কুমারখালী অভিযান, কুষ্টিয়া
এ যুদ্ধের পরে পাকহানাদার এবং তাদের সহযোগী রাজাকাররা খুবই নাজুক অবস্থায় পড়ে। থানার সবগুলো রাজাকার ক্যাম্প উচ্ছেদ করার ফলে তারা এসে থানা ক্যাম্পে অবস্থান গ্রহণ করে পুনঃসংগঠিত হতে থাকে। থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হাবিবের নেতৃত্বে বিভিন্ন গ্রুপ নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ মাধ্যমে ৭ ডিসেম্বর থানা আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। হাবিব তাঁর দলসহ কুষ্টিয়া ও কুমারখালীর মধ্যবর্তী কৌশলগত স্থান চড়াইকোল অবস্থান গ্রহণ করেন। আ. রাজ্জাক (থানা সহকারী কমান্ডার) ও খলিল কমান্ডারের নেতৃত্বে তাদের দল শহরেরে উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থান নেয়। খোকশার রঞ্জু আহমেদ এবং ডাঁশার লুৎফর রহমান তাদের দল নিয়ে দক্ষিণ দিক থেকে গড়াই পাড় হয়ে শহরে প্রবেশ করবে। রঞ্জু আহমেদের প্রথম ফায়ার ওপেন করার কথা থাকলেও তাঁর দলের আবদুল জলিল আগেই স্টেশনের ওপর গুলি করে এক বিহারিকে হত্যা করে। ফলে সঠিকভাবে অবস্থান নেয়ার আগেই গোলাগুলি শুরু হয়। পাকবাহিনী সর্বাত্মক আক্রমণ ভেবে প্রতিরোধের প্রস্তুতি না নিয়ে কুষ্টিয়াতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। মুহূর্তের মধ্যেই রাজাকার ও থানার মুজাহিদ-মিলিশিয়া-কর্মকর্তা আত্মগোপন করে। কোনো রূপ প্রতিরোধের প্রস্তুতি ছাড়াই তারা জীবন নিয়ে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা সংবাদ পান যে কুণ্ডুপাড়ার মনসুর ডাক্তার, নজরুল মাস্টার, ফিরোজ প্রমুখের বাড়িতে রাজাকাররা আশ্রয় গ্রহণ করেছে। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে তাদের প্রচণ্ড গুলিবিনিময় হয়। মুক্তিযোদ্ধারা এক প্রকার বিনা প্রতিরোধেই কুমারখালীতে প্রবেশ করেন।
৭ ডিসেম্বর রাতে বদর কমান্ডার ও মোকাদ্দেস কমান্ডারের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা থানা কমান্ডার হাবিবের নির্দেশে কুষ্টিয়া ও কুমারখালীর মধ্যবর্তী কৌশলগত স্থান চড়াইকোলে অবস্থান নেন। তারা সহজেই ‘হাতিসাঁকো’ রেল সেতুটি (কালভার্ট) বিস্ফোরকের সাহায্যে উড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। পরদিন পাকসৈন্যদের কুমারখালী আগমন প্রতিরোধ করতে এট করা হয়। এ রাতেই কমান্ডার হাবিব কৌশলে কাসিমপুরের মিলিশিয়া ক্যাম্পটিও দখলের নির্দেশ দেন। মুক্তিযোদ্ধারা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে একদল উত্তরে বিলের মধ্যে, একদল কয়াতে এবং একদল রাস্তার দক্ষিণে কাসিমাপুরে অবস্থান নেয়। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের কৌশল ছিল যে, তারা নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে কিছু সময় পরপর গড়াই ব্রিজের অবস্থান লক্ষ্য করে গুলি করবে। কমান্ডারেরে অনুমান ছিল যে, রাতে কোনোভাবেই মিলিমিশিয়ারা ক্যাম্পের বাইরে শত্রু খুঁজতে আসবে না। মিলিশিয়ারা মুক্তিযোদ্ধাদের গুলির জবাব অদৃশ্য শত্রুর উদ্দেশে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি বর্ষণ করে। কিন্তু তিনদিক থেকে গুলি আসতে থাকায় এবং তাদের সার্চলাইট শত্রু অবস্থান চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাত্মক আক্রমণ ভেবে মিলিশিয়ারা একমাত্র খোলা পথ পেছনের দিকে কুষ্টিয়া পালিয়ে যায়, বিনা যুদ্ধেই গুটিয়ে যায় কাসিমপুরের মিলিশিয়া ক্যাম্পটি। এরপর ৮ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা শহর ছেড়ে বিভিন্ন দলের সমন্বয় করার জন্য থানার সব জায়গাতেই যোগাযোগ করতে থাকেন। ৯ ডিসেম্বর সর্বাত্মক আক্রমণের সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারিত হয়। পরদিন (৮ ডিসেম্বর) পাকবাহিনী ও মিলিশিয়া খাদ্য প্রভৃতি নিয়ে ব্যাপক প্রস্তুতিসহ পুনঃঅবস্থানের জন্য কুষ্টিয়া থেকে কুমারখালীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। পথিমধ্যে চড়াইকোলে সেতু ভাঙ্গা থাকায় ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়। কিছু রসদ নষ্ট হয় এবং কয়েকজন সৈন্য আহত হয়। এতে পিছু না হটে তারা কিছু সৈন্য রেখে যায় লাইনটি মেরামত করার জন্য এবং ট্রেনিটি পাহারায় রেখে তারা হেঁটেই রওয়ানা দেয়। তারা কুমারখালী ও এর আশেপাশে ব্যাপক হত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। যাওয়ার পথে নাউথীর একটা ছেলেকে মাঠের মধ্যে গুলি করে হত্যা করে। তারা বাটিকামারা গ্রামে আহমদ বিশ্বাস, আ. মজিদসহ ৭ জনকে হত্যা করে এবং গ্রামটি সম্পূর্ণরূপে জ্বালিয়ে দেয়। সেখানে মেয়েদের ওপরও নির্যাতন চালানো হয়। শেরকান্দিতে বাঙালী পরিবারের ৭ জনকে, তেবাড়িয়াতে মুক্তিযোদ্ধা শফি ও রাজ্জাকের পিতা যথাক্রমে আ. আজিজ মোল্লা ও শাহাদাৎ হোসেন এবং সাইফুদ্দিন বিশ্বাস ও তার ছেলে রবিউল ইসলাম, কাঞ্চন কুণ্ডুকে হত্যা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সময়ে সহযোগিতা করার কারণে মুক্তিযোদ্ধা নিলুর পিতা তোসাদ্দেক হোসেন ননী মিয়, স্বপন ও এলঙ্গীর আনসারকে হত্যা করে। এছাড়া ব্যাপক লুটপাট-অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র কুমারখালীকে বিধ্বস্ত শহরে পরিণত করে। এভাবে পাকবাহিনী তাদের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে সচেষ্ট হলেও সারাদেশে তাদের অবস্থানের পতন ঘটতে শুরু করে। একই দিনে শৈলকুপাতে তাদের চূড়ান্ত পতন হলে কুষ্টিয়াতে সুদৃঢ় অবস্থানের জন্য তারা কুমারখালী ত্যাগ করে।
[৫৯৪] এ.টি.এম. যায়েদ হোসেন
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত