কামান্নার যুদ্ধ, শৈলকূপা
২৬ নভেম্বর ভোর রাতে স্বাধীনতার সূর্যদয়ের মাত্র ক’দিন আগে কামান্না গ্রামে এক বর্বর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে যায়। পাক হানাদার বাহিনীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞে শৈলকূপাকে হানাদারমুক্ত করার দৃঢ় প্রত্যয় ও শপথ নিয়ে থানা সদর থেকে ১০ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে কুমার নদের পাশে কামান্না গ্রামে মাধব চন্দ্র ভৌমিকের বাড়িতে একদল মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয় নেন। এসন মুক্তিযোদ্ধার অধিকাংশরই বাড়ি মাগুরা জেলার শ্রীপুর থানার হজিপুর এলাকায়। হজিপুরের আবু বকর এবং শৈলকূপা থানার মালিথিয়া গ্রামের আলমগীর ছিলেন এঁদের দলনেতা। মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি ও অবস্থানের সংবাদ স্থানীয় রাজাকারদের মাধ্যমে চলে যায় দ্রুত গাড়াগঞ্জে রাজাকার-মুজাহিদ ক্যাম্পে এবং সেখান থেকে ঝিনাইদাহ শহরে অবস্থিত পাক আর্মি ক্যাম্পে। এরপর সেখান থেকে৩ খবর যায় মাগুরায় অবস্থিত অস্থায়ী পাক মিলিটারি ক্যাম্পে। দুদিক থেকে পাকসেনারা ভারি অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত হয়ে রাতের আধারেই কামান্নায় পৌঁছে যায় এবং শত শত খানসেনা চতুর্দিক থেকে গ্রামটি ঘিরে ফেলে। তাদের সাথে যোগ দেয় রাজাকার বাহিনী। পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের আস্তনা লক্ষ্য করে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে অতর্কিতে চারদিক থেকে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ শুরু করে। আকস্মিক এই আক্রমনে মুক্তিসেনারা হতবিহবল হয়ে পড়ে। এঁদের অনেকেই তখনও ঘুমিয়ে ছিলেন। মূহূর্তের ভেতরে নিজেদেরকে সামলে গিয়ে দৃঢ় হাতে তুলে নেন হাতিয়ার। তারাও পাল্টা আক্রমণ চালায়। কিন্ত পূর্ব থেকে প্রস্তুত হানাদার বাহিনীর আক্রমণের মুখে তারা বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারে না। ঘরের মধ্যে আটকা পড়ে যায় অনেকেই। ফলে তাদের কেউ কেউ কোনোক্রমে বেঁচে গেলেও শহীদ হন ২৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ভোর হতেই এই দুঃসংবাদ ছড়িয়ে পরে চারদিকে। শোককাতর হাজার হাজার স্বাধীনতাকামী মানুষ ছুটে আসে কামান্নায়। তারা এসেই ঘরের মেঝেতে, বাইরে, উঠোনে এবং এদিক-সেদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ২৭ টি ছিন্নিভিন্ন লাশ এক জায়গায় জড়ো করেন। শুধু এরাই নন, এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী ফণীভূষণ মজুমদারসহ মুক্তিযোদ্ধাদের কাজের মেয়ে রঙ্গ বিবিও শহীদ হন। নদীতে পানি আনতে ক্রস ফায়ারের মধ্যে পড়ে ও ভাগ্যক্রমে ছামেনা বেগম নামে এক মহিলা প্রাণে বেঁচে যান। গুলি তাঁর পিতলের কলসিতে লাগলেও, তা পুরোপুরি ভেদ করে তাঁর শরীরে না লাগায় তিনি বেঁচে যান। হানাদারদের বুটের লাথির আঘাতের ব্যথা ও সেই ফুটো কলসি সঙ্গী করে ছমেনা বেগম এখনো বেঁচে রয়েছেন। এদিকে আবারো নরখাদক রক্তপিপাসুরা আসতে পারে এই আশঙ্কায় শহীদদের লাশগুলো তড়িঘড়ি করে কামান্না হাই স্কুলের খেলার মাঠের উত্তরের খরস্রোতা কুমার নদের পাশে ৬জন করে দুটি এবং ৫জন করে তিনটি গণকবরে ২৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সমাহিত করা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী শহীদ ফণীভূষণ মজুমদারকের হিন্দু প্রথামত দাহ এবং রং বিবিকে অন্যত্র কবর দেয়া হয়। এই ওমর ২৭ জন শহীদ হলেনঃ ১. মোমিন, ২. কাদের, ৩. শহীদুল, ৪. ছলেমান, ৫. রাজ্জাক, ৬. ওয়াহেদ, ৭. রিয়াদ, ৮. আলমগীর, ৯. মতলেব, ১০. আলী হোসেন, ১১. শরিফুল, ১২. আলীমুজ্জামান, ১৪. আনিসুর, ১৫. তাজুল, ১৬. মহিম, ১৭. রাজ্জাক, ১৮. কাওছার, ১৯. সালেখ, ২০. আজিজ, ২১. আকবর, ২২. সেলিম, ২৩. হোসেন, ২৪. রাশেদ, ২৫. গোলজার, ২৬. অধীর এবং ২৭. গৌড়। এই ২৭ শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার সমাধি ঘেঁষে নির্মিত হয়েছে একটি শহীদ মিনার। এখানে গড়ে উঠেছে ’২৭ শহীদ সংঘ’ নামে একটি ক্লাব। এছাড়া তাঁদের নামে জেলা বা থানা পর্যায়ে কোনো প্রতিষ্ঠান বা সড়কের নামকরণ আজ পর্যন্ত করা হয়নি। অদ্যাবিধি নির্মিত হয়নি। কোনো স্মৃতিস্তম্ভ। কেবল কামান্নায় শহীদ মিনারের গায়ে এই ২৭ জন বীর শহীদের নাম খোদাই করা হয়েছে।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত