You dont have javascript enabled! Please enable it!

কানাইঘাটের যুদ্ধ, সিলেট

সিলেট জেলার উত্তর-পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত কানাইঘাট পাকিস্তানীদের সবচেয়ে শক্ত অবস্থানের মধ্যে একটি। নভেম্বর মাসে যৌথ বাহিনী কমান্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পাকিস্তানীদের ওপর সিলেটের পূর্ব ও উত্তর দিক হতে প্রবল চাপ প্রয়োগ করা হবে যার ফলশ্রুতিতে সিলেট দখল করা সহজতর হবে। তাই সিলেটের উত্তর ও পূর্ব সীমান্ত হতে সিলেট অভিমুখে অগ্রসর হতে হলে পথে পাকিস্তানীদের সকল বাঁধা ও শক্ত অবস্থান অপসারণ করতে হবে। ১ ইস্ট বেঙ্গল সিলেট- কানাইঘাট পথে ইটগ্রাম দখল করা সত্ত্বেও সিলেটের দিকে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। ৪ নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর দায়িত্ব পড়ে পকিস্তানীদের এই শক্ত অবস্থান দখল করার। ৪ নং সেক্টরের প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্যাপ্টেন রব তার সৈন্যদের লুবাছড়া চা বাগানে (কানাইঘাট থেকে ৫ কি.মি উত্তরে) সৈন্য সমাবেশ করে এবং ২৫/২৬ নভেম্বর রাতে অস্থায়ী প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করেন। এর পরের দিন মুক্তিযোদ্ধারা দরবস্ত-কানাইঘাট সড়কে অবস্থিত বড় চাতল গ্রামে প্রতিবন্ধক স্থাপন করেন। বড় চাতলে মুক্তিবাহিনীর দায়িত্ব ছিল কানাইঘাট থেকে শত্রুর প্রত্যাহার অথবা দরবস্ত থেকে কানাইঘাটে রি ইনফোর্সমেন্ট বন্ধ করা। শত্রু প্রতিবন্ধক অবস্থানের কথা জানতে পেরে আর্টিলারি ফায়ার আরম্ভ করে। মারত্মক আর্টিলারির মুখেও মুক্তিবাহিনী ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ঐ স্থানে অবস্থান করেন এবং পাকিস্তানীদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখেন। ১ ডিসেম্বর জেড ফোর্স কমান্ডার মেজর জিয়া ৪ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর সিআর দত্তকে কানাইঘাট আক্রমণের অনুরোধ করে যাতে ১ ইস্ট বেঙ্গলের সিলেটে অগ্রাভিযানে সুবিধা হয়। পরিস্থিতি বিবেচনা করে মেজর সিআর দত্ত মূল পরিকল্পনা কিছুটা রদবদল করেন এবং ১ ডিসেম্বর বিকেল পাঁচটায় ক্যাপ্টেন রবকে ২ ডিসেম্বর কানাইঘাট দখলের আদেশ প্রদান করেন। আদেশ পাওয়ার পর ক্যাপ্টেন রব সৈনিকদের ক্রমাগত অভিযান পরিচালনা, ক্লান্তি এবং গোলাবারুদ সরবরাহের বিবেচনা করে আক্রমণের তারিখ পেছানোর জন্য অনুরোধ করেন। কিন্ত সেক্টর কমান্ডার সিলেটের এলাকার সার্বিক যুদ্ধ পরিস্থিতি বিবেচনা করে ক্যাপ্টেন রবকে ২ ডিসেম্বর মধ্যেই কানাইঘাট দখলের নির্দেশ দেন। প্রচুর সমস্যা থাকা সত্ত্বেও ক্যাপ্টেন রবের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারা ১ ডিসেম্বর রাত আটটার দিকে কানাইঘাটের দিকে অগ্রসর হয়। প্রায় ১২ কি.মি অতিক্রম করে তারা প্রায় রাত দুইটার সময় সমাগম এলাকায় উপস্থিত হন। ক্যাপ্টেন রব রাত সাড়ে তিনটায় সমাগম এলাকা থেকে লক্ষ্যবস্তর দিকে এগিয়ে যান। পথের মধ্যে শত্রুর স্ট্যান্ডিং পেট্রোলের বাধার ফলে শত্রুর অবস্থানের ৫০০ গজের কাছাকাছি আসতেই প্রায় দেড় ঘন্টা সময় লাগে। তিনি যখন ফর্মিং আপ প্লেসে পৌঁছান তখন প্রায় ভোর। এমতাবস্থায় ক্যাপ্টেন রব ঐ সময় আক্রমণ না করে সেক্টর কমান্ডার নির্দেশ মতো পরের দিন আক্রমণের সিদ্ধান্ত করেন। মুক্তিযোদ্ধারা ফর্মিং আপ প্লেজ ত্যাগ করে নিরাপদ স্থানে চলে যান এবং বিশ্রাম নেন। ক্রমাগত অভিযানে নিয়োজিত থাকায় যোদ্ধারা অনেকেই আক্রমণের জন্য প্রায় অযোগ্য হয়ে পড়ে। ক্যাপ্টেন রব অতিরিক্ত সৈন্য এবং অ্যামুনেশনের জন্য অনুরোধ করেন। মেজর দত্ত অ্যামুনেশনের ব্যবস্থা করলেও জনবল বাড়ানো সম্ভব হয়নি। ২ ডিসেম্বর রাত আটটার সময় ক্যাপ্টেন রব পুনরায় লক্ষ্যবস্তুর দিকে দুই কোম্পানিসহ যাত্রা শুরু করে। একই সময়ে- লেফটেন্যন্ট গিয়াস এবং ২ লেফটেন্যান্ট জহির তাদের কোম্পানিসহ যথাক্রমে দরবস্ত-কানাইঘাট এবং চরখাই-কানাইঘাট সড়কে প্রতিবন্ধক স্থাপনের জন্য রওনা হন। ৩ ডিসেম্বর রাত দেড়টার সময় পাকসেনারা লেফটেন্যান্ট গিয়াস-এর কোম্পানির অবস্থান টের পায় (দরবস্ত-কানাইঘাট সড়ক) এবং তার ওপর আক্রমণ চালায়। লেফটেন্যান্ট গিয়াসের প্রতিবন্ধক অবস্থান গ্রহণ করতে অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। প্রায় একই সময় লেফটেন্যন্ট জহিরের অবস্থানও (চরখাই-কানাইঘাট) পাকিস্তানীরা টের পেয়ে যায় এবং আক্রমণ চালায়। রাত আটটার সময় লেফটেন্যান্ট গিয়াস তার প্রতিবন্ধক অবস্থান দখল করতে সক্ষম হন। কিন্ত প্রচণ্ড মেশিনগান ও মর্টারের আক্রমণের ফলে লেফটেন্যান্ট জহির নির্ধারিত প্রতিবন্ধক অবস্থান করতে তখনো পারেননি। তার কোম্পানির অনেকে হতাহত হন এবং প্রচুর গোলাবারুদের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এদিকে ৩ ডিসেম্বর রাত চারটায় ক্যাপ্টেন রব তার দুই কোম্পানিসহ শত্রুর অগোচরে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। কিন্ত শত্রু তাদের অবস্থান বুঝে ফেলে। ফলে শত্রুবাহিনী মুক্তিবাহিনীর ওপর ব্যাপক আর্টিলারি শেলিং শুরু করে। তবে শেষ পর্যন্ত আর্টিলারি শেলিং মুক্তিবাহিনী আক্রমণকে রোধ করতে পারেনি। মুক্তিবাহিনী ৩ ইঞ্চি মর্টার সমর্থনে শত্রুর কাছাকাছি চলে আসেন। অগ্রাভিযানকালে মুক্তবাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি হয় এবং আক্রমণ অব্যাহত রাখার জন্য অতিরিক্ত লোকবল জরুরি প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় গিয়াস এবং ২ লেফটেন্যান্ট জহিরকে তাদের প্রতিবন্ধক অবস্থানে অল্প কিছু মুক্তিসেনা রেখে আক্রমণে অংশ নিতে নির্দেশ দেয়া হয়। আদেশ পাওয়ার সাথে সাথে কোম্পানি কমান্ডারগণ কানাইঘাটের দিকে রওনা হন। ভোরের প্রথম আলোর আগেই তারা কানাইঘাট পৌঁছায় এবং দুইদি দিয়ে কানাইঘাটের শত্রুর অবস্থান ঘিরে ফেলেন। অবশেষে ৪ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে সাতটায় মুক্তিবাহিনী শত্রুর ওপর তিনদিক থেকে একই সাথে ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রচণ্ড হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু হয় এবং মুক্তিবাহিনী প্রচণ্ড সাহস ও তেজের সাথে লক্ষ্যবস্তুর আক্রমণ করতে থাকে। মুক্তিবাহিনী শত্রুর প্রতিটি বাঙ্কার চার্জ করে। উপায় না দেখে শত্রুবাহিনীর কিছু সৈন্য সুরমা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং কিছু সৈন্য পিছনের দিকে পালিয়ে যায়। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর বেয়নেট চার্জ এবং গ্রেনেড আক্রমণে পাকিস্তানী সৈন্য মারা যায়। সকাল সাড়ে দশটা পর্যন্ত হাতাহাতি যুদ্ধ চলতে থাকে। তারপর শত্রুবাহিনীকে সম্পূর্ণ পরাস্ত করে কানাইঘাট দখল করে। এই যুদ্ধে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং ২০ জন আহত হন। অন্যদিকে শত্রুরা আনুমানিক ৫০ জন নিহত হয় এবং ২৫ জন আত্মসমর্পণ করে। এভাবে কানাইঘাট দখল ১ ইস্ট বেঙ্গলের অগ্রযাত্রাকে সহায়তা করে। কানাইঘাটের পাকিস্তানী কমান্ডার মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত হয়। তার মৃতদেহ কানাইঘাট বাজারের কাছে নদীর তীরে পাওয়া যায়।
[৫৫] রিয়াজ আহমেদ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!