কুড়িগ্রাম প্রতিরোধ, রংপুর
তারিখটা ছিল এপ্রিলের ১৪। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আসবে কুড়িগ্রাম। দখলে নিতে চায় শহর। সেজন্য তারা গ্রুপ গঠন করে রংপুর সেনানিবাসে। একই সাথে লালমনিরহাটেও গঠিত হয় আর একটি গ্রুপ। মিলিত হয় তারা এক সাথে। অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং খাদ্য বোঝাই করে ট্রেনে। তারপর নিজেরাও চড়ে সে ট্রেনে। লৌহ শকট রওনা করে কুড়িগ্রামের দিকে। শহরে আবার হায়েনার দল আসছে। এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। ততক্ষণে সংগঠিত হয়ে যায় মুক্তিসেনারা। অবস্থান নেয় রেল সড়কের কাছাকাছি স্থানে। অপেক্ষমাণ তারা হায়েনা শিকারে। এক সময় অপেক্ষার পালাও সমাপ্ত হয়। আসতে থাকে দীর্ঘ ট্রেন। ভেতরে মানুষরূপী হায়েনাগুলো। হাতে তাদের আগ্নেয়াস্ত্র। অনর্গল টেনে যাচ্ছে ট্রিগার। ঝরছে বুলেট। বিদ্ধ হচ্ছে তা গ্রামবাসীর বুকে, পিঠে। মস্তিকে। ধ্বংস করছে ঘরবাড়ি- জনপদ। আগুন ধরিয়ে দিয়ে যাচ্ছে গ্রামের পর গ্রামে। শহর-জনপদ সবই ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে অগ্রসর হচ্ছে সামনের দিকে। মানুষ এমন বর্বর হটে পারে-তা তো ভাবতে পারেনি কেউ। নির্বিচারে নিরীহ মানুষ হত্যা করতে পারে শ’ইয়ে শ’ইয়ে হাজারে, হাজার, এমনকি লাখে লাখে। তা শুধুই পাকিস্তানী সৈন্যদের পক্ষে সম্ভব। পাকিস্তানী মানুষখেকো দানবগুলো মানুষ হত্যা করতে করতে অগ্রসর হচ্ছিল। আর বাংলার দামাল ছেলেরা ওত পেতে থাকে পশু হত্যা করার লক্ষ্য নিয়ে। নরপিশাচরা শহরের কাছাকাছি আসার পরই গর্জে ওঠে মুক্তিসেনাদের হাতের অস্ত্র। তুমুল প্রতিরোধ। তাতে নাস্তানাবুদ হয়ে যায় পাকিস্তানীরা। প্রাণপণে লড়াই করেও সামনে অগ্রসর হটে সমর্থ হয়নি। অবশেষে রণে ভঙ্গ দেয় তারা। কিন্তু পেছনের দিকে অকল্পনীয় বর্বরতা চালায় তারা। কুড়িগ্রাম নতুন রেলওয়ে স্টেশনের কাছ থেকেই ট্রেন নিয়ে পালাতে থাকে। হম সিগন্যালের কাছে থাকাকালে চাকলাপুকুর এলাকা থেকে মুক্তিসেনারা আক্রমণ করে ট্রেনে। পাকবাহিনী ঢুকে পড়ে কালে মৌজায়। একটির পর একটি গ্রামে ঢুকে তারা, আর ছড়িয়ে দেয় প্রতিটি বাড়িতে আগুনের লেলিহান শিখা। দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। আকাশে উঠছে শিখা। মনে হচ্ছে যেন পুরো আকাশই জ্বলেপুড়ে ধোয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। আগ্নেয়ান্ত্রের মুহুর্মুহু গর্জন। ধোয়ায় অন্ধকার সমগ্র মৌজা। এমনিতেই লোকজন তেমন গ্রামে ছিল না। তিস্তা যুদ্ধের পর থেকে অনেকে এলাকা ছেড়ে চলে গেছে নিরাপদ স্থনে। তারপরও যারা ছিল তারাও ট্রেনে পাকিস্তানীদের আগমন সংবাদ শুনে পালিয়ে গেছে আর অবশিষ্ট যারা অবস্থান করছিল তখন পর্যন্ত, তাদের পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলি করে হত্যা করে পা হায়নারা। এভাবে কত লোককে হত্যা করেছে তাঁর সঠিক সংখ্যা আজও জানা যায়নি। কালে মৌজার সফর উদ্দিন ডাক্তার ছিলেন এলাকার অতি পরিচিত ছিল। সমাজসেবক, শিক্ষানুরাগী, জনপ্রতিনিধি এবং চিকিৎসক। অনেক পরিচয়ে পরিচিত ছিল তার। কিন্ত কুড়িগ্রামের মানুষের কাছে শুধু নামেই ছিল পরিচিত। অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তিনি। ছিলেন রেল্গাছি ইউনিয়ন কাউন্সিলের জনপ্রিয় চেয়ারম্যান। বয়স তখন ষাটের ওপরে। ৭ এপ্রিল পাকিস্তানী সৈন্য বাহিনীর গুলিতে যারা আহত হয়েছিলেন তাদেরও অনেক চিকিৎসা করেছেন ডা. সফর উদ্দিন আহমদ। সকালবেলাতেই প্রচণ্ড গুলির শব্দে কান তাঁর ঝালাপালা। দরজা খুলে বেরোতেই ধোয়ায় অন্ধকার ধরিত্রী। কুড়িগ্রামের আকাশ ছুই ছুই করছে আগুনের লেলিহান শিখা। কোনো কিছু আঁচ করতে পারছেন না। বেরিয়ে পড়েন ঘর থেকে। সাম্নেই পুকুর। দক্ষিণ পাড় দিয়ে একটু অগ্রসর হয়ে বিষয়টি উপলব্দি করার চেষ্টা করছিলেন তিনি। কিন্ত ততক্ষণে তাঁর বুকে বিদ্ধ হয়েছে একটি বুলেট। পেন্টাগনে তৈরি সিসা খণ্ডটি নিক্ষিপ্ত হয় পাকিস্তানী সেনাদের দ্বারা। মানবপ্রেমিক, মানবতাবাদী ডা. সফর উদ্দিন আহমদ বিনা প্রতিদন্ধিতায় ৫বার নির্বাচিত হয়েছেন ইউনিয়ন পরিষদে। জনতার স্নেহ-ভালোবাসা পেয়েছেন আজীবন। প্রতিষ্ঠা করেছেন খলিল্গঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়, খলিল্গঞ্জ প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মুক্তারাম প্রাথমিক বিদ্যালয়। আরো কত প্রতিষ্ঠানের সাথে, সমাজসেবা এবং সমাজ উন্নয়নমূলক কাজের সাথে জড়িয়ে আছে তাঁর নাম। অথচ তাকেও বাঁচতে দিল না পাকিস্তানী নরপশুরা। অন্যদিকে তাঁর বসতভিটাও গ্রাস করেছে আগুনের শিখা। ছাইভস্মে পরিণত হচ্ছে বাড়ি। সফর উদ্দিন আহমদের বাড়িতে কাজ করতেন পোয়াতু মাহমুদ। বাড়ি নাগাদাপার। দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছেন সফর উদ্দিনের বাড়িতে, তারই সাথে জীবনও দিয়ে গেলেন তারা দুজন এক সাথে। ডাক্তারের চাচা অশীতিপর বৃদ্ধ আল্লাহর ঘর তোয়াফ করে এসেছেন। ধর্মকর্ম নিয়েই কাটাতেন বেশির ভাগ সময়। তাকেও জীবন দিতে হলো মানুষ নামক অমানুষদের হাতে। আবদুল লতিফ সফর উদ্দিন আহমদের ভাতিজা। পড়াশোনা করতে রংপুর কারমাইকেল কলেজ। সেখানকার ছাত্রনেতা তিনি। বাড়ি এসে পৌঁছান ঐদিন ভোরেই। আর একটু পরেই প্রাণ দিতে হলো তাঁকে পাকিস্তানী সৈনযদের গুলিতে। ডা. সিফির ইয়দ্দুব আগিনিএদজে গুলি করার সাথে সাথেই পাকিস্তানী সৈন্যটীকে জাপটে ধরেন শাহাবউদ্দিন। লিপ্ত হন তিনি মল্লযুদ্ধে। এক পর্যায়ে পাকিস্তানী সেনাটিকে কাবু করে তার হাতের আগ্নায়াস্ত্রটিকেও কেড়ে নেন। তারপর এর ব্যবহার করে পরপারে পাঠিয়ে দেন দু’দুটি পাকসেনাকে। আর তৃতীয় সৈন্যটিকে টার্গেট করার সময়ই ব্রাশফায়ারে শহীদ হন মুক্তিযোদ্ধা শাহাবউদ্দিন। ততক্ষণে তার বাবা বরিজ উদ্দিন, ভোলানাথও শহীদ হয়েছেন। এই মহান শহীদদের লাশের ওপর দিয়ে এগিয়ে যায় পাকিস্তানী সৈন্যরা। একটির পর একটি বাড়িতে গিয়ে জ্বালায় আগুন। অগ্রসর হয় অন্য গ্রামের দিকে। এমন নারকীয় কর্ম সভ্য জগতে ভাবতেও পারে না। কেউ। অথচ পাকিস্তানী সৈন্যরা তা করেছে পুরো এলাকজুড়ে। কালে মৌজার ডাক্তারপাড়ায় ১৪ এপ্রিল যারা প্রাণ দিয়েছেন তারা হলেঃ ১. ডা. সফর উদ্দিন আহমদ, ২. আলহাজ সজর উদ্দিন আহমদ, ৩. আবদুল লতিফ, ৪. পোয়াতু মাহমুদ, ৫. বরিজ উদ্দিন, ৬. শাহাবউদ্দিন, ৭. ভোলানাথ
শহরে ঢুকতে পারেনি পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে মুক্তিসেনারা। অবশেষে পালিয়ে যাওয়ার সময় চালায় নৃশংসতা। এক সময় পেছনে যেতে যেতে হাজী হয় টোগরাহাইটে। সেখানকার বড় ব্রিজের কাছেই ছিল একটি ইটভাটা। সে ইটভাটাতেই গিয়ে আশ্রয় নেই পাকসেনারা। মুক্তিযোদ্ধারা তাড়া করে তাদের সেখান পর্যন্ত। তারপর আবার যুদ্ধ। পুরো রাতব্যাপী চলে লড়াই। ক্ষণে ক্ষণে গর্জে ওঠে আগ্নেয়াস্ত্র। উভয়পক্ষে চলে গুলিবিনিময়। প্রচণ্ড যুদ্ধে কাটে রাত। সে লড়াইয়ে শহীদ হয়েছেন ছয়জন মুক্তিসেনা। তাদের মধ্যে ১. আমজাদ হোসেন, ২. জয়নাল আবেদীনের নাম পাওয়া গেছে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী টোগরাইহাটেও টিকতে পারেনি শেষ পর্যন্ত। সেখান থেকেও পালাতে হয়েছে। নিহত হয়েছে বেশ কয়েকজন। অন্যরা পালিয়ে যাওয়ার আগে মেতে ওঠে তাণ্ডব পরিণত করে দেয়। চালায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ। সে সময়ই পুড়িয়েছিল আওয়ামী লীগ নেতা আহমদ হোসেন সরকারের বসতবাড়ি। যেখানে ছিল মুক্তিযুদ্ধের হেডকোয়ার্টার। ঐদিনের ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন আজ ৩৬ বছর পরও আছে রেল সড়কের দু’পাশ দিয়ে। সাক্ষ্য দিচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের মহান সংগঠক, আওয়ামী লীগ নেতা আহমদ হোসেন সরকার ভস্মীভূত বাড়ি।
[৪৭] তাজুল মোহাম্মদ
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত