা অংশ ছিল। এদের ফায়ার পাওয়ার, মোবিলিট এবং কমিউনিকেশন পাকিস্তানের অন্যান্য সাধারণ পদাতিক ব্যাটিলিয়নের চেয়ে অনেক বেশী ছিল। শহরের উপকণ্ঠে, অনেকটা অবরোধের মতো, প্রথমে মুক্তিবাহিনিকে-যারা মধ্যে ইপিআররা ছিলেন মূলশক্তি-মোতায়েন করা হয়। অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে ছিল পুরনো ৩০৩ রাইফেল এবং কিছু পুরনো এসএমজি। ইপিআর ছাড়া আনসার এবং মুজাহিদদের কাছে ১০ রাউণ্ড বা অনুর্ধ ২০ রাউণ্ডের মতো গুলি ছি ৩০ শে মার্চ সকালে অবরোধ স্থানগুলো থেকে যুগপৎভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিভিন্ন অবস্থানের উপর অতর্কিত গুলিবর্ষণ শুরু করা এবং সাথে সাথে আমাদের প্রত্যেকটি অবস্থানের পেছনে সম্বেত হাজার হাজার লোক গগন বিদারী আওয়াজে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি তোলে এবং শ্লোগান দিতে দিতে মুক্তিযোদ্ধারা অগ্রসর হতে থাকে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই অতর্কিত আক্রমণে, জনতার এই আকাশটা চিৎকার এই রাইফেল ছাড়াও কিছু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের আওয়াজে দিশেহারা এবং ভীতসস্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। এটা তাদের কল্পনাতীত ছিল যে, বাঙালি ইপিআর- এর জোয়ানরা ঐ অল্প সময়ের মধ্যে তাদের নিজেদের সংগঠিত করে সুসজ্জিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিক্ষিপ্ত দলগুলো এই আক্রমণের মুখে তাদের কুষ্টিয়া সেনাবাহিনী সদর দফতরের দিকে পিছিয়ে পড়তে থাকে। তাদের এই পশ্চাদপসরণে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস মনোবল দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য এই আক্রমণ ছিল সম্পূর্ণ বিভ্রান্তজনক। কারণ তারা বুঝতে পারেনি কারা কোথা থেকে তাদের উপর আক্রমণ চালাচ্ছে এবং কেন? এই পশ্চাদপসর তাদের জন কাল হল। কারণ প্রত্যেকটা ঘটনার সাথে সাথে তাদের মনোবল ভেঙ্গে যাচ্ছিল এবং আমাদের মনোবল উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এভাবে যুদ্ধ সারাদিন চলতে থাকে। সন্ধ্যার দিকে তারা তাদের অবস্থান থেকে পুল আউট করে কুষ্টিয়া জেলাস্কুল এবং সার্কিট হাউসে একত্রিত হতে থাকে এবং এটাই তাদের জন্য কাল হয়। আমার তাদের দিকে অগ্রসর হতে থাকি। আমাদের অবরোধ তিন দিক থেকে এসে জেলা স্কুল এবং সার্কিট হাউস ঘিরে ফেলে, যদিও তখন পর্যন্ত কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ রাস্তার কয়েক মাইল জনশক্তির অভাবে আমাদের আয়ত্তধীন ছিল না। পরে অবশ্য আমরা এই দল থেকে বন্দি লেফটেন্যান্ট আতাউল্লার কাছে থেকে জানতে পারি যে, মেজর শোয়েব এবং অন্যান্য অফিসাররা র-ইনফোর্সমেন্ট-এর জন্য বার বার অনুরোধ জানাচ্ছিল যশোর সদর দফতরকে। কিন্তু যশোর দফতর তাদেরকে কোন সাহায্যের আশ্বাস দিচ্ছিল না। এর তথাকথিত দুর্ধর্ষ ২২ এফ এফ সেনাবাহিনী একেবারে ইঁদুরের মতো হয়ে যায়। তারা পালাবার পথ খুঁজতে শুরু করে। ৩১শে মার্চ থেকে তারা পলায়ন করতে শুরু করে। মুক্তিবাহিনী সাথে সংঘর্ষে আনুমানিক ২০ জন পাকিস্তানী সৈন্য হতাহত হয়েছিল। বাকি দুই কোম্পানি অনাধিক সৈন্য সবাই জনতার সাথে সংঘর্ষের নিহত হয়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, কুষ্টিয়া হতে ঝিনাইদহের পথে একটা পুলের উপর মুক্তিবাহিনী একটি খাদ খনন করে ক্যামোফ্লেজ করে রেখেছিল। মেজর শোয়েব এবং ২২ এফ, এ-এর কিচুহ অফিসার এবং সৈনিক গাড়িতে করে যশোরের দিকে পশ্চাদপসরণ করার সময় এই খাদে পড়ে যায় এবং তারপর যারা বাঁচতে পেরেছিল তারা পার্শ্ববর্তী গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলার সাধারণ মানুষের এই সময়কার সাহসিকতা পৃথিবীর ইতিহাসেও বিরল। তাদের স্বয়ংক্রিয় মরণাস্ত্রের বিরুদ্ধে অনেক সাধারণ বাঙালি। তবুও ২২ এফ এফ-এর কেউ শহরে ফিরে যেতে পারেনি। কুড়াল, কাস্তে বা কোন সময় একেবারে খালি হাতে কোন সময় বা গাছ থেকে অতর্কিত সাধারণ জনগণ এদের মোকাবেলা করে। আমরা ১লা এপ্রিল থেকে অনবরত এই গ্রামের লোকজেরন কাছ থেকে অস্ত্রশস্ত্র পেতে থাকি যা তারা পাকসেনাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। আজও একটা কিশোরের কথা মনে পড়ে, যে একটা শটগান নিয়ে তিনজন পাকসেনাকে অনুসরণ করে, যাঁদের হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ছিল। সে নিজেদের বুদ্ধিবলে শট গান দিয়ে তিনজন পাকসেনা খতম করে এবং ওদের অস্ত্রশস্ত্র আমাদের কাছে জমা দেয়। পরে কুষ্টিয়া মুক্তিবাহিনীর দখলে আসার পর আমাদের দখলীকৃত অস্ত্র সম্ভারের হিসাব নিতে গিয়ে আমরা আশ্চর্য হয়ে যাই। যে অস্তশস্ত্র ফেলে ২২ এফ এফ পশ্চাদপসরণ করে, মনোবল থাকলে ঐ অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে তারা এক পক্ষকাল যুদ্ধ করতে পারত। হয়ত আমাদেরকে পরাজিত করতে পারত। ২২ এফ-এর এই পরাজয় এবং মুক্তিবাহিনীর জয়ে আমাদের মনোবল দ্বিগুণ বেড়ে যায়। আমরা বিশ্বাস করতে থাকি আমাদের বিজয়ের গতি অপ্রতিহত থাকবে এবং অচিরেই পদ্মার পার আমরা পুরোপুরি মুক্ত করতে পারব। কিন্তু সামরিক জ্ঞানের অভাবে আমরা বুঝতেও পারিনি যে, এক সুসজ্জিত সেনাবাহিনী কীভাবে আমার মরণ কামড় হানতে পারে। আমার যতদূর মনে পড়ে কুষ্টিয়াতে আমরা ৩৫টি গাড়ি, ৬টি আর আর গানসহ শতাধিক রাইফেল, এলএমজি এবং ভারী মেশিনগান এবং প্রচুর গোলাবারুদ দখল করি, যা দিয়ে আমরা মুক্তিবাহিনীকে সজ্জিত করতে থাকি। এই দখলীকৃত অস্ত্রসম্ভার এবং গাড়ি আমরা চুয়াডাঙ্গায় এনে জনগণকে প্রদর্শন করি, যা অনেক বিদেশী সাংবাদিক এবং টেলিভিশন সংস্থা পর্যবেক্ষণ করে। এই সম এপ্রিলে প্রথম সপ্তাহে কোন একদিন একটি ফারসী-স্পেনিশ টেলিভিশন সংস্থার প্রতিনিধির সাথে সাক্ষাৎকার দেয়ার সময় ৩টি পাকিস্তানী স্যাবর জেট চুয়াডাঙ্গা আক্রমণ কএ এবং আধঘন্টা পর্যন্ত কয়েক জায়গায় বোমাবর্ষণ করে। এই টেলিভিশন সংস্থা অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে এই ঘটনার পুরোপুরি আলোকচিত্র গ্রহণ করে, যা সারা বিশ্বে তুমুল আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল। এই ছবিগুলো নিশ্চয়ই বিশ্ববিবেককে জাগ্রত করতে বিশেষ ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করছিল।
এই সময় মুক্তিবাহিনীর ক্ষুদ্র একটি দলকে কুষ্টিয়ায় রেখে আমরা নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করি। আমরা যশোর থেকে মাত্র কয়েক মাইল উত্তরে বিশালখালীতে আমাদের প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তুলি। মাহাবুব এই এলাকার সামরিক নেতৃত্ব গ্রহণ করে। বিশালখালীতে আমাদের দু’কোম্পানিও কম সৈন্য ছিল। উত্তর পূর্বে আমরা হার্ডিঞ্জ ব্রীজের উভয় পার্শ্বে ঢাকা হতে আক্রমণ প্রতিহত করার প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি করি। হার্ডিঞ্জ ব্রীজে আমাদের দু’প্লাটুনেরও কম ইপিআর জোয়ান ছিল। এই সময় আমরা ফরিদপুর, গোয়ালন্দ, পাবনা, নাটোর, এমনকি নওগাঁর সাথেও যোগাযোগ স্থাপনে সক্ষম হই। এই সমকার টেলিফোন কর্মচারীদের সহায়তা এবং তাদের দেশপ্রেম আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উপরোল্লিখিত কয়েকটী জায়গার সাথে আমরা সবসময় যোগাযোগ রক্ষা করেছিলাম। রাজশাহী এবং পাবনায় পাকসেনাদের তৎপরতা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের পরিকল্পনা সম্বন্ধে অবহিত ছিলাম। গোয়ালন্দ মহকুমার প্রশাসক শাহ্‌ মোহাম্মদ ফরিদের অনুরোধে, আমরা একটি ক্ষুদ্র ইপিআর বাহিনীকে গোয়ালন্দে শত্রুকে মোকাবেলা করার জন্য প্রেরণ করি। এমন কি আমরা পাবনা দখলের পর নগরবাড়ী ঘাটে শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য ক্ষুদ্র একটি বাহিনী প্রেরণের প্রস্তুতি নিই। মোহাম্মদ তৌফিক ই-এলাহী চৌধুরী সাক্ষাৎকার।
[১০৮] রাজিব আহমেদ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত