You dont have javascript enabled! Please enable it!

কালির ভাংতির যুদ্ধ, চাঁদপুর

চাঁদপুরে কালির ভাংতি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। নভেম্বরের শেষ দিকের ঘটনা। আমি হোসেনপুর এরিয়া ইনচার্জ শাহ্‌ মোঃ শাহাদাৎ হোসে (বর্তমান মেজর অবঃ) এর ক্যাম্প পরিদর্শনে যাই। ভোরবেলা আমরা কেউ নাস্তা করেছি কেউ করব এমন সময় খবর এল পাকবাহিনী কালির ভাংতি নামক স্থানে নিরীহ জনগণের উপর অত্যাচার করছে। তারা নিরীহ জনগণের বাড়ি বাড়ি হানা দিয়ে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি লুটে নিচ্ছে। কাউকে দিয়ে পুলের নিচে বাঙ্কার খোঁড়াচ্ছে। খবর পেয়ে আমরা দৌড়ে স্পটে এসে মহাবিপদে পড়ে গেলাম। আমরা বাড়ির আড়ে বসে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের অপকর্মের দৃশ্য দেখছি, কিন্তু আক্রমণ করতে পারছি না। কারণ গুলি হলে নিরীহ জনগণ মারা পড়ে যাবে। এখন তাদের ফায়ার করা মানে নিজ হাতে জনগণকে হত্যা করা। আমি হোসেনসহ ৪/৫ টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বাড়ি ঘরের আড়ে আড়ে অনেকটা ভিতরে ঢুকে পড়ি। আমাদের উপস্থিতি ওরা টের পায়নি। এদিকে লোক পাঠিয়ে সফরমালি ক্যাম্পে খবর পাঠাই। সেখান থেকে বাবুল ভাই তাঁর গ্রুপের বন্ধুদের নিয়ে এসে যোগ দেয়। আস্তে আস্তে গ্রামের লোকজন বুঝতে পারল আমরা পাকিস্তানীদের ঘিরে ফেলেছি। তারা যে দিকে পারে পালাতে লাগল। পাকিস্তানীরা আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে গেল। ওরা প্রাণের ভয়ে দ্রুত রাস্তার দিকে দৌড়াতে লাগল। আমরা মেইন রাস্তায় এ্যাম্বুশ করি। পাকিস্তানীরা সংখ্যায় ছিল একটি সেকশান। তারা মাদের এ্যাম্বুশ করি। পাকিস্তানীরা সংখ্যায় ছিল একটি সেকশান। তারা আমদের এ্যাম্বুশে পড়লে পড়থম ফায়ারেই ২/৩ জন ধানক্ষেতে পড়ে যায়। বাকিরা পজিশন নিয়ে আমাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। উভয় দিকের গুলিতে ২/৩ জন সাধারণ নাগরিক আহত হয়। কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল বাবুরহাটের দিকে আকাশে ধোঁয়া উড়ছে অর্থাৎ পাকিস্তানীদের রেই ফোর্স আসছে। আসার পথে ওরা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে। ঘন্টাখানেকের মধ্যে প্রচুর পাকিস্তানী সৈনিক এসে আমাদের সামনে অবস্থান নিয়ে মোকাবেলা শুরু করল। ওরা এবার ভারি মেশিনগান ও মর্টারের সাহায্যে আক্রমণ করছে। এ যেন বিড়াল ইঁদুরের খেলা। একবার ওরা আগায় আমরা ধাওয়া করি, আবার ওরা ধাওয়া করে, আমরা পিছু হটছি। সেদিন পাকিস্তানী এবং আমরা প্রায় ২০/২৫ গজের মাথায় লড়াই করি ভাবতে অবাক লাগে। কোন কোন সময় মাঝখানে শুধু ধান ক্ষেতের আইল। সে দিন দুই মাইল এরিয়ার মধ্যে থেমে থেমে আমাদের সাথে লড়াই হয়। সারাদিন লড়াই চলে, আমরা দেখেশুনে মোকাবেলা করছি। সত্যি ভীষণ চিন্তায় ছিলাম, না জানি আজ আমার সমস্ত বাহিনী পাকবাহিনীর হাতে মারা পড়বে। আমার লোকজন ৫/৬ টি গ্রুপে বিভক্ত হওয়াতে এক গ্রুপের সাথে আরেক গ্রুপের যোগাযোগ রক্ষা করাটা ছিল সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার। মাঝখানে আরো পাকবাহিনী এসে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করাতে আমারা তাদের মরণপণ আক্রমণে পড়ে যাই। তার পরেও মজার ব্যাপার ছিল যখনই পাকবাহিনী মাথা তুলে এগিয়ে আসছিল অমনি আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা গুলি করে ফেলে দিচ্ছিল। এত দুঃখের এত ঝুঁকির মাঝেও যে পাকবাহিনী গুলি খেয়ে ব্যাঙের মত লাফিয়ে উঠছে, আর তখনি আমরা সহযোদ্ধারা চিৎকার করে বলত আরো একটা শেষ। এই মরণ খেলার মধ্যেও তারা নির্বাক যুদ্ধ করছে আর মজা করছে। এখানে হোসেন একবার প্রায় পাকিস্তানীদের কাছে ধরা পড়ে গিয়েছিল কিন্তু ওর দল বীরত্বের সাথে লড়ে পাকবাহিনীকে হটিয়ে দেয়। সারা এলাকা জুড়ে লড়াই চলে। বহু দূরে দাঁড়িয়ে জনগণও যুদ্ধের আলামত দেখছিল। আমার বাহিনীর লোকদের গোলাবারুধ প্রায় শেষ হয়ে আসছে। এরই মাঝে মতলবের জসিমের দলের একটি গ্রুপ এসে পড়াতে পাকবাহিনীর প্রতিরোঢের দূর্গ ভেঙ্গে পড়ে। জসিমের গ্রুপ হঠাত আক্রমণে তারা ভয় পেয়ে মৃত সৈনিকদের পিছে সরাতে থাকে। যাবার সময় পাকবাহিনী নিরীহ গ্রামবাসীদের সহায়তায় আহত/নিহত সবাইকে ট্রাকে করে চাঁদপুরে নিয়ে যায়। আমরা সারাদিন যুদ্ধে লিপ্ত ছিলাম। শরীর মন ক্লান্ত, সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি। হোসেনের হেডকোয়ার্টারে এসে পরিকল্পনা হলো এখনই আমরা ক্যাম্প ত্যাগ করে নিরাপদ স্থানে চলে যাব। যে কথা সে কাজ, আমরা ৪/৫ মাইল ভিতরে একটি বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। ধনী লোকের বাড়ি বলে মনে হলো> গভীর রাতে আমাদের ডাকডাকিতে একজন বয়স্ক দাড়িওয়ালা লোক হারিকেন হাতে আমাদের কাছে আসেন। তিনি আমাদের দেখে বিস্মিত হয়ে যান। তিনি চিৎকার দিয়ে উঠেন এবং বলেন, ‘আর এ দেখি আমার ছেলেরা”। তিনি ডেকে বাড়ির লোকদের বলেন, তোরা কে কোথা আছিস ওদের বিশ্রামের ব্যবস্থা কর। এই বুড়ো ভদ্রলোকটি আর কেউ নন, আমাদের দামোদরদী হাইস্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক কাজিম উদ্দিন স্যার। তিনি আমাদের বুকে জড়িয়ে ধরে ভিতরে নিয়ে আসেন। তিনি নিজেই রাত্রে আমাদের খাবারের জন্য দুধ, চিড়া, মুড়ি ও গুড়ের ব্যবস্থা করেন। পরের দিনও আমরা ওনার বাড়িতে থাকি। পরে সেখান থেকে অন্যত্র ক্যাম্প স্থাপন করি।
[৫০] ডা. মোঃ দেলোয়ার হোসেন খান

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!