কাশিনাথপুরেরে ডাব বাগানের যুদ্ধ
কাশিপুর গ্রামটি যশোর শহর থেকে আনুমানিক ২৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। এর অপর পাড়েই রয়েছে ভারতের বয়রা এলাকা, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক দিনগুলোতে একটি সাব সেক্টরের সদর দপ্তর ছিল। কাশিপুর এলাকা বাঙ্গালদেশের যে কোনো এলাকার মতো মোটামুটি সমতল। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের আনুমানিক ৩ কিলোমিটার সন্নিকটে অবস্থিত এই এলাকার উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে কপোতাক্ষ নদী প্রবাহিত হচ্ছে, যা যে কোনো সৈন্যদলকে বড় মাপের প্রাকৃতিক বাধা প্রদান করে। এই এলাকার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে খোলা জায়গা রয়েছে, যেখানে আনুমানিক ৫০০ গজ পর্যন্ত যে কোনো চলাচল পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। তবে পশ্চিম ও উত্তর এলাকায় ঘন গাছ ও জনবসতির জন্য পর্যবেক্ষণের সীমা অত্যন্ত সীমিত। এই এলাকার মধ্যে দিয়ে বেশ কিছু কাঁচা এবং পাকা রাস্তা পূর্ব-পশ্চিমে ও উত্তর-দক্ষিণে গেছে। রাস্তাগুলো ১০-১৫ ফুট চওড়া এবং ভূমি থেকে ৫-৬ ফুট উঁচু বিধায় পর্যবেক্ষণ ও ফায়ার থেকে আড়াল দেয়। ভারতের বয়রা এলাকা থেকে ছুটিপুর-মোহাম্মদপুর অক্ষ দিয়ে যশোর পৌঁছানোর জন্য কাশিপুর এলাকার মধ্য দিয়ে যাওয়া প্রয়োজন বিধায় শত্রুর চলাচলকে প্রতিহত করার জন্য কাশিপুর এলাকায় প্রতিরক্ষা গ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
পাকবাহিনী দোসররা নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর অত্যাচার চালাত। তাদের সমুচিত জবাব দেয়ার জন্য ১৫ মে ১৯৭১ তারিখে ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদা কাশিপুর বিওপি এলাকাতে পাকসেনাদের টহল দলের ওপর আক্রমণ চালিয়ে ৬ জন পাকসেনাকে হত্যা ও একটি জিপ ধ্বংস করেন। তাছাড়া ১টী এলএমজি, ৮টি রাইফেল, ১টি মানচিত্র ও বেশি কিছু গোলাবারুদ হস্তগত হয়।
এর কিছুদিন পড়ে প্রতিশোধ নেয়ার লক্ষ্যে পাকিস্তানী বাহিনী ছুটিপুর গ্রামে আগুম জ্বালিয়ে গ্রামবাসীদের অপর নির্মম অত্যাচার চালাতে থাকে। ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদা এ খবর পেয়ে ইপিআর বাহিনীর দুটি প্লাটুন নিয়ে ছুটিপুর গ্রাম ঘিরে ফেলেন এবং তাদের আত্নসমর্পণ করতে বলেন। কিন্ত পাকসেনারা এ কথা আগ্রাহ্য করে অনবরত গুলি চালাতে থাকে। তখন ক্যাপ্টেন হুদা পাল্টা গুলি চালানোর নির্দেশ দেন এবং বেশ কিছুক্ষণ সংঘর্ষের পর পাকবাহিনী পিছু হটে যায়। এ যুদ্ধে পাকবাহিনীর ১১ জন নিহত হয় এবং ৪ জন মুক্তিবাহিনীর হাতে বন্দি হয়, এছাড়া মুক্তিবাহিনী পাকসেনাদের ১টি জিপসহ বেশ কিছু গোলাবারুদও উদ্ধার করে। ছুটিপুর গ্রামের লজ্জাজনক পরাজয় পাকিস্তানী বাহিনীকে প্রতিশোধের নেশায় উন্মাদ করে তোলে। তারা ২৭মে ১৯৭১ তারিখে ২৪ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের ২টি কোম্পানি ছুটিপুর থেকে কাশিপুর আক্রমণের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। তখন দুপুর প্রায় ১২টা। এ সময় বয়রা ক্যাম্পে অবস্থাঙ্কারী ডি কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা দুপুরের খাবার খাচ্ছিল। হঠাৎ করে কাশিপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মোয়াক্কেল মোল্লা দৌড়ে বয়রা ক্যাম্পে জানায় যে, আনুমানিক ২০০ পাকসেনা কাশিপুর এলাকা আক্রমণের উদ্দেশ্যে ছুটিপুর-বেলতা-কাশিপুর রাস্তা ধরে এগিয়ে আসছে।
সংবাদ পেয়েই কোম্পানি অধিনায়ক ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদা, সুবেদার মনিরুজ্জামানকে ১ প্লাটুন সৈন্য নিয়ে ত্বরিত পাকিস্তানী বাহিনীর অগ্রযাত্রা বন্ধের নির্দেশ দেন। ইতিমধ্যে পাকিস্তানী বাহিনী কাশিপুর-শার্শা সড়কের কাছাকাছি এগিয়ে আসায় সুবেদার মনিরুজ্জামান তাঁর প্লাটুন নিয়ে কাশিপুর-শার্শা সড়ক ধরে ত্বরিত প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। পাকিস্তানী বাহিনীর অগ্রযাত্রা বাধার সম্মুখীন হয় এবং উভয় পক্ষে শুরু হয় প্রচণ্ড গোলাগুলি।
কোম্পানি অধিনায়ক ক্যাপ্টেন হুদা যুদ্ধের তীব্রতা আঁচ করতে পেরে শত্রুকে কাশিপুর বিওপির পশ্চিম দিক থেকে পার্শ্ব আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। সেই অনুযায়ী তিনি নিজে এবং ক্যাপ্টেন তৌফিক এলাহির নেতৃত্বে কিছু সৈন্য নিয়ে কাশিপুর বিওপির পশ্চিম দিক দিয়ে আক্রমণের জন্য অগ্রসর হন।
ইতিমধ্যে সুবেদার মনিরুজ্জামান প্লাটুন কাশিপুর প্রাইমারি স্কুলের পাশে সুবিধাজনক অবস্থান থেকে পাকিস্তানী সেনাদের অপর গুলিবর্ষণ করতে থাকে। মতিয়ার রহমান, খলিল, মোহাম্মদ আলী এবং আরোঁ কিছু আসীম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানী সেনাদের ধাওয়া করার জন্য অবস্থান ছেড়ে সামনে এগিয়ে যান। পাকিস্তানী বাহিনী পার্শ্ব আক্রমণের সম্ভাবনা বুঝতে পেরে পশ্চাৎপসরণের সিদ্ধান্ত নেয়।
বেলা আনুমানিক ২টার দিকে পাকবাহিনী তাদের প্রাথমিক অবস্থান কাশিপুর- শার্শা সড়কের পুর্ব পাশ ছেড়ে অর্ধাকিলোমিটার দূরে বড় পুকুর এলাকায় রাস্তার উভয় পাশে অবস্থান নেয়। সুবেদার মনিরুজ্জামান নির্ভীক পরিচালনায় মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানী বাহিনীর অপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করলে তারা বিশৃংখলাভাবে পশ্চাৎপসরণ করতে শুরু করে।
বিকেল ৩টার দিকে শত্রু বড় পুকুর থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার পূর্বে চেয়ারম্যান বাড়ি এলাকায় বিশৃঙ্খলাভাবে অবস্থান নেয়। পশ্চাৎপসরণের সময় শত্রু মুক্তিযোদ্ধাদের নির্ভুল লক্ষ্যভেদের সম্মুখীন হয়ে বিপুল সংখ্যায় হতাহত হয়। এ সময় পাকিস্তানী হানাদারদের সাথে হাতাহাতি যুদ্ধের সূচনা হয় এবং সুবেদার মনিরুজ্জামান বীরবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েন শত্রুর ওপর। হঠাৎ জঙ্গলের ভেতরে বটগাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা শত্রু মাত্র ৪-৫ গজ দূর থেকে সুবেদার মনিরুজ্জামানকে লক্ষ্য করে গুলি করে। তিনি সাথে সাথে লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধা বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ নূর মোহাম্মদ এবং সুবেদার মনিরজ্জমান পাশাপাশি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন কাশিপুর-বয়রা সীমান্তে।
সুবেদার মনিরুজ্জামানের আকস্মিক মৃত্যু মুক্তিযোদ্ধাদের হতবিহবল করে দিলেও কিছুক্ষণের মদ্ধেই তারা দ্বিগুণ পরাক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রুর ওপর। ইতিমধ্যে কোম্পানি অধিনায়ক ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদা পশ্চিম দিক দিয়ে শত্রুর ওপর আক্রমণ করলে পাকবাহিনী দিশেহারা হয়ে ছুটিপুর পর্যন্ত দীর্ঘ ৪ কিলোমিটার পথ ছুটে পালাতে থাকে এবং আর কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। পালানোর পথে তারা মৃতদেহ, অস্ত্র এবং যানবাহন রাস্তায় বিক্ষিপ্তভাবে ফেলে যায়। পরবর্তীতে রণাঙ্গনে থে ৬০ জন পাকিস্তানী সেনার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে ৩ জন। এছাড়া ১টি রকেট লঞ্চারসহ ৩০টি চাইনিজ রাইফেল পাকিস্তানী সেনাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়। পাকিস্তানী বাহিনীর ফেলে যাওয়া ৪টি ট্রাক এদিন মুক্তিবাহিনীর হাতে ধ্বংস হয়। মুক্তিবাহিনীর পক্ষে নিহত হয় শুধুমাত্র ১ জন।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত