কালাসেনা থেকে ফজলুপুর, গাইবান্ধা
‘নভেম্বর মাসের শুরুতেই শীতের অগমন ধ্বনিত হয়। তখন স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার সংগ্রামে বীর মুক্তিযোদ্ধারা খাদ্য, বস্ত্র ও ঔষধের অভাবে নিদারুণ সংকটের মুখোমুখি। নদীর পারে সেই কালাসোনা চরের সাহসী বীর যোদ্ধারা শীতের প্রকোপে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে দিবারাত্র বিশেষ করে কাকভোরে শত্রুসেনাদের ঘাঁটিগুলির উপর আক্রমণ করতে এবং বর্বরদের প্রতিহত করতে ব্যস্ত থাকত। এ ভোরে খবর এলো হানাদাররা আক্রমণ যে হতে পারে সেটা আমাদের ছেলেদের অজানা ছিল না। একটার পর একটা অভিযানের মধ্য দিয়ে আমাদের ছেলেরা তখন যুদ্ধে পারদর্শী হয়ে উঠেছে। সামান্য প্রশিক্ষণ পেয়েও বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে মুক্তিসেনারা দূরদর্শী। নিখুঁত প্লান তৈরী ও তা কার্যকর করার পদ্ধতি দেখে অবাক হতে হতো। মাহবুব এলাহী রঞ্জু তাঁর কোম্পানীর সহযোদ্ধাদের নিয়ে পশ্চিম পারের নদী পার হয়ে ধানের ক্ষেতে অবস্থান নিল। ভোর বেলাতেই তুমুল সংঘর্ষ বেঁধে গেল। সূর্য উঠলো, সকালবেলা রণাঙ্গন আরও তেতে উঠলো। আমাদের ছেলেদের বজ্রশপথ,’ অবস্থান ছাড়বো না’। আধাপাকা ধানের ক্ষেতের আলে ছেলেরা অবস্থান নিয়েছে। স্বভাবতই বর্বরদের অবস্থান ঐ মুহূর্তে ভাল ছিল। বীরসেনানী ফজলুর ঘাড়ে হঠাৎ একটি গুলি লাগলো। ও কাৎরাচ্ছে, ছট ফট, করছে। এমন সময় ঝড়ের বেগে সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে মান্নান ওর কাছে চলে এল। জানিনা এত ওর যন্ত্রণার কিছু লাঘব হয়েছিল কি না। বৃষ্টির মত গুলি তখন ওদের দিকে আসছে। নিশ্চিত মৃত্যু ভেবে পাশেই একটু নিরাপদ স্থানে অবস্থান নেবার আশায় মান্নান ওকে পিঠে নিয়ে লাফ দিল। নিয়তি এতই বিরূপ যে পুনরায় ফজলুর পিঠে, কোমরে গুলি লাগলো। মানসিক দৃঢ়তার বলে বলীয়ান হলেই জীবনীশক্তি ধরে রাখা যায় না। শহীদ হলো ফজলু। রণাঙ্গনে লাশ হয়ে পড়ে থাকলো। সকাল থেকে দুপুর অবদি যুদ্ধে আরওঁ অনেকে আহত হলো। শত্রুসেনারা পিছু হটলো। চারদিকে নিস্তব্ধ, নিথর। ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত মুক্তিসেনারা শোকে মূহ্যমান। ফজলুর লাশ নিয়ে কালাসোনার চরে ফিরলো ওরা। শহীদের মর্যাদায় ফজলুর দাফন-কাফন সম্পন্ন হলো। উপস্থিত জনতা প্রস্তাব দিল কালাসোনা ইউনিয়নের নাম আজ থেকে ফজলুপুর ইউনিয়ন হবে। সেই থেকে এই এলাকাটি শহীদকে বুকে ধারণ করে ফজলুপুর নামে পরিচিত হয়ে আসছে।
[৫৮০] ড. মোঃ মাহবুবর রহমান
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত