You dont have javascript enabled! Please enable it!

কালিঘাট চা কারখানা আক্রমণ, মৌলভীবাজার

মৌলভীবাজার জেলার সীমান্তবর্তী ইউনিয়ন কালিঘাট। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে প্রায় ৯ কি.মি দূরে কালিঘাট চা বাগান। বাগানেই কারখানাটি অবস্থিত। তারপরই ভারতীয় ভূখণ্ড কমলপুর। এখান থেকে একটি সড়কপথে বিভিন্ন চা বাগানের ভেতের দিয়ে ধলই, পত্রখলা হয়ে কমলগঞ্জ থানা সদরে যাওয়া যায়। সীমানা নির্ধারণ করেছে এখানে একটি খাল না ভুরভুইর ছড়া। খালের পাড়েই কালিঘাট সীমান্ত ফাঁড়ি। এখানেই ছিল পাকিস্তানী বাহিনী ক্যাম্প। এখান থেকে প্রায় ৪ কি.মি দূরে ভারতীয় ভূখণ্ড কমলপুরে ছিল মুক্তিবাহিনী একটি ক্যাম্প, কমান্ডার ক্যাপ্টেন এনামুল। ক্যাম্পে ছিল ১ ইস্ট বেঙ্গলের একটি কোম্পানি ও মুক্তিবাহিনীর ২টি কোম্পানি। মুক্তিযোদ্ধাদের কোম্পানিগুলো পরিচালনা করতে বাবরুল হোসেন বাবুল ও শমসেরনগরের মুজাহিদ ক্যাপ্টেন সাজ্জাদুর রহমান। সীমান্ত থেকে প্রা ১৩ কি.মি দূরে কালিঘাট চা বাগান। এই এলাকার মধ্যে বড় কারখানাগুলোর মধ্যে কালিঘাট কারখানা অন্যতম। ৪ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত ক্যাম্পে এসে কালিঘাট চা কারখানা ধ্বংস করার নির্দেশ দেন। অর্থনৈতিক দিক থেকে পাকিস্তানী সরকারকে দুর্বল করার লক্ষ্যেই যেমন করে হোক এই কাজ সম্পন্ন করার তাগিদ দেন তিনি। বিভিন্ন কমান্ডারের নেতৃতে ৩ বার এই কারখানায় অভিযান চালানো হয়। কিন্তু শত্রুর শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে বাগানে প্রবেশ করা সম্ভব হয়নি। এর পর ১৬ আগস্ট ধার্য করা হয় চতুর্থ অভিযানের তারিখ। ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল গঠন করা হয়। কমান্ডার নিযুক্ত হন কমলপুর ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার মহিউদ্দিন আহমেদ। সহকারী হন সুবলচন্দ্র পাল এবং বাবরুল হোসেন বাবুল। তাদের সাথে ছিল ২ ইঞ্চি মর্টার, এলএমজি, স্টেনগান, গ্রেনেড, ডিনামাইটসহ প্রচুর বিস্ফোরক দ্রব্য ও গোলাবারুদ। পথপ্রদর্শক ছিলেন একজন খাসিয়া উপজাতি। এ অঞ্চলে পথঘাট সম্পর্কে তাঁর প্রচুর জ্ঞান ছিল। প্রস্তুতি চূড়ান্ত হলে সন্ধ্যার বেশ আগেই মুক্তিবাহিনী গন্তব্যস্থল অভিমুখে রওনা হন। রাত প্রায় আড়াইটার সময় ৪০ জন মুক্তিবাহিনীর দলটি কালিঘাট চা বাগানের ভেতরে প্রবেশ করে। কারখানার কাছেই বাগানের হাসপাতালে ছিল পাকিস্তানী ক্যাম্প নিরীহ শ্রমিকদের তারা বাধ্য করত পাহারা দেয়ার জন্য। তীর-ধনুক নিয়ে বাগানের চারদিকে রাতব্যাপী তারা পাহারায় নিযুক্ত থাকত। সামান্যতম অবহেলার কারণে মৃত্যুদণ্ডই ছিল তাদের শাস্তি। মুক্তিবাহিনীর এ দলটিকে দেখে প্রহরারত সৈনিকেরা তীর ছুড়তে শুরু করে। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের বাধ্য হয়ে গুলি ছুড়তে হয়। গোলাগুলি শুরু হওয়ার সাথে সাথে প্রহরারত শ্রমিক এবং কর্মরত টিলাবাবু ও অন্যরা সব পালিয়ে যায়। কারখানা তখন সম্পূর্ণ অরক্ষিত। মহিউদ্দিন এবং বাবুল দু’টি দল নিয়ে বহির্মুখী দু’টি প্রতিরক্ষা বেষ্টনী তৈরি করে। এদিকে বিস্ফোরক দিয়ে গেট ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করে সুবল চন্দ্র পাল, সাথে খালেদ উদ্দিন, জনাব আলী ও আরো তিনজন। তড়িৎ গতিতে প্রয়োজনীয় স্থানে ডিনামাইট স্থাপন করে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। সাথে সাথেই পাকিস্তানীরা গুলিবর্ষণ শুরু করে দেয়। গুলিবর্ষণ করতে করতেই তারা অগ্রসর হতে থাকে কারখানার দিকে। গেটের কাছাকাছি আসার সাথে সাথেই তাদের ওপর প্রচণ্ড বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ে মহিউদ্দিনের দল। প্রথমবারেই মারা যায় ১০ জন পাকিস্তানী, গুরুতর আহত হয় আরো অনেকে। এ সময় কভারিং পার্টি মর্টার ব্যবহার করতে ব্যর্থ হলে বাবুল তাঁর গ্রুপ নিয়ে অবস্থান ছেড়ে সরে যায়। ফলে পাকিস্তানীরা কিছুটা সংঘবদ্ধ হওয়ার সুযোগ পায় এবং তারা পুনরা কারখানার দিকে এগোতে থাকে। ভেতরে আটকা পড়ে মূল দল। কারখানার নিচের ড্রেন দিয়ে পিছন দিক দিয়ে বের হয় তারা। তারপর ১৮ ফুট উঁচু কাঁটাতারের বেড়া দিঙ্গিয়ে বিপদমুক্ত হন। বহু কষ্টে বিভিন্ন দল বাগানের সীমান্তে আবার একত্র হয়। এই অপারেশনে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা গুরুতর আহত হয়। এর মধ্যে সুরুজ আলীর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল খুব বেশি। মহিউদ্দিন তাঁকে নিজ কাঁধে বহন করছিলেন। আধঘন্টাব্যাপী যুদ্ধ চলাকালে রাজাকারের একটি দল মুক্তিবাহিনীদের প্রতি তীর ছুঁড়তে থাকে। চলে আসার সময় মুক্তিবাহিনী ১৬ জন রাজাকারকে বন্দি করে।
বিজয়ের আনন্দে এবার দ্রুত ক্যাম্পের দিক অগ্রসর হতে থাকে এ বাহিনী। সঙ্গে তাদের ১৬ জন বন্দি রাজাকার কাঁধে রক্ত শূন্য সুরুজ আলীর দেহ। সুরুজ আলীর চিকিৎসা করার সুযোগ আর পাওয়া গেল না। মুখে একবার ‘জয় বাংলা’ উচ্চারণ করেই ঢলে পড়েন তিনি মৃত্যুর কোলে। ভারতীয় ভূখণ্ডেই সুরুজকে দাফন করা হয়।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!