কালুরঘাটের প্রতিরোধ যুদ্ধ, চট্টগ্রাম
কালুরঘাট চট্টগ্রাম শহর সংলগ্ন একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। এর পূর্ব-দক্ষিণ দিকে চট্টগ্রাম মূল শহর অবস্থিত। সর্ব দক্ষিণে পটিয়া, দক্ষিণ- পশ্চিম দিকে দোহাজারী এলাকা অবস্থিত। কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদী বয়ে গেছে, তার উপর নির্মিত ব্রিজটির নাম কালুরঘাট ব্রজ। এই কালুরঘাট ব্রিজের পর চট্টগ্রাম-কাপ্তাই বা চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি যাওয়ার সড়ক পথ। কালুর ঘাটে সংঘটিত যুদ্ধসমূহ ২ মার্চ থেকে ১১ এপ্রিল, ১৯৭১ এর মধ্যে সংগঠিত। প্রথম দিকে কিছু খণ্ড যুদ্ধ ওঁ পড়ে মূল যুদ্ধ হয়। ২৬ মার্চ থেকে ২৯ মার্চ চট্টগ্রাম শহর এলাকায় ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বভিন্ন তৎপরতা বজায় রাখলে পাকবাহিনীর উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। তারা স্থল ও আকাশ পথে তাদের সৈন্য প্রেরণ অব্যাহত রাখেন। এ প্রেক্ষিতে ২৯ মার্চ থেকে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কালুঘাটে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করা ও ক্ষুদ্র অভিযান পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেয়। ২৬ মার্চ সকাল কাপ্তাই ও কক্সবাজার ছেড়ে আসা সৈনিকগণ ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সাথে মেজর জিয়ার নেতৃত্বে প্রতিরোধ যুদ্ধে যোগ দেন। এদিকে মেজর রফিকের নেতৃত্বে চট্টগ্রামে অবস্থানরত ইপিআর বাহিনী (২০ বালুচ রেজিমেন্টের সাথে) পাকবাহিনীর সাথে খণ্ডযুদ্ধ লিপ্ত হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল শহর এলাকা খণ্ডযুদ্ধের মাধ্যমে শত্রুকে ব্যতিব্যস্ত ও পর্যুদস্ত করা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ২৬ মার্চ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণার পর ২৭ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর নাম করে তাঁর পক্ষে কালুরঘাট বেতারের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রতিরোধ যুদ্ধের গুরুত্ব অনুধাবনে সক্ষম হন। ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর সম্মিলিত বাহিনীর ক্ষুদ্র অংশ বিভক্ত করে শহরের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। ২৭ মার্চ ক্যাপ্টেন হারুণ ও লে. শমসের প্রমুখ অফিসারগণ শহরের চট্টেশরী রোড, চকবাজার প্রভৃতি স্থানে পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখ সংঘর্ষে অবতীর্ণ হন। এদিকে ২৯/৩০ তারিখের দিকে কালুরঘাট এলাকা অধিক গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। ২৮ মার্চ কক্সবাজার রওয়ানা হওয়া মেজর শওকতের দলটি পুনরায় ৭ এপ্রিল তারিখে কালুরঘাট যোগ দেয়। এরপর থেকে মূল যুদ্ধ শুরু হয়। কর্ণফুলী নদীর উপর নির্মিত কালুরঘাট সেতুর দুই পাশেই ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ইপিআর পুলিশ, আনসারের সমন্বিত বাহিনী অবস্থান গ্রহণ করে। নদীর দক্ষিণ দিকে অর্থাৎ কক্সবাজার অংশে চৌধুরী খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বে অবস্থান নেন। উত্তর দিকে ৩৫ জন জনবলের একটি দল অবস্থান নেয়, নেতৃত্ব দেন ক্যাপ্টেন হারুন ও লে. শমসের মবিন। ১ মাইল উত্তরে, চট্টগ্রামের দিকে সুবেদার মজিদ নেতৃত্ব দেন একটি ইপিআর কোম্পানিকে। ২৯ মার্চ রাত ৮টায় মোটর লঞ্চ পাকবাহিনীর একটি দল তল্লাশি চালায়। তারা ১৩০ সি বিমান করে প্লাটুন অবতরণ করায় এবং ৪.৩০ মিনিটে মুক্তিযোদ্ধা প্রতিরক্ষা অবস্থানের উপর গুলিবর্ষণ করে। পরে এ শত্রু সৈন্যরা ঐ অঞ্চলে পাকা ও ৩ তোলা কৃষি খামার(ভবনে) অবস্থান নিলে, লে. মাহফুজ একটি সমন্বিত প্লাটুন নিয়ে অগ্রসর হন। কৃষি ভবন ৪০০-৫০০ গজ দূরে চারদিকে বেষ্টনি তৈরির মতো করে অবস্থান গ্রহণ করেন। শত্রুপক্ষ রকেট লাঞ্চার ও মেশিনগান দিয়ে গুলিবর্ষণ করে। লে. মাহফুজ ও তাঁর রকেট লাঞ্চার দিয়ে শত্রুর উপর কার্যকর আক্রমণ করেন। তিনি শত্রুকে সারাদিন অবরুদ্ধ করে রাখনে এবং সন্ধ্যার পরই ভবনটি তিন দিকে ঘিরে ফেলেন। ভোরের আগেই মুক্তিযোদ্ধারা ভবনটি প্রবেশ করেন। এ যুদ্ধে প্রথমে ৫ জন পড়ে ২ জন পাকসেনা নিহত হয়। এই যুদ্ধে পাকবাহিনী প্রভূত ক্ষতি সাধিত হয়। ১ টি এসএস, ১টি ৭.৬২ এলএমজি, ২টি জি ৩ রাইফেল, ২টি জি ৩ রাইফেল, ২টি এসএমজি, ৩টি রকেট লাঞ্চার, ১টি পিস্তল ওয়ালতার, ২টি ভেরি লাইট পিস্তল, ১টি ওয়ারলেস ও প্রচুর গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক দ্রব্য লে. মাহফুজের হস্তগত হয়। এ অপারেশন ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম সফল অভিযান। কালুর ঘাটের পাশাপাশি মদনঘাট সেতুকে কেন্দ্র করে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয় মুক্তিবাহিনী। ইপিআর সৈন্যসহ লে. মাহফুজের নেতৃত্বে দুটি দল কালুর ঘাটের সম্মুখবর্তী এলাকায় অবস্থান নেন। অন্য দল সুবেদার সাহেব আলীর নেতৃত্বে কাপ্তাই সংযোগ সড়ক মোড়ে অবস্থান নেয়। এ কারণে মেজর শওকত ও লে. মাহফুজ অগ্রবর্তী অবস্থানসমূহে ও সেতুর উত্তর দিকে অবস্থান গ্রহণ করেন। ক্রমান্বয়ে পাকবাহিনী কালুরঘাট সেতুর দিকে অগ্রসর হয়। ৮ এপ্রিল লে. শমসের মবিন পাকবাহিনীর অবস্থানের উপ সীমিত আক্রমণ করে। ৯ এপ্রিল মেজর শওকত একটি দল নিয়ে কৃষিভবনে আবার হানা দিয়ে তাদেরকে বিতাড়িত করেন। এ সংঘর্ষে পাকবাহিনীর একজন অফিসার সহ ২০ জন নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীর নায়েক নায়েব আলী এ সংঘর্ষে শহীদ হন। ১১ এপ্রিল সকাল-সন্ধ্যা দুপক্ষে গুলিবিনিময় অব্যাহত থাকে। মুক্তিবাহিনীর গোলাবারুদ শেষ হলে, অফিসারগণ সিদ্ধান্তে রাতে পশ্চাদপসরণ করে বান্দরবান হয়ে চন্দ্রঘানা থেকে কাপ্তাই পৌঁছে মুক্তিযোদ্ধারা। এর লে. মাহফুজ রাঙামাটির যদুনাঘাটে পাকবাহিনীর আক্রমণ নসাৎ করে এবং মূলদলের সাথে সকলে রাঙামাটিতে একত্রিত হন।
[৫৯৭] কে. এম. আহসান কবীর
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত