You dont have javascript enabled! Please enable it!

কুড়িগ্রাম জেলা অপারেশন, কুড়িগ্রাম

একাত্তরের ৭ এপ্রিল। প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়েছে তিস্তায়। পাকবাহিনী অগ্রসর হচ্ছে কুড়িগ্রাম শহরের দিকে। নতুন শহরের খলিলগঞ্জে তখন কিছু মুক্তিযোদ্ধা সংগঠিত হয়। তাদের অবস্থান ছিল বর্তমান রেলস্টেশনের কাছে হাই স্কুলে। যেখানে থেকে একটি প্রতিরোধ প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল, যা ব্যর্থ হয়েছে। তারা যখন চলে যায় আরো একটু পেছনে। মাদ্রাসার মোড়ে আবার একটি প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনার প্রচেশষ্টা ব্যর্থ হলে দ্বিতীয়বার পশ্চাদপসারণ করে চলে যায় তারা স্টাফ কোয়ার্টার মসজিদে। সেহান থেকে টার্গেট করা হয় তৃতীয়বার। কিন্তু টিকতে পারেনি তারা সেবারও। শহরে প্রবেশ করে হায়েনার দল। এদিক-ওদিক গণহত্যা চালাতে চালাতে উপস্থিত হয় সার্কিট হাউসে। এর সামনের দালানে ছিল মহকুমা হাকিম আদালত। সেখানে ছোড়ে আর্টিলারি। এপাশ-ওপাশ ছিন্ন হ্যে যায় দালানটির। কাছাকাছিই মহকুমা প্রশাসকের বাসভবন। সেগুলোও রেহাই পেল না হায়েনাদের খপ্পর থেকে। আদালত সার্চ করে তারা। অবশ্য বের হয়ে এসেছে শূন্য হাতে। সার্কিট হাউসের সামনে পজিশন নিয়েছে হায়েনার। তারপর গুলি ছুড়ছে যখন যেদিকে ইচ্ছে। এরই মধ্যে দৃষ্টি নিবন্ধ হলো তাদের কুড়িগ্রাম কারাগারের প্রতি। সামনে রয়েছে কর্তব্যরত পুলিশরা। বাঙালী হয়েও তখন পর্যন্ত ডিউটি করেছে তারা। জেল পুলিশের ইনচার্জ এবং অন্য পাঁচ জন পুলিশের একটি দল পুরো কারাগারের দায়িত্বে নিয়োজিত। কর্তব্য পালন করলে কী হবে এরা তো বাঙালী। তাই পাকিস্তানীরা বিশ্বাস করতে পারেনি। বাঙালী মানেই তাদের শত্রু। তাই হুইসেল বাজিয়ে আহ্বান জানায় পুলিশ বাহিনীকে। একত্র হলো পুলিশরা। পরিচিতি বোঝায় চেষ্টা করে তারা। কী বলতে চাইছে পাকিস্তানীরা? সার্কিট হাউসের দিকে যেতে আহ্বান এটা স্পষ্টই বুঝতে পারল পুলিশরা। কী করবে তা হলে? মিলিটারির আহবান। দেশে অস্বাভাবিক অবস্থা। হাজার হাজার মানুষ হত্যা করছে পাকিস্তানী সৈন্যরা। তা ছাড়া সাত দিনের যুদ্ধ শেষে এসেছে পশুগুলো এখানে। সুতরাং তাদের আহবান উপেক্ষা করতে সাহস করেনি তারা। তাছাড়া প্রতিরোধ করার মতো শক্তিও নেই। নির্দেশ পালন করতেই উদ্যোগী হলো তারা। সারিবদ্ধ হয়ে সার্চ করতে করতে অগ্রসর হলো সামনে। ডানে মোড় নিয়ে সার্কিট হাউসে প্রবেশের আগে রাস্তাতেই হল্ট করায়। সেখানে ছিল এক বিরাট বৃক্ষ। এর নিচে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে বাঙালী পুলিশ। অর্জুন আর কৃষ্ণচূড়া বৃক্ষের নিচে হঠাৎ করেই গর্জে ওঠে পাকিস্তানদের হাতের অস্ত্র। ব্রাশফায়ার। লুটিয়ে পড়লেন সবাই। তাৎক্ষণিক প্রাণ দেন লাল মোহাম্মদ, আনসার আলী, সাজ্জাদ আলী ও জহির উদ্দিন। মাথার ওপরে টুকটুকে লাল কৃষ্ণচূড়া, নিচে কালো পিচঢালা রাস্তাও লালে লাল হয়ে ওঠে। ছোটে রক্তের স্রোত। ধীরে ধীরে শীতল হয়ে যায় তাদের দেহ। অন্যদিকে জেল ইনচার্জ শেখ হেদায়েত উল্লাহ আহত অবস্থায় মৃত্যুর সাথে লড়তে লড়তে রাত ১১টার দিকে প্রাণত্যাগ করেন। আর ষষ্ঠ পুলিশ ছিলেন আবদুল জলিল। তিনি গুরুতর আহত হন। পড়ে কখন কীভাবে কোথায় যান তা জানা যায়নি। তবে স্বাধীনতার পর আবার চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। কুড়িগ্রাম শহর এবং আশেপাশে আরো অনেক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে পাকিস্তানীরা। হত্যা করে অগুনিত মানুষ। কিন্তু ঐদিন তারা কুড়িগ্রাম অবস্থান করেনি। চলে যায় আবার তিস্তার দিকে। এ সময় জেল ইনচার্জ শেখ হেদায়েত উল্লাহর স্ত্রী নিজে গিয়ে কারাগারে তালা খুলে দেন। বের হয়ে আসে সব বন্দি। রাতে বধ্যভূমিতে আসেন তখনকার ছাত্র ইউনিয়ন নেতা হারুন অর রশিদ লাল। সাথে ছাত্র ইউনিয়নেরই মতিউল ইসলাম চৌধুরী (নয়া) ও রজব আলী। তিনজন মিলে তক্তার ওপর তুলে লাশগুলো নিয়ে যান অন্ধকারের সাথে মিশে মিশে। সে রাতে এ ধরনের কাজে নামটা ছিল মারাত্মক সাহসের কাজ। এ সময় হারুন অর রশিদ লালের বড় ভাই আজহারুল ইসলাম রাজা দোয়া-দারুন করে লাশের সাথে কাটান। লাশ বহনুকালেও তিনি হেটেছেন পায়ে পা মিলিয়ে দোয়া করতে করতে। কারাগারের পাশেই ছিল কোয়ার্টার। সেখানে নিয়ে লাশগুলো রাখা হয় একটি বাঁশের মাচায়। পরেরদিন সকালে অনুষ্ঠিত হয় তাদের নামাজে জানাজা। কারাগারের কাছেই তাদের চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। তবে হেদায়েত উল্লাহর লাশ দাফন করা হয় তাঁর একবন্ধু এবং জেলের ফুড সরবরাহকারী বজলুল করিমের বাড়িতে।
[৮৭] মোঃ ছালেহ আহমেদ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!