কামালপুর যুদ্ধ, জামালপুর
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অনন্যসাধারণ যুদ্ধক্ষেত্র ছিল বাংলাদেশের জামালপুর জেলা ও ভারতের মেঘালয় রাজ্য-ঘেঁসা সীমান্তচৌকি কামালপুর। হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা দীর্ঘ নয় মাস পাকিস্তনী হানাদার সৈন্যদের সঙ্গে লড়াই-এ লিপ্ত ছিল এই কামালপুরে। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় কামালপুর ছিল রক্তাক্ত। ঐতিহাসিক এই রণাঙ্গন মুক্তিযোদ্ধাদের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসে ৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১। বাঙালীর ঘাতকেরা দ-হাতে উপরে তুলে, অস্ত্র ফেলে, মুক্তিবাহিনী কাছে আত্মসমর্পণ করে। ময়মনসিংহ ছিল বৃহত্তর জেলা তখন। জামালপুর হয়েছে পরে। জেলার সর্বশেষ উত্তরে কামালপুর। পাকিস্তানীদের গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত চৌকি। গারো পাহাড়ের পাদদেশে। সীমান্ত পেরুলেই মেঘালয়ের মহেন্দ্রগঞ্জ। নয় মাসে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর প্রত্যক্ষ প্রতিরোধ যুদ্ধে কামালপুর ইতিহাসখ্যাত। কয়েক হাজার মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিতে অবিনশ্বর এক নাম। এই কামালপুরেই দেড় শত পাকিস্তানী সৈন্য প্রথমবারের মতো আত্মসমর্পণ করে, ঢাকা রেস কোর্সে পাকিস্তান বাহিনীর ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণের ১১ দিন আগে। তারিখ ৪ ডিসেম্বর। মেজর আবু তাহেরের নেতৃত্বে সেক্টর ১১ গঠিত হবার আগে এ অঞ্চলে অবস্থান করছিল মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বধীণ ‘জেড ফোর্স’। মুজিবনগর সরকারের সিদ্ধান্তে ‘জেড ফোর্স’ কে পাঠানো হয় সিলেট সীমান্ত। মহেন্দ্রগঞ্জের পাহাড় কেটে গড়ে তোলা হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের শিবির। একটার পর একটা তাবু। ইন্দিরা গান্ধীর ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ সহযোগী দেশ। কাজেই প্রয়োজনীয় সকল সাহায্যই পাওয়ায় যাচ্ছিল। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস পাকিস্তানী সৈন্যদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনী সরাসরি যে লড়াই হয়েছে কামালপুরে সে লড়াই ছিল রক্তাক্ত এবং দুঃসাহসিক। একের পর এক রক্তাক্ত যুদ্ধ। এসব জুদ্ধ শহীদ, আহত হন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ সহযোগী অনেক ভারতীয় সৈন্যও প্রাণ দেন এই রণাঙ্গনে। অসংখ্য পাকিস্তানিকে লাশ হতে হয় এই কামালপুরেই। ছোট বড় অসংখ্য যুদ্ধ হয়েছে কামাল্পুরের মাটিতে। মে মাস থেকে শুরু হয়ে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। জুলাই ২১-এর ভয়ংকর যুদ্ধটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ সমরের এক ভয়ংকর যুদ্ধ। পাকিস্তানী বিওপি-তে আঘাত হেনে হানাদার বাহিনীকে হটিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে লড়েছেন বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ ও তাঁর সঙ্গীরা। দেশপ্রেম ভয়ংকর পাগল করা এক আবেগ, যা অনেক অসাধ্য সাধন করতে পারে। ৩১ জুলাই-এর যুদ্ধের পর্যায়ে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ পাকিস্তান বাহিনীর বাঙ্কারে ঢুকে পড়েন। অসমাসাহসী এই মুক্তিযোদ্ধা এক পর্যায়ে হাতাহাতি যুদ্ধে লিপ্ত হন শত্রুদের সঙ্গে। পরাস্ত করেন অনেককে। কিন্ত শেষ পর্যায়ে এসে গুলিবিদ্ধ হন এবং শহীদ হন। গুরুতর আহত হন লেঃ আমিন আহমেদ চৌধুরী ও লেঃ মান্নান। শহীদ হন আরও দু’জন। সেক্টর ১১ গঠিত হয় আগস্ট মাসে। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মেজর তাহের সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব বুঝে নেন। অক্টোবরের প্রথমে ‘জেড ফোর্স’ সিলেটে চলে যাওয়ার পর বলতে গেলে নিয়মিত বাহিনীর কেউ আর রইলেন না ১১ নম্বর সেক্টরের এলাকায়। রইলেন কেবল ছাত্র জনতার কাতার থেকে যুদ্ধে যোগ দেয়া স্বল্প প্রশিক্ষিত মুক্তিবাহিনী। সামরিক অফিসারদের মধ্যে সে সময় এখানে ছিলেন মাত্র তিঞ্জন-মেজর আবু তাহের, স্কোয়াড্রন লীডার হামিদুল্লাহ ও লেঃ মান্নান। সেক্তরকে ভাগ করা হয় মানকারচর, মহেন্দ্রগঞ্জ, পুরাকাসিয়া, ডালু, রংরা ও বাগমারা –এই ছয় সাব-সেক্টরে। এর বিস্তৃতি ছিল গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, রৌমারী, কোদালিকাঠিসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও টাংগাইল জেলা নিয়ে। কিন্ত টাঙ্গাইলে সামরিক কর্মকাণ্ড মুখ্যত পরিচালিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের প্রবাদ প্রতীম কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে।
সামরিক প্রয়োজনে কামালপুর ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখান থেকে শেরপুর-জামালপুর-টাঙ্গাইলে হয়ে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ ঢাকার। সেক্টর অধিনায়ক আবু তাহের এদিক বিবেচনায় রেখেই তাঁর যুদ্ধ পরিকল্পনা স্থির করলেন। উল্লেখযোগ্য অভিযানগুলিতে অধিনায়ক তাহের নিজে অংশ নিতেন। তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমী সেনানায়ক। বিশাল সেক্টরের দায়িত্বপ্রাপ্ত তাহের ঘুরতেন দিনেরাতে। এক সাব-সেক্টর থেকে আরেক সাব-সেক্টর। ডালু, বাগমারা, পুরাখাসিয়া, মহেন্দ্রগঞ্জ, রৌমারী, কোদাল্কাঠি। নভেম্বর মাসের দিকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের নিয়গপ্রাপ্তি হয়ে নতুন কমিশন্ড অফিসার এল সেক্টর ১১-এ। এলেন লেঃ আসাদ, লে মিজান, লেঃ তাহের, লেঃ কামাল, লেঃ হাসেম। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ব্যাচের তরুণ সামরিক অফিসার। তাহের এঁদের বিভিন্ন সাব-সেক্টরের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন। সেক্টর ১১ ছিল মঊলত মুক্তিবাহিনী বা এফএফ-দের ব্যস্ততম সেক্টর। পাকিস্তানীদের চরম তটস্থ রেখেছিল এখানকার গেরিলা যোদ্ধারা। যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। বিপন্ন করেছিল হানাদার বাহিনীকে সমাজের সাধারণ স্তর থেকে উঠে আসা সাহসী জনযোদ্ধারা। মেজর জিয়াউর রহমানের প্রচলিত জুদ্ধ-রীতির পরিবর্তন ঘটালেন দায়িত্ব নিয়েই। শুধু কামালপুর নয়, দেশের অভ্যন্তরেও ছোট ছোট দল পাঠিয়ে প্রতিদিন হানাদার বাহিনীকে ভয়ংকর আতংকের মধ্যে রাখলেন। এ এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা দেওয়ানগঞ্জ, বাহাদুরাবাদ, জামালপুর, জগন্নাথগঞ্জ, সরিষাবাড়ি ও মাদারগঞ্জ, ইসলাম্পুর এলাকায় একের পর এক অভিযান চালিয়েছে। অভিযান চালিয়েছেন ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ। কৌশলগত দিক বিবেচনা করে পাকিস্তান বাহিনী সুরক্ষিত বাঙ্কার গড়ে তোলে কামালপুরে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা বাঙ্কার গড়ে তোলা হয় ধানুয়া-কামাল্পুরে। এই বাংকারগুলিতে রাইফেল-মেশিঙ্গান উঁচিয়ে দিনরাত বসে থাকার স্মৃতি আছে আমাদের। প্রায় প্রতিদিনই হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘর্ষ চলতে থাকে। ঝরতে থাকে রক্ত। হেড কোয়ার্টার সামলাতে থাকেন সৈয়দ মনিরুজ্জামান, মোহাম্মদ আলী ওঁ আব্দুল কাইয়ুমসহ আরও অনেকে। অক্টোবর-নভেম্বর মুজিবনগর সরকার জুদ্ধ-পর্যালোচনায় বসে। নবেম্ভর মাস থেকে হানাদার বাহিনীর উপর আঘাতের তীব্রতা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ১৩ নবেম্বর রাত। সিদ্ধান্ত মতে রাত ১২টায় কামালপুর উপর সর্বাত্নক আক্রমণের সূচনা হয়। আমাদের দলটির অবস্থান ধানুয়া ওঁ খাসিরহাট গ্রামের মাঝখানটায়। ঐতিহাসিক সে যুদ্ধে যার যার দল নিয়ে দায়িত্ব ছিলেন লেঃ মান্নান, লেঃ মিজান, আবু সাইদ, আখতার, পান্না ওঁ জয়নাল আবেদীন। ছিলাম আমিও। কামালপুর রণাঙ্গনে এক দুঃসাহসিক কোম্পানি কমান্ডার সৈয়দ সাদরুজ্জামান হেলাল কামালপুরে যত যুদ্ধ হয়েছে তাঁর প্রায় প্রতিটিতেই অংশ নিয়েছে সে। এ ছাড়াও ছিল বেলাল, বাহার, ইয়াকুব, ফারুক ওঁ আরও অনেকে। এরা সর্বক্ষণ থাকতো মেজর তাহেরের সঙ্গে। ১৩ নবেম্বর কামালপুর অভিযান ছিল অভূতপূর্ব এক সম্মুখ সমর। সৈয়দ মুনিরুজ্জামান সেক্টর হেড কোয়ার্টারে ওয়াকিটকে নিয়ে সকলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। সে রাতে কমান্ডার তাহেরের কোড নাম রাখা হয়েছে ‘কর্তা’। এ নামেই ওয়াকিটকিতে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে। ভারতীয় পক্ষ কামান নিয়ে আমাদেরর সাহায্য করতে প্রস্তুত। রাত ৩টা ৪৫ মিনিটে শুরু হলো আক্রমণ। বৃষ্টির মতো গোলা ওঁ গুলিবর্ষণ দু-পক্ষ থেকেই। কামালপুর ছিল খুবই সুরক্ষিত পাকিস্তানী ঘাঁটি। কাজেই ব্যাপক আক্রমণের পরও খুব বেশী ক্ষতি করা গেল না, শত্রুদের। ওরা আত্নসমর্পণ করলো না। ভোরের দিকে গোলাগুলি বন্ধ হলো। হঠাৎ লেঃ মিজানুর অগ্রবর্তী বাহিনীর সনবগে যোগাযোগ বন্ধ হলো। বেলা প্রায় সাড়ে আটটার দিকে মেজর তাহের তাঁর অবস্থান থেকে মূল ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হলেন। তিনি চিন্তান্বিত, মিজানকে পাওয়া যাচ্ছে না। ন’টার দিকে শত্রুপক্ষের একটি শেল তাহেরকে সরাসরি আঘাত করলো। তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন। হেলাল, বেলাল, বাহার, সুজাসহ অধিনায়কের সাথীরা সব হতবিহবল হয়ে পড়লো। সহযোদ্ধারা আহত সেক্টর কমান্ডারকে বহু কষ্টে ভারতীয় এলাকায় নিয়ে গেল। বিক্ষত পা কেটে তাঁকে বাঁচাবার চেষ্টা করা হলো। ভারতীয় ডাক্তার মুখার্জী এবং সেক্টরের ডা. প্রেমাংকুর রায় তাকে দেখাশোনা করতে থাকলে। নিয়ে যাওয়া হলো তাঁকে গৌহাটি হাসপাতালে। কিন্তু আমাদের দুঃখ আমাদের অধিনায়ক কামালপুরে পাকিস্তানীদের পরাজয় দেখতে পাননি। স্বাধীন হবার পর একটি পা-হারা তাহের স্বাধীন দেশে ফিরলেন। হাসপাতালে তাঁকে দেখতে গেলেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তাহের আহত হলে স্কোয়াড্রন লীডার হামিদুল্লাহ সেক্টরের দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেন। মাত্র কিছুদিন আগে যোগ দিয়েছেন বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন আজিজ। তার নেতৃত্বে চলতে থাকলো সেক্টরের কার্যক্রম। ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে সলাপরামর্শ করে এরপর পাকিস্তানীদের অবরোধ করার সিদ্ধান্ত হলো কামালপুরে। হানাদার বাহিনীর প্রতিটি সরবরাহ পথে ‘এম্বুশ’ বসানো হলো। নবেম্ভর ২৪ থেকে ডিসেম্বর ৪। এই ১১ দিন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে অবরুদ্ধ থাকলো কামালপুর। ভয়ংকর সে অবরোধ, যা ভেদ করে শত্রুদের পক্ষে কোনো সরবরাহ পাওয়া সম্ভব না। নানা দিক থেকে পাকিস্তানীরা অবরোধ ভাঙ্গার চেষ্টা চালালো। কিন্তু সফল হল না। জামালপুর-ময়মনসিংহ, ঢাকা কোথাও থেকে তাঁদের কোনো সরবরাহ পৌঁছাল না। ভয়ংকর হতাশায় নিপাতিত হলো পাকিস্তান বাহিনী। ৩ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরু হলো ভারত ও পাকিস্তানের। গঠিত হলো বাংলাদেশে ও ভারতের যৌত কমান্ড। ভারতীয় ৯৫ তম মাউন্টেন ডিভিশনের ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার তখন আমাদের রণাঙ্গনে। মুক্তি ও মিত্র বাহিনী যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নিল আক্রমণ না করে প্রথমে হানাদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণ প্রস্তাব পাঠানো হবে। সে ছিল স্মৃতিময় দিন মুক্তিযোদ্ধাদের। উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রস্তাব রাখা হলোঃ কে যেতে চাও কামালপুর ক্যাম্পে আত্মসমর্পণ চিঠি নিয়ে? রীতিমতো বুঝিয়ে দেওয়া হলো। হাতে থাকবে একটি সাদা পতাকা। পাকিস্তানীরা যদি আত্মসমর্পণে রাজি না হয় তাহলে পত্রবাহকের মৃত্যু অনিবার্য। বিস্ময় ভরা চোখে দেখলাম, সবাইকে অবাক করে দিয়ে লাফিয়ে উঠল বশির নামের এক স্থানীয় তরুণ। তখন সকাল। বশির এগিয়ে এল চিঠি নিয়ে। আমরা চেয়ে দেখলাম। এক সময় দৃষ্টির বাইরে চলে গেল সে। প্রতিক্ষায় সবাই। কয়েক ঘন্টা চলে গেল। ও কি শেষ পর্যন্ত মারাই গেল! কিছু জানা গেল না। ১টার দিকে সাহসী মুক্তিযোদ্ধা আনিসুল ইসলাম সঞ্জু স্বেচ্ছায় যাত্রা করলো দ্বিতীয় চিঠিটি নিয়ে। সঞ্জু গেল আরেকটি মৃত্যু হাতে নিয়ে। সঞ্জুর হাতে দেয়া চিঠিতে বলা হলো, এক ঘন্টার আত্মসমর্পণ না করলে কামালপুর উড়িয়ে দেওয়া হবে। সেই এক ঘন্টাও পেরুলো। ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার ওয়ারল্যাস বিমান বাহিনীকে কামালপুর আঘাত করার সংকেত জানালেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আসামের ঘাঁটি থেকে ভারতীয় যুদ্ধবিমানগুলি কামালপুরের চারদিকে আঘাত হানতে শুরু করলো। ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত আমি। ইতিহাস ধরে রাখার এই-তো হাতিহার তখন। এর মধ্যে সঞ্জু ফিরে এল। বশির রয়ে গেল ক্যাম্পেই। পাকিস্তানীরা তাদের জীবনের নিরাপত্তা চেয়েছে। যৌথ কমান্ড সে নিরাপত্তা দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করলো পাকিস্তানীরা। মুক্তিযুদ্ধে সেই প্রথম আত্মসমর্পণ পাকিস্তানী নিয়মিত বাহিনীর। ডিসেম্বর ৪। অস্ত্র মাটিতে রেখে লাইন বেঁধে হাত উপরে তুলে এগিয়ে এল পরাজিত হানাদাররা। একজন ক্যাপ্টেনসহ ১০০ জন নিয়মিত সৈন্য, ৩০ জন রেঞ্জার এবং বেশ কিছু স্থানীয় রাজাকার। কিন্তু পাকিস্তানীরা মুক্তিবাহিনী থেকে সচেতন ভাবে দূরে থাকলো। কাছে ভিড়লো না। জীবনের ভয় ওদের। আমাদের অনেকেই তখন চোখে পানি। বিজয়ের আনন্দ এভাবেই চোখের পানিতে সয়লাব করে দেয়। যারা প্রায় নয়মাস এ মাটিতে নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছে, নারী নির্যাতন করেছে, তারাই আজ প্রাণভিক্ষা চাইছে! কামালপুরের পতন যুদ্ধের সার্বিক বিজয়ের পথকে ত্বরান্বিত করেছিল। এরপর যাত্রা শুরু হলো আমাদের বকসিগঞ্জ শেরপুর-জামালপুর হয়ে ঢাকার পথে। ১০ ডিসেম্বর পতন ঘটলো জামালপুরের। ক্যাপ্টেন আজিজের নেতৃত্বে তিনটি এফএল কোম্পানী। টাঙ্গাইলের কাদের বাহিনী ও ভারতীয় সৈন্যদের সম্মিলিত বাহিনী ঢাকার মিরপুর পৌঁছে গেল ১৪ ডিসেম্বর।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত