You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.03 | কুমিল্লা মুক্তির যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক

কুমিল্লা মুক্তির যুদ্ধ

’৭১ এর ৩ ডিসেম্বর ভারতীয় পুর্বাঞ্চলে কমান্ডার লে. জে. জগজিৎ সিং আরোরার অধিনায়কত্বে গঠিত বাংলাদেশ-ভারত যুক্ত কমান্ড। ৩ ডিসেম্বর থেকে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী দখলদার পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে মরনপণ যুদ্ধরত বাংলাদেশে সশস্ত্র ও মুক্তিবাহিনীর সহ সহায়তায় বিভিন্ন রুট সমূহ দিয়ে বাংলাদেশের প্রবেশ করে। ২৩ নং ডিভিসন কুমিল্লা ও ময়নামতির পাশ কেটে দাউদকান্দির দিকে এবং চৌদ্দগ্রাম থেকে লাকসাম ও চাদপুরের দিকেও আরকেটি বাহিনী পুর্ব দিকে বেলোনিয়া থেকে ফেনীর দিকে এগিয়ে যায়। মনতলা (আগরতলা) ক্যাম্প থেকে দু’ কোম্পানি সৈন্য নিয়ে ক্যাপ্টেন আইন উদ্দিন সোনামুড়া চলে যান। ২৩ নভেম্বর সোনামুড়াতে যে ভারতীয় সৈন্য ডিফেন্স নিয়েছিল তাদের কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নিয়ে আইন উদ্দিন নবম বেঙ্গল নিয়ে বাংলাদেশের দিকে অগ্রসর হন। বাংলাদেশের ভেতরে আরও দুটি কোম্পানি পূর্ব থেকেই অবস্থান করছিল। আইন উদ্দিনকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে নির্ভয়পুর (ভারত) যেতে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কুমিল্লা দখল করার জন্য বলা হয়। আইন উদ্দিন ১ ডিসেম্বর নির্ভয়পুরে যান। সেখানে যাওয়ার পর বিগ্রাডিয়ার টম পাণ্ডে তাঁকে কুমিল্লা-চট্টগ্রাম সড়কের মাঝে চিওড়াতে ডিফেন্স নিতে বলেন। বিগ্রেডিয়ার নির্দেশ মত ৩ ডিসেম্বর রাতে আইন উদ্দিন চিওড়া আসেন। তার কোম্পানি চিওড়া পৌছলে চিওড়া বাজারে পুর্ব থেকে অবস্থান নেয়া ভারতীয় এক ব্যাটালিয়ান সৈন্য অন্য দিকে চলে যায়। এ সময় পাকবাহিনীর চিওড়া বাজারের উত্তর দিকে একটি বাজারে ডিফেন্স নিয়েছিল। চিওড়ায় পাকবাহিনী কোন রকম প্রতিরোধ না করেই পিছনের দিকে চলে যায়। ৪ ডিসেম্বর চৌদ্দগ্রামের দু’টি শক্তিশালী ব্যুহ ছিন্ন করে নবম বেঙ্গল কুমিল্লার দিক আসতে থাকে। ৪ ডিসেম্বরই চৌদ্দগ্রাম থানা মুক্ত হয়। এ দিন দেবিদ্বার থানাও থানাও মুক্ত হয়। ওদিকে ৩ ডিসেম্বর রাতে যৌথবাহিনীর ৩০১ মাউন্টেন বিগ্রেড ও মুক্তিবাহিনী লালমাই পাহাড় এবং লাকসামে পাকিস্তানী প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেঙ্গে ফেলে। অগ্রসরমান যৌথ বাহিনী মুদাফফরগঞ্জের কাছে শত্রুর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এই সংঘর্ষে পাকিস্তানী ২৫তম অ্যান্টিয়ার ফোর্সের কমান্ডিং অফিসার এবং তার অধিকাংশ সৈন্য আত্নসমর্পণ করে। ৬ ডিসেম্বর মুদাফফরগঞ্জ মুক্ত হয়। আইন উদ্দিনের নেতৃত্বধীন নবম বেঙ্গল ৫ ডিসেম্বর সকালে কুমিল্লা বালুতফায় এসে অপেক্ষা করতে থাকে। বালুতুফা থেকে ৮ মাইল দূরে পাকসেনারা বাঙ্কার ডিফেন্স নিয়েছিল। নবম বেঙ্গলের অল্প সংখ্যক সৈন্য হওয়ায় তারা পাকের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি। পাকসেনাদের পিছনের দিকে দিয়ে ৬ ডিসেম্বর কুমিল্লা শহরে প্রবেশ করে। কুমিল্লাহ শহরের পূর্বদিক থেকে ঢুকে নবম বেঙ্গল কুমিল্লাহ শহরের পশ্চিম দিকে ৭ ডিসেম্বর দুপুর ১২ টার দিকে পৌঁছে যায়। দুপুর বারোটায় ভারতীয় শিখ জাট বাহিনীর কাজ ছিল কুমিল্লা বিমান বন্দর আক্রমণ করা। শিখজাট ব্যাটালিয়ন বিমান বন্দর আক্রমণ করেছিল ৬ ডিসেম্বর রাতে। রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধ হয় সেখানে। এই আক্রমণে শিখজোট সেনাদের কয়েকজন আহত ও নিহত হয়। পাকসেনারা বিমান বন্দর ছেড়ে চলে যায়। নবম বেঙ্গলের কনভয় যখন শহরের পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছিল তখন হাজার হাজার জনতা তাদের স্বাগত জানাতে আসে। আইন উদ্দিন তাদের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করার আহবান জানান এবং বলেন, আমরা শহর সম্পূর্ণ মুক্ত করি। কিন্তু কেউই তাঁর কথা না শুনলে তিনি বল প্রয়োগ করেন। মনঃক্ষুণ্ন হয়ে জনতা ফিরে যায়। ৭ ডিসেম্বর বিকাল পাঁচটায় জেনারেল আরোরা হেলিকাপ্টার যোগে কুমিল্লা বিমান বন্দরে অবরতরণ করেন। জেনারেল আরোরা আইন উদ্দিনকে শহরেরে সম্পূর্ণ শান্তি শৃঙ্খলা আয়ত্তে আনার দায়িত্ব দিয়ে হেলিকপ্টারে পুনরায় ফিরে যান। আইন উদ্দনি শহরে এসে সমস্ত সোনার দোকান সীল করে দেন। যতদিন পর্যন্ত না বাংলাদেশ সরকারের কোন রকম আদেশ না আসে ততদিন পর্যন্ত পাক আমলে ডি সি নুরুন্নবী চৌধুরী ও এস, পি কে কাজ চালিয়ে যাবার নির্দেশ দেন। কুমিল্লা ও ময়নামতি লালমাই হিল কমপ্লেক্স রক্ষার করার কাজে নিযুক্ত ছিলো পাকিস্তানীদের ১১৭ ব্রিগেড। তাদের ৫৩ ব্রিগেড ছিল লাকসামের চতুর্দিকে প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত। এই সব প্রতিরক্ষামূলক ঘাঁটি ছিল খুবই শক্তিশালী। গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র মজুতের পরিমাণ ও পর্যাপ্ত ছিল। ভারতী কোর কমান্ডার লাকসামকে অন্যান্য অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নেন। তারপর তিনি লালমাই ঘাঁটি এড়িয়ে চাঁদপুর ও দাউদকান্দি অভিমুখে অগ্রসর হবে। ভারতের ৬১ ব্রিগেড (ব্রিগেডিয়ার টম পান্ডে) গোমতী নদী পারে হয়ে ময়নামতি- কোম্পানিগঞ্জ সড়ক এবং ময়নামতি-দাউদকান্দি সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশ পান। সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য এগিয়ে যাবে। ৬১ মাউন্টেন ব্রিগেড ৪র্থ কোর হেডকোয়ার্টারে সরাসরি কমান্ডে যুদ্ধ করে। ৭ ডিসেম্বর ব্রিগেডিয়ার পান্ডের নেতৃত্বে মিত্র বাহিনী গোমতী পাড় হয়ে চান্দিনা এবং জাফরগঞ্জে অবস্থান গ্রহণ করে এবং সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। একটি ট্যাংক বহরের সহায়তায় দুই কোম্পানি মুক্তিফৌজ এবং ভারতের ১৫ কুমায়ুন ব্যাটালিয়ন দাউদকান্দির গুরুত্বপূর্ণ ফেরীঘাট দখল করার জন্য ঝড়ো গতিতে অগ্রসর হয়। পূর্ব সেক্টরে অন্যান্য স্থান থেকে সড়ক পথে ঢাকা যেতে হলে দাউদকান্দিতেই প্রথম এবং প্রশস্ততম নদী পার হতে হয়। এ সময় লাকসাম এলাকায় প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়। ৭ ডিসেম্বর থেকে নবম বেঙ্গল কুমিল্লা সেনানিবাসে দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ করার জন্য ডিফেন্স নেয় এবং আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। বরুড়া থেকে ৩ মাইল পূর্বে সাইলচোলাইজলা নামক স্থানে ৫ সদস্যের এক দল হানাদার বাহিনী পায়ে হেঁটে কুমিল্লাহ ময়নামতি বিচ্ছিন্ন ভাবে যাওয়ার সময় অ্যাম্বুশরত মুক্তিবাহিনীর লক্ষ্যবস্তুতে ঢুকলে আক্রমণ পাল্টা আক্রমণ শুরু হয়। সুনিল ভৌমিক নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা অসাবধানতাবশত নিজদের গুলিতে আহত হন। ৫ সদস্যের শত্রু বাহিনী বাতাইছড়িতে পালিয়ে যায়। সেখানে এলাকার ক্ষিপ্ত জনসাধারণ আর মুক্তিযোদ্ধারা তাদেরকে হত্যা করে। ১২ ডিসেম্বর এক কোম্পানি শত্রু বাহিনী, মিত্র বাহিনী আর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে বরুড়ার উত্তর দিকে ৩ মাইল দূরে হরিপুর নামক স্থানে আত্মসমর্পণ করে।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত