কাপালিডাঙ্গা রাজাকার ক্যাম্প দখল, খুলনা
ডুমুরিয়া থানার সাহস ইউনিয়নের কাপালিডিঙ্গা গ্রামে একটি রাজাকার ক্যাম্প স্থাপিত হয়। জনৈক মোকছেদ আলী ছিল এ রাজাকার ক্যাম্পটি কমান্ডার। ইতোমধ্যে পিস কমিটির অত্যাচারে এ গ্রাম হিন্দুশূন্য হয়ে পড়ে। হিন্দু ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠী ভারতে চলে যাওয়ায় তাদের ফেলে যাওয়া সম্পদের মালিক হয়ে বসে পিস কমিটির লোকজন। তাদেরই সহায়তা এখানে রাজাকারদের এই ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজাকার ও পিস কমিটির লোকজন এ গ্রামের হিন্দু বাড়ি-ঘর দখল করে ক্ষান্ত হয়নি, তারা এ এলাকার মুসলমানদের উপরও অত্যাচার শুরু করে। সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ডুমুরিয়াতে মোঃ ওয়াদুদ আলী, ডা. আব্দুল লতিফ প্রমুখের নেতৃত্বে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা দল এলেও নকশাল ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে তারা সাফল্য লাভ করতে পারেনি। ওয়াদাদের নেতৃত্বাধীন বাহিনী এলাকায় কিছু দিন অবস্থান করে রাজাকারদের বিরুদ্ধে কিছুটা সাফল্য লাভ করলেও নকশালদের চাতুরতায় তারা সর্বস্ব হারিয়ে এলাকা ত্যাগ করে আত্মরক্ষা করতে বাধ্য হয়। ডা. লতিফের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রুপটি উভয় বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নিজেদেরকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হলেও তাদেরকেও দমন করতে পারেনি। সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ ডুমুরিয়া থানার শোভনা ইউনিয়নের বারুইকাঠি গ্রামে নূরুল ইসলাম মানিকের নেতৃত্বে একটি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরুতেই মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নূরুল ইসলাম মানিক সাহস ইউনিয়নের কাপালিডাঙ্গার রাজাকার ক্যাম্পের সন্ধান পান এবং তাদের অত্যাচারের কথা জানতে পারেন। তাই তিনি অনতিবিলম্বে এ রাজাকার ক্যাম্পটি ধ্বংস করে এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন। তিনি আক্রমণ তৈরি করার জন্য ১২-১৩ সহযোদ্ধা নিয়ে কাপালিডাঙ্গা গ্রামে রেকি করতে যান। তাঁর সহযোদ্ধাদের মধ্যে মাহবুবুর রহমান, বিজন বিহারি মিস্ত্রি, রবীন্দ্রনাথ বৈরাগী, অরবিন্দ মণ্ডল নির্মলকান্তি বালা, সুধাংশু শেখর ফৌজদার, নির্মলকান্তি মণ্ডল হারাচাঁদ মণ্ডল প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অক্টোবর মাসের শুরুতে এক গভীর রাতে রেকি করার উদ্দেশ্যে নূরুল ইসলাম মানি উক্ত গ্রামে অতি সতর্কতার সাথে প্রবেশ করেন। তিনি তার সহযোদ্ধাদের নিয়ে কর্দমাক্ত ধান ক্ষেতের ভিতর দিয়ে চুপি চুপি ক্যাম্পের কাছাকাছি পৌঁছে সকলকে সতর্কমূলক পজিশন নিয়ে অবস্থান করার নির্দেশ দেন এবং নিজ মাত্র দু’জনকে সাথে নিয়ে ভবনের খুব কাছে গিয়ে রাজাকারদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। এ সময় তিনি লক্ষ করেন যে, রাজাকাররা অবস্থান পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। এ সময় তিনি লক্ষ করেন যে, রাজাকাররা কোনো সতর্কমূলক ব্যবস্থা অবলম্বন না করে তাস, দাবা খেলায় মেতে হৈচৈ করছে। পাহারার দায়িত্বে যারা ছিল তারাও পাশে রাইফেল নিয়ে ঘুমিয়ে ছিল। এ অবস্থা দেখে কমান্ডার অন্যান্যদের নিকট ফিরে এসে এখনই আক্রমণ করার প্রস্তাব দেন। সবাই তাঁর প্রস্তাব ও পরিকল্পনায় রাজী হলে মানিক প্রথমে ক্যাম্পটি ঘিরে ফেলেন এবং ৪/৫ জন সহযোদ্ধাকে নিয়ে আকস্মিকভাবে অতি দ্রুত অন্যান্যদের প্রতি অস্ত্র তাক করে হাত উঁচু করে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। তিনি তাদের অবহিত করে যেন, ক্যাম্পের চারদিক মুক্তিযোদ্ধারা ঘিরে রেখেছে আত্মসমর্পণ না করলে বোমা মেরে সম্পূর্ণ ক্যাম্পটি ধ্বংস করে দেওয়া হবে, কেউ তাতে রক্ষা পাবে না আকস্মিক এ আক্রমণের রাজাকাররা হতবিহবল হয়ে সকলে হাত তুলে আত্মসমর্পণ করে এবং তারা বিনয়ের সাথে প্রাণভিক্ষা চায়। এ সময় কমান্ডার মানিকের নির্দেশে চারপাশে অবস্থানরত ২৮ জন রাজাকারকে একে একে বেঁধে এবং তাদের ২৮টি রাইফেল হস্তগত করে বারুইকাঠি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে নিয়ে আসে। পরে তাদেরকে হত্যা করা হয়। রক্তপাতহীন এই অপারেশনে মাত্র ১২ জন মুক্তিবাহিনীর সদস্য ২৮ জন রাজাকারকে বন্দি করে নিয়ে আসে।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত