কালুপুরের যুদ্ধ-১, চাঁপাইনবাবগঞ্জ
২ আগস্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলার মুশরীভূজা যুদ্ধের পর অপরাহ্নে রাজাকার খালেক নিহত ও ৪ আগস্ট নেজাম মন্ডল অপহৃত হলে মুক্তিবাহিনীর অগ্রবর্তী এফ, এফ, গ্রুপ কাশিয়াবাড়ী- দুর্গাপুর অবদা ক্যানেলে অস্থায়ী ডিফেন্স স্থাপন করে। এফ, এফ, বাহিনীর অপর একটি গ্রুপ ঘাইবাড়ী ঈদগাহ, ময়দানের স্থানে অবস্থান নেয়। কাশিয়াবাড়ী ডিফেন্স থেকে মুক্তিবাহিনী কালুপুর, কাঞ্চনতলা পর্যন্ত টহল তৎপরতা চালায়। ৫ আগস্ট কালুপুর ঠাকুরের আম বাগানে অস্থায়ী ডিফেন্স স্থাপন করা হয়। এখানে ৫ দিন অবস্থান করার মুক্তিযোদ্ধারা ৯ আগস্ট দিবাগত রাত ১২ টার পর শব্দ পান পাকবাহিনী ২টা স্পীডবোটে করে আলবদর ও রাজাকার বাহিনীর সহায়তায় রহনপুর থেকে নদী পার হয়ে কাঞ্চনতলায় অবস্থান গ্রহণ করছে। মুক্তিযোদ্ধারা সারা রাত স্পীডবোটের শব্দ শুনতে পান। পাকবাহিনী, আলবদর ও রাজাকার বাহিনীর একটি দল চৌডালা অভিমুখে গমন করে এবং শত্রুবাহিনীর অপর একটি বৃহ্য বহর (রাজাকার, আলবদরসহ) প্রায় ৫/৬ শ’ মতো কাঞ্চতলায় জমায়েত হয়। রাত পেরিয়ে ১০ আগস্ট, মঙ্গলবার (২৬ শ্রাবণ, ১৩৭৮) ফজর আযানের পর ডিফেন্স থেকে রহনপুর এলাকার মুক্তিযোদ্ধা সোহরাবকে রেকি করার জন্য পাঠানো হয়। তিনি মাথায় মাতাল, হাতে লাঠি ও গলায় গামছা দিয়ে কৃষকের বেশে কাঞ্চনতলা অভিমুখে মহানন্দা নদীর ঘাটের দিকে গমন করেন। কিছুক্ষণ পর রেকি করে সোহরাব ফিরে এসে হানাদার বাহিনীর এ্যাডভান্স হবার খবর দিয়ে ডিফেন্সের সহযোদ্ধাদের সাবধান করে দেন। মুক্তিবাহিনী দ্রুত সতর্কতার সাথে অবস্থান গ্রহণ করে। এখানে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল প্রায় ৭১ জন। ৩০ জনের মতো যোদ্ধা কাশিয়াবাড়ী ডিফেন্স কভারিং দেয়ার জন্য অবস্থান করেন। এই সম্মুখ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর প্রধান কমান্ডার ছিলেন ইপিআর সুবাদার গফুর মন্ডল। অন্যান্য ট্রুপস কমান্ডাররা হচ্ছেন, আর্মি সুবাদার কুতুবউদ্দিন (তিনি মুজাহিদ বাহিনীর ক্যাপ্টেন ছিলেন), ইপিআর সুবাদার কফিলউদ্দিন (জেসিও), ইপিআর সুবাদার মীর মোকাদ্দেশ, আনসার এ্যাডজুট্যান্ট গোলাম মোস্তফা ও আনসার পিসি সৈয়দ আঃ রাজ্জাক রাজা-প্রভৃতি। প্রথমে মুক্তিবাহিনী ফায়ার ওপেন করার মধ্যে দিয়ে ভোর প্রায় সাড়ে ৪টার দিকে উভয় পক্ষের প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হয়। হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা রাইফেল, ষ্ট্যন্ডগান, এসএমজি, এলএমজি ও থ্রি-ইঞ্চি-মর্টার ব্যবহার করে। অপরদিকে পাকফৌজ রহনপুর এবি উচ্চ বিদ্যালয় অস্থায়ী সেনাছাউনি থেকে থ্রি-ইঞ্চি-মর্টার, মকরমপুর কলঘর থেকে রকেট লাঞ্চার ও মকরমপুর ঘাটের পাইকড় গাছ থেকে এসএমজি’র গোলা নিক্ষেপ করে। হানাদার বাহিনী সে যুদ্ধে শিলা-বৃষ্টির মতো গুলি বর্ষণ করে। মুক্তিবাহিনী শত্রুপক্ষের প্রচণ্ড চাপের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয়। তাছাড়া মুক্তিবাহিনীর রসদ ফুরিয়ে এসেছিল। আর্টিলারির আঃ মান্নান টু-ইঞ্চি-মর্টারের গোলা নিক্ষেপ করতে করতে মুক্তিযোদ্ধাদের পিছু হটে আসতে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক কৌশল গ্রহণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের মতে, সেদিন এতই ভয়ানক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল যে, টু-ইঞ্চি-মর্টারের গোলা নিক্ষেপ করার কৌশলে মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদপসরণ না করলে বাঁচার উপায় ছিল না। এছাড়া বাগানের বড় বড় আম গাছ মুক্তিবাহিনীর প্রাণ রক্ষার্থে খুবই সহায়ক ছিল। হানাদার বাহিনীর ভারী অস্ত্রের নিক্ষিপ্ত গোলা বড় বড় গাছগুলো মুক্তিবাহিনী ওপর আঘাত হানতে বাধার সৃষ্টি করে। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হলেও পাকবাহিনীর ৯/১০ জনের মতো সেনা হতাহত হয় বলে জানা যায়। মুক্তিবাহিনী পিছু হটে এসে সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে লালাপুর মাদ্রাসায় জমায়েত হয়। সেখানে খাওয়া-দাওয়া সেরে মুক্তিবাহিনীর একটি বড় অংশ থানা ভবনে ফিরে আসে। মুক্তিবাহিনীর অপর একটি ট্রুপস (লড়াকু টহল দল) সৈয়দ আঃ রাজ্জাক রাজার নেতৃত্বে কাশিয়াবাড়ী অবদা ক্যানেল ডিফেন্সে অবস্থান গ্রহণ করেন। এই যুদ্ধে আতংকিত মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্র ফেলে বিল সাঁতরিয়ে মধুপুর গ্রামে এসে উপস্থিত হন। এই ঘটনায় একজন মুক্তিযোদ্ধা নিখোঁজ হবার দরুন মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা চিন্তিত হন। হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের পিছু হটিয়ে কাশিয়াবাড়ীর পূর্ব প্রান্ত পর্যন্ত এসে ফিরে যায় রহনপুরে এবং রাজাকার, আলবদরসহ এক প্লাটুন ফৌজ বোয়ালিয়া হাই স্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করে অবস্থান গ্রহণ করে। পাকফৌজের অপর একটি প্লাটুন রাজাআর, আলবদর সহযোগে চৌডালা হাই স্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করে। এই দিন ভারতীয় বিএসএফ বাহিনীর একটি কোম্পানি মুশরীভূজা ইউসুফ আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের ডিফেন্স স্থাপন করে কালুপুরে যুদ্ধরত মুক্তিবাহিনিকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য। কিন্তু বিএসএফ পাকফৌজের প্রচণ্ড গোলা বর্ষণের শব্দ পাওয়ার পর ভীত-সস্ত্রস্ত ও আতংকিত হয়ে পড়ে এবং তারা ফুটন্ত ভাত, মাংস, মশলা ও অন্যান্য জিনিস-পত্র ফেলে ভারতে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের মতে, এই দিন যুদ্ধে বিএসএফ সাপোর্ট দিলে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করা সম্ভব হতো, ফিরে আসতে হতো না। বিএসএফ-এর ওই কোম্পানির ৪ জন কমান্ডিং অফিসারের মধ্যে ছিলেন ক্যাপ্টেন চতুর্বেদী, ক্যাপ্টেন বিক্রম রায় বাহাদু-প্রভৃতি। মুক্তিবাহিনী পিছু হটে থানা ভবে ফিরে এলে ওই সব মুক্তিযোদ্ধাদের পুনরায় জজ আঃহান্নান চৌধুরী ও হাফিজুর রহমান হাসনু, ক্যাপ্টেন আলতাফের নেতৃত্বে দলদলী যেতে নির্দেশ দেন। ১০ আগস্ট রাতে ৬০/৭০ জন মুক্তিযোদ্ধা দললদলী গিয়ে সেরাজ বিশ্বাসের ফাঁকা বাড়ীতে ক্যাম্প স্থাপন করেন। এই ক্যাম্প দলদলী কোম্পানী হেডকোয়ার্টার হিসেবে চিহ্নিত হয়। এখান থেকে মুক্তিবাহিনীর অগ্রযাত্রা সফলতার সাথে এগিয়ে চলে। দলদলী কোম্পানি কমান্ড থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন দলে ভাগ করে টহল তৎপরতা জোরদার করা হলো। পরের দিন একটি বড় দলকে আলীনগর বাঙ্গাবাড়ী রক্ষার জন্য নদীর ওপারে পাঠানো হলো। নদীর পশ্চিমপারে মুক্তিযোদ্ধারা কালপুর, কাঞ্চনতলা পর্যন্ত টহল তৎপরতা চালান। আগস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহের দিকে লেঃ রফিক ও নজরুল ইসলাম প্রায় শ’খানেক মুক্তিযোদ্ধা সাথে নিয়ে এই দলদলী কোম্পানি হেডকোয়ার্টারে যোগদান করেন। যোগদান করে লে. রফিক কোম্পানি কমান্ডার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এরপর ডিফেন্সে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে লেঃ রফিক পরিচয় করিয়ে ক্যাপ্টেন আলতআফ নদীর ওপারে আলীগর-বাঙ্গাবাড়ী রণক্ষেত্রে গমণ করেন।
[৫৯৭] মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত