You dont have javascript enabled! Please enable it!

কুতুবকাঠির যুদ্ধ, পিরোজপুর

পিরোজপুরের পাকসেনা ক্যাম্প ১৫ এফ এফ রেজিমেন্টের হেডকোয়ার্টারের বারান্দায় পায়চারি করছে ক্যাপ্টেন এজাজ হাত দুটো তার কোমরেরে পিছনে। গভীর চিন্তায় সে মগ্ন। এই মাত্র অয়ারলেস “সিট রেপ” (Situation Report) এসেছে যে কাউখালী থানার কুতুবকাঠি গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা গোপন “হাইড আউট” (গোপন আশ্রয়) এর সন্ধান পাওয়া গেছে। কাউখালী থানার ওসি কনফার্ম করেছে যে ওখানে প্রায় ৩০/৪০ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান করছে। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের নাম হাবিবুর রহমান হাবিব। একজন প্রাক্তন-পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সৈনিক। ওসি আরো জানিয়েছেন যে ঐ গ্রাম থেকে রাইফেলের গুলির শব্দও শোনা গেছে। সুতরাং এটা কনফার্ম যে, মুক্তির দল সেখানে আছে। ক্যাপ্টেন এজাজ ভাবছে, এবার মুক্তিযোদ্ধাদের শায়েস্তা করার একটা মহা সুযোগ এসেছে। এটার সদ্ধ্যব্যবহার করতে হবে।
কাউখালী বি আই ডাব্লউ টি এ বিল্ডিং এ পাকসেনা ক্যাম্প। এক প্লাটুন পাকসেনা এবং পুলিশ সহ প্রায় ১৩০ জনের মতো সদস্য আছে সুবেদার জানে আলমের কমান্ডে। সুবেদার জানে আলাম খাস পাঞ্জাবি এবং মায়া-মমতাহীন এক পাষাণ্ড। লুট ও ধর্ষণে সে সবার চেয়ে অগ্রগামী। ক্যাপ্টেন এজাজ সিদ্ধান্ত নিল সুবেদার জানে আলমকে অপারেনে পাঠাবে। ক্যাপ্টেন এজাজ নিজেই হেড কোয়ার্টারের সিগনাল রুমে চলে এলো ওয়ারলেস সেটের কাছে। সে নিজেই জানে আলমকে ওয়ারলেস এর মাধ্যমে আদেশ প্রদান করবে।
সুবেদার জানে আলাম পুরো এক প্লাটুন সৈনিক তৈরি করল স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র সহ। এল.এম.জি ও মর্টার নিতে ভুললো না। পাকসেনাদের সাথে পুলিশের ২০ জন সিপাহীও অপারেশনের জন্য প্রস্তুত হলো। সঙ্গে গাইড ও পথ প্রদর্শক হিসেবে নিল গ্রামের দালাল ও চৌকিদারকে।
এদিকে ওয়ারলেসের মাধ্যমে ঝালকাঠি পাকসেনা ক্যাম্পে ও কুতুবকাঠিতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের কথা পৌঁছে গেল। সেদিন ১০৭ বিগ্রেড কমান্ডার বিগ্রেডিয়ার মালিক হায়াত খান ঝালকাঠি সেনা ক্যাম্প পরিদর্শনে এসেছিলেন। তিনি ঝালকাঠি থেকেও আরো এক প্লাটুন পাকসেনা লঞ্চ যোগে পাঠালেন কুতুবকাঠি আক্রমণ করতে। দুদিক থেকে ডবল এনভেলাপমেন্ট করে সম্পূর্ণরুপে মুক্তিযোদ্ধাদের ধ্বংস করার আদেশ দিলেন। খানসেনাদের দুই দল কাউখালী অ ঝালকাঠি থেকে সকাল ৬টায় বেরিয়ে পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের জন্য।
কাউখলী থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে কেউন্দিয়া গ্রাম। একটা ইট পাতা রাস্তা, যেটা সি-এন্ড-বি রোড-নামে পরিচিত সেটা কেউন্দিয়া পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে। কেউন্দিয়া থেকে কুতুবকাঠি গ্রাম পর্যন্ত একটা কাঁচা রাস্তা রয়েছে। কুতুবকাঠি গ্রাম ঝালকাঠি থানার অন্তর্গত। জলপথ এবং স্থলপথ দুদিক দিয়েই কুতুবকাঠি গ্রামে যাওয়া যায়। কেউন্দিয়া হয়ে কুতুবকাঠি যেতে হলে সেওতা গ্রামের ওপর দিয়ে যেতে হবে/ পাকিস্তান আর্মি জানত না যে এই সেওতা গ্রামে তখন কমান্ডার আবদুল হাইপনা তাঁর মুক্তিযোদ্ধার দল নিয়ে আত্নগোপন করে আছে। কালগণনার পর্যায়ে সাধারণত আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসকে বাংলাদেশে বর্ষকালের মধ্যে গণ্য করা হয়। পাকসেনাদের দল সুবেদার জানে আলমের নেতৃত্বে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে টারগেট লক্ষ্য করে। এক সময় তারা কেউন্দিয়া গ্রাম এসে পৌঁছল।
কেউন্দিয়া গ্রামের পরেই সেওতা ও গরঙ্গল গ্রাম। তারপর কুতুবকাঠি। কেউন্দিয়ার পর থেকে খুব সাবধানে এগোতে লাগল পাকসেনারা। প্রথমে রেখেচে দুজন স্কাউট, তারপর পয়েন্ট সেকশন-পয়েন্ট সেকশনের পরেই সুবেদার জানে আলম এবং তারপর দলে বাকি সদস্য। রাজপাশা ও কুতুবকাঠি গ্রামের নিকোটে এসে পাকসেনারা দেখতে পেল যে, এই বর্ষায় পুরো এলাকা বেহাল অবস্থা ধারণ করেছে। কাদায় প্যাঁচ প্যাঁচ করছে পুরো এলাকা। রাস্তার দুধারে জমিগুলোতে অথৈ পানি। গ্রামের ভিতরে যাওয়া খুবই কষ্টকর। গ্রামের রাস্তায়, এপাড়া ওপাড়ার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী সুপারি গাছের তৈরি সেতু বা আঞ্চলিক ভাষায় ‘চার” দেখে তাদের চক্ষু চড়ক গাছ। এর উপর দিয়ে কীভাবে যাবে। পা পিছলে গেলে একেবারে ধপাস করে পড়তে হবে পানিতে। এমনিতে পশ্চিমা সেনারা পানিকে প্রচণ্ড ভয় করে এবং তাদের বেশিরভাগ সৈনিক সাঁতার জানে না। বর্ষাকালের এই অবস্থা দেখে তারা আরো ঘাবড়ে গেল।
ওদিকে ঝালকাঠির খানসেনা দলও লঞ্চ থেকে নেমে বর্ষার এই ভয়াবহ পরিবেশ ও পরিস্থিতি দেখে ঘাবড়ে গেছে। লঞ্চে বসে অথৈ পানির সরোবর দেখে তারা আধমরা হয়ে গেছে। দুদলেই দুদিক থেকে এসে বড়ই বেকায়দায় পড়েছে। কোথাও কোনো লোকজন দেখা যাচ্ছে না। মনে হয় গ্রাম ছেড়ে সবাই পালিয়েছে।
কমান্ডার হাবিব কুতুবকাঠি গ্রাম বসেই জানতে পেল পাকসেনার দুটি দল দুদিক থেকে এগিয়ে আসছে। হাবিবের দলও প্লান মাফিক যে যার পজিশনে চলে গেল। এই এলাকার গ্রামের ভিতর ফিল্ড অব ফায়ার নেই বললেই চলে। গ্রামগুলো ঘন সুপারি গাছে ঘেরা। গ্রামের ভিতর ফিল্ড অব ফায়ার নেই বললেই চলে। গ্রামগুলো ঘন সুপারি গাছে ঘেরা। গ্রামের ভিতর কাঠ ও টিন দিয়ে তৈরি একতলা এবং দোতলা বাড়ি। হাবিবের দলে যোদ্ধারা প্রায় সকলেই যে যার মতো দোতালা বাড়ী এবং ঘন জঙ্গলে ছাওয়া আড়ে আড়ে পজিশন নিল। তারা দেখতে পাচ্ছে পাকসেনাদের কিন্তু পাকসেনারা তাদের দেখতে পাচ্ছে না। চারজনের পাকসেনাদের কিন্তু পাকসেনারা তাদের দেখতে পাচ্ছে না। চারজনের পাকসেনাদের একটি দল ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো গ্রামের ভিতরে। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠল হাবিবের দলের মুক্তিযোদ্ধাদের রাইফেলগুলো। মুহূর্তের মধ্যে চারজন পাকসেনা গুলি খেয়ে ধপাস করে পড়ে গেল গ্রামের ভিত্রে বয়ে চলা খালের পানিতে গুলির শব্দ শুনে এবং সাথী সৈনিকদের মৃত্যু দেখে পাকি পাকসেনারা দৌড়ে পালিয়ে পিছনে গিয়ে পজিশন নিল। রাস্তার উপরে দাঁড়ানো পাকসেনারাও সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়ে গ্রাম লক্ষ্য করে বৃষ্টির মত গুলি শুরু করল। শুরু হয়ে গেল তুমুল যুদ্ধ দুপক্ষের।
পাকসেনারা বেশী সুবিধা করতে পারছিলো না। কারণ তারা ঠিকমতো আড় নিয়ে পজিশন নিতে পারেনি। কেননা রাস্তার দুধারের জমিতে পানি ভর্তি। এ অবস্থায় কোথায় পজিশন নেবে। এদিকে হাবিবের বাহিনী ইচ্ছামতো বেছে পাকসেনাদের দেখে দেখে ফায়ার করছে। গুলি খেয়ে এক এক করে পাকসেনা ধপাস ধপাস করে পানি ভর্তি জমির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। পাকসেনা বুঝতে পারছে না কোথা থেকে তাদের উপর ফায়ার করা হচ্ছে। পুরোদমে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল তাদের মধ্যে। এবার তারা গ্রাম লক্ষ্য করে মর্টার ফায়ার করল। বিকট শব্দে মর্টারের গোলা ফুটল। সুপারি গাছের পাতাগুলো ঝর ঝর করে ঝরে পড়তে লাগল। হাবিবের দলের যোদ্ধারা দেখে ফেললো পাকসেনাদের মর্টার পজিশন। সুপারি গাছের আড়ে আড়ে এসে তারা ফায়ার করল যারা মর্টার চালাচ্ছিল। গুলি খেয়ে দুজনে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। আক্রমণ এবং পাল্টা আক্রমণে এইভাবে চলতে লাগল দুপক্ষের লড়াই। যুদ্ধে যুদ্ধে সময় গড়িয়ে চলে। যুদ্ধ শুরু হয়েছে সেই বেলা ৯টার সময়। প্রায় তিন ঘন্টা একনাগাড়ে যুদ্ধ চলছে। পাক সেনারা পজিশন ছেড়ে একচুলও নড়তে পারছে না। যে ওরা উঠে দৌড়ে গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করতে চায় অমনি গ্রামের ভিতর থেকে লুকিয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা গুলি করে। এইভাবে পরস্পরের মধ্যে গোলাগুলি চলল আরো কিছুক্ষণ। কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি না।
এদিকে প্রচণ্ড গোলাগুলি শব্দে সেওতা ও গরঙ্গল গ্রামে হাইড-আউটএ লুকিয়ে থাকা কমান্ডার আবদুল হাই পনার দল বুঝতে পারল পাকসেনারা হাবিবের দলকে আক্রমণ করছে। এই অবস্থায় তাদের নিস্ক্রিয় থাকা ঠিক হবে না। একজন কমরেড হয়ে অন্য কমরেডকে সাহায্য করা একান্ত দরকার। কমান্ডার পনা এবার তাঁর দলকে একত্রিত করে পাকসেনাদের সাথে যুদ্ধের জন্য তৈরি হলো। তারা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে পাকসেনাদের ঠিক পিছনে এসে পজিশন নিল।
এরপর পিছন থেকে পাকসেনাদের উপর পনার দল আক্রমণ করল। পৃথিবী বিখ্যাত সুশিক্ষিত সেনাবাহিনী বলে যারা নিজেদের দাবি করে সেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী সম্মুখ ও পাশ্চাৎ এই দুদিক থেকে আক্রমণের মুখে পড়ে এবার তারা পুরোপুরি ঘাবড়ে গেল। তাদের সামনে পিছনে দুদিকেই শত্রু। এর ফলে পিছন দিয়ে কেউন্দিয়া হয়ে কাউখালী যাওয়ার রাস্তাও বন্ধ হয়ে গেছে। এবার তারা পড়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের ‘মানকার চিপায়’। আর তাই দুদিক থেকে আক্রমণ হওয়াতে এক এক করে গুলি খেয়ে মরতে লাগল পাকসেনারা
যুদ্ধ করতে করতে অবশিষ্ট পাকসেনারা কাদায় ও পানিতে ভিজে একেবারে একাকার হয়ে গেছে। পাকসেনাদের এই বেকায়দা অবস্থা দেখে গ্রামের লোকজন যারা ভয়ে ঝোপ ও জঙ্গলে পালিয়ে ছিল তারা ধীরে ধীরে একত্রিত হলো। এবার সযোগ এসেছে খানসেনাদের শায়েস্তা করার। শতশত লোক লাঠি, দা, কুড়াল, কোদাল নিয়ে “জয়বাংলা” শ্লোগান দিতে দিতে ধীরে ধীরে ঘিরে ফেলতে লাগল পাকসেনাদের। সুবেদার জানে আলম যুদ্ধের অবস্থা। বেগতিক দেখে নিজ সৈনিকদের ফেলে রেখে বহু আগেই পিছন দিয়ে নিজে একা একা চুপি চুপি পালিয়ে গেল। সন্ধ্যার আলো আধারিতে ধীরে ধীরে ছেয়ে গেল যুদ্ধক্ষেত্র। এবার জনতাও ঝাঁপিয়ে পড়ল পাকসেনাদের উপরে। সন্ধ্যায় আবছা আলোতে যে পাকসেনাকে সামনে পেল তাকেই কুপিয়ে মেরে ফেলল। এমতাবস্থায় পাকসেনারা। কেউবা জঙ্গলের ভিতরে গিয়ে কেউবা কবরস্থানে গিয়ে ভাঙ্গা কবরের ভিতরে লুকিয়ে পড়ল। জনতা ও মুক্তিযোদ্ধা মিলে খুঁজে খুঁজে তাদের বের করে মারতে লাগল। রাত ৯টার সময় প্রায় ১২ ঘন্টা যুদ্ধের পর দুপক্ষের যুদ্ধ থেমে গেল। মুষ্টিমেয় ক’জন পাকসেনা তখন রাতের অন্ধকারে আশ্রয়ে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাল। সারারাত গ্রামের লোকজন টর্চ জ্বালিয়ে ঐ পাকসেনাদের খুঁজতে থাকে এবং খুঁজতে খুঁজতে তিনজন পাকসেনাকে জ্যান্ত ধরে ফেলে। পরের দীন সূর্য ওঠার পরে জনতা এই খোঁজা-খুঁজির ক্ষ্যান্ত দেয়।
কুতুবকাঠি যুদ্ধে পাকসেনারা সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়। সর্বমোট ২৮ জন পাকসেনা নিহত হয়। সর্বমোট ২৮ জন পাকসেনা নিহত হয়। জ্যান্ত ধরা পড়ে তিনজন। যে তিনজন ধরা পড়ে তারা হলো, সিপাহী জাঙ্গুল খান, সিপাহী বাঙ্গুলখান ও সিপাহী আবদুল মালেক খান। সিপাহী জাঙ্গুল খান ও বাঙ্গুল খান দুজন সহোদর ভাই। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ নিহত বা আহত হয়নি। শুধু মাত্র গ্রামের একজন বাচ্চা ছেলে নাম ইসাহাক, তাঁর পায়ে গুলি লেগেছিল। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর মোঃ ইসহাক আহত হয়। পরের দিন সকালে বন্দি তিনজন পাকসেনাদের সুন্দরবনের ক্যাপ্টেন জিয়ার কাছ হস্তান্তর করা হয়। ক্যাপ্টেন জিয়া পরবর্তীতে তাদেরকে ভারতের টালিগঞ্জ ক্যাম্পে ইন্টারগেশনের জন্য পাঠিয়ে দেয়। কুতুবকাঠির এই যুদ্ধ এবং ধরাপড়া সৈনিকদের জবানবন্দী, “আকাশ বাণী” স্বাধীন বাংলা বেতার ও বিবিসি থেকে প্রচার করা হয়। যদিও ভুলবশত কুতুবকাঠি গ্রামের নাম কুতুবপুর বলে প্রচার করা হয়েছিল।
[১৪৭] হামিদুল হোসেন তারেক

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!