You dont have javascript enabled! Please enable it!

কাটাখালী সেতু ও তিনআনী ফেরিঘাটের যুদ্ধ, ময়মনসিংহ

বালিয়াবাড়ি থানা সদরের পশ্চিমে খালের উপর তিনআনি ফেরি এবং পূর্ব্দিকে বাঘাই নদীর উপর কাটাখালী সেতুর অবস্থান। তিনআনি ফেরি সেই সময়ে ইঞ্জিন চালিত ছিল না। মোটা শক্ত রশির সাহায্যে পল্টনের উপর হাত দিয়ে হাতল ঘুরিয়ে ফেরি পারাপার করা হতো। তিনিআনি ফেরি থেকে নালিতাবাড়ির দূরত্ব ৪ কিলোমিটার। কাটাখালি সেতু ও তিনআনি ফেরিঘাটে পাকিস্তানী নিয়মিত বাহিনীর কোনো স্থানীয় অবস্থান ছিল না। এটা ছিল ৩৩ জন পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অপারেশনাল এলাকা। ৩৩ পাঞ্জাবের হেডকোয়ার্টার ছিল ময়মনসিংহে। হালুয়াঘাটে ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক কোম্পানী সৈন্যর অবস্থান ছিল একই স্থাএ রেঞ্জার্স এবং রাজাকার বাহিনীর একটি করে কোম্পানী নিয়োজিত ছিল। পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সৈনিকরা রাস্তার চলাচল নিরাপদ রাখার লক্ষ্যে ফেরিঘাট এবং সেতু এলাকায় নিয়মিত টহল দিত এবং প্রতিদিন সন্ধ্যার আগেই সৈনিকরা হালুয়াঘাট ক্যাম্পে ফিরে যেত। এছাড়াও কাটাখালি সেতু এবং তিনআনি ফেরি পাহারা দেয়ার জন্য এক প্লাটুন রাজাকারের সার্বক্ষণিক অবস্থান ছিল। ফেরিঘাট এবং সেতু এলাকার নিরাপত্তা রক্ষা করাই ছিল তাদের প্রধান দায়িত্ব।
জুন মাসে ডালু সাব সেক্টর কমান্ডারের উপর পাকবাহিনীর চলাচলের রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির দায়িত্ব অর্পিত হয়। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ভিপি নাজমুল আহসান গ্রুপ কমান্ডার এই দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রাথমিক পর্যায়ে কাটাখালি সেতু এবং তিনআনি ফেরিঘাট ধ্বংস করার জন্য পরিকল্পনা গৃহীত হয়। ৪ জুলাই কোম্পানী কমান্ডার নাজমুল আহসান এর নেতৃত্বে ৫৪ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল ডালু অপারেশন ক্যাম্প থেকে নালিতাবাড়ি থানাধীন কাটখালি সেতু এর তিনআনি ফেরি ঘাট ধ্বংস করার জন্য বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এই দলের সঙ্গে ফেরিঘাটের সেতু ধ্বংসের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্রসস্ত্র ৩০০ পাউন্ড প্লাষ্টিক এক্সপ্লোসিভ যুক্ত করা হয়।
বৃষ্টির মধ্যে গাইড এর সহায়তায় রাতের অন্ধকারে মুক্তিযোদ্ধা দলটি বড়ামারীর পশ্চিম পাশ দিয়ে রাত ১টায় নালিতাবাড়ির উত্তরে শিমুলতলী গ্রামে হাইড আউট স্থাপন করে। কমান্ডার নাজমুল আহসানের নেতৃত্বে এই দলের মূল লক্ষ্যবস্তু ছিল দু’টি একটি কাটাখালি সেতু অপরটি তিনআনি ফেরি। নাজমুল আহসানের নির্দেশে হাইড আউট থেকে দলকে দু’ভাগে বিভক্ত করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা আবদুল গণির নেতৃত্বে ২৪ জনের একটি দলের উপর তিনআনি ফেরিঘাটের ফেরি ধ্বংস করার দায়িত্ব অর্পিত হয়। এই দলের সঙ্গে ১৫০ পাউন্ড এক্সপ্লোসিভ সহ বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য প্রয়োজনীয় ডেটোনাই কর্ডেক্স, সেফটি ফিউজ দেয়া হয়। গ্রুপ কমান্ডার নাজমুল আহসান নিজে অপর ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা দলের নেতৃত্বে গ্রহণ করেন। এই দলের সঙ্গেও সেতু ধ্বংস করার জন্য প্রয়োজনীয় এক্সপ্লোসিভ দেয়া হয়। উভয় দল একই সময়ে কাটখাই সেতু এর তিনআনি ফেরিঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। রাত ৩টা নাগাদ উভয় দল নির্দিষ্ট টার্গেটের নিকটবর্তী স্থানে অবস্থান করে। সেতু এলাকায় শত্রুর অবস্থান পর্যবেক্ষণের জন্য ২ জন মুক্তিযোদ্ধাকে সেতুর কাছাকাছি পাঠানো হয়। এই সময় প্রবল বর্ষণের কারণে রাজাকাররা নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব ত্যাগ করে বাঙ্কারের ভিতরে অবস্থান করছিল পর্যবেক্ষণ দল ফিরে এসে এই অবস্থা জানানোর সঙ্গে সঙ্গে তড়িৎ গতিতে মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের তাবু আক্রমণ করে তাদেরকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। নিরাপত্তার কারণে রাজাকারদের বেঁধে রেখে তাদের অস্ত্রসমূহ সংগ্রহ করা হয়। কমান্ডার নাজমুল আহসান এর নেতৃত্বে একরকম বিনা প্রতিরোধে সেতুটি সম্পূর্ণভাবে উড়িয়ে দেয়ার পর নিজের দল নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে নিজের অপর দলের অপেক্ষায় থাকেন। তিনআনি ফেরিঘাটে রাজাকারদের অবস্থান ছিল ঘাট থেকে একটু দূরে। বৃষ্টির কারণে এখানেও রাজাকাররা ঘরের মধ্যে অবস্থান করছিল। আবদুল গণির নেতৃত্বে
মুক্তিযোদ্ধা দলটি সহজেই ফেরিতে এক্সপ্লোসিভ বসিয়ে ফেরিটি ধ্বংস করেন। রাজাকারদের আক্রমণের পূর্বে দলটি নির্দিষ্ট অবস্থানে ফিরে আসে। শেষ নাগাদ উভয় দল নিরাপদে নির্দিষ্ট স্থান পুনরায় মিলিত হয়।
গ্রুপ কমান্ডার নাজমুল আহসান দলের নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে অবস্থান পরিবর্তন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। পরপর দুটি অপারেশনের কারণে দিনের বেলার অবস্থান পরিবর্তনের বিষয়টি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সাবধানতায় কমান্ডার নাজমুল আহসান নালিতাবাড়ি থানার অধীন রাঙামাটি গ্রামে জনৈক নাঈমুদ্দিনের বাড়িতে দলসহ আশ্রয় গ্রহণ করেন। ৬ জুলাই ১০ টায় পাকবাহিনী অতর্কিতে নঈমুদ্দিনের বাড়িতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধা দলকে ঘিরে ফেলে। সেই সময় ক্লান্ত মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় সকলেই ঘুমিয়ে ছিলেন। শুধুমাত্র পাহারার দায়িত্বে নিয়োজিত দু’জন মুক্তিযোদ্ধা সকলকে ঘুম থেকে জাগিয়ে, তারা পাকবাহিনী দ্বারা ঘেরাও হয়ে আছে বিষয়টি জানিয়ে দেয়। গ্রুপ কমান্ডার নাজমুল আহসান এগিয়ে দেখেন উত্তর ও দক্ষিণ দিক থেকে পাকবাহিনী এগিয়ে আসছে। প্রস্তুতি নেয়ার পূর্বেই পাকবাহিনী গুলিবর্ষণ শুরু করে। অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধারাও তাদের রাইফেল নিয়ে প্রতিরোধ করতে প্রচেষ্টা চালায়। কমান্ডার নাজমুল পাকবাহিনীর সঠিক অবস্থান নির্ণয় করে সকলকে যে করেই হোক অবস্থান ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানান। ইতোমধ্যে জব্বার, আবু সাঈদ সহ আরও দু’জন আহত এবং একজন শাহাদৎ বরণ করেন। নাজমুল এই অবস্থায় দলকে বিলের মধ্যে দিয়ে সাতরিয়ে পশ্চাদপসরণের নির্দেস দেন। দাঁড়িয়ে আহসানের উদ্ধারের চেষ্টায় মোফাজ্জল হোসেন, আলী হোসেন শত্রুর গুলিতে শাহাদাত বরণ করেন। অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাগণ আহতদের নিয়ে বিলের পূর্ব পাড়ে আশ্রয় নেয়। অবশেষে মুক্তিযোদ্ধারা ডালু অপারেশন ক্যাম্পে ফেরত আসেন।
[১৬] এ.এস.এম.শামছুল আরেফিন

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!