You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ২৫শে নভেম্বর, রবিবার, ১৯৭৩, ৯ই অগ্রহায়ণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

চিনি উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও তৎপ্রসঙ্গ

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিল্পমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম গত পরশুদিন জয়পুরহাটের বৃহত্তম চিনি কলের উৎপাদন শুরু উপলক্ষে এক অনাড়ম্বর সভায় ভাষণ দিতে ‍গিয়ে বলেছেন—আগামী বছরের মধ্যেই চিনি কলগুলোর উৎপাদন ‍বৃদ্ধি পেয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করবে। এ বছরে এক লাখ টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা স্থিরীকৃত হয়েছে বলেও তিনি ঘোষণা করেছেন। আমাদের বার্ষিক চিনির চাহিদা হলো এক লক্ষ বিশ হাজার টন। বর্তমানে দেশে পনেরোটি চিনিকল রয়েছে। আগামী বছর থেকে ফরিদপুরের মধুখালীতে একটি নতুন চিনি কল স্থাপনের কাজ শুরু হবে। সবগুলো চিনি কল যদি যথার্থ উৎপাদন দিতে পারে তাহলে দেশের চাহিদা পূরণ হয়েও বিদেশে চিনি রপ্তানী করা সম্ভব বলে শিল্পমন্ত্রী উল্লেখ উল্লেখ করেছেন। তিনি আশা করেছেন ষোলোটি চিনি কলে এক লক্ষ আশি হাজার টন চিনি উৎপাদিত হতে পারবে। শিল্পমন্ত্রী চিনি উৎপাদনে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেয়ার আশ্বাস প্রদান করেছেন। চিনি উৎপাদনে এই উল্লেখিত সাফল্যের আশা নিঃসন্দেহে গৌরবজনক। শিল্পখাতের একটি প্রয়োজনীয় দিক যদি সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয় তাহলে যেমন খুশী হবে দেশবাসী তেমনি উপকৃত হবে গোটা জাতি। আমরাও এই আশাব্যঞ্জক তথ্যে কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই।
ইতিপূর্বে অন্য একটি সংবাদে প্রকাশিত হয়েছে কর্তাব্যক্তিদের ব্যর্থতা ও অবিমৃষ্যকারিতার জন্যে এবার চিনির উৎপাদন নাকি প্রায় পঞ্চাশ হাজার টন হ্রাস পেয়েছে। সংবাদে বলা হয়েছে—আখচাষীদেরকে ব্যর্থতা, গুড় তৈরীর ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপ, এবং কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণে জেলা কর্তৃপক্ষের গাফিলতি, অধিকতর আখ উৎপাদনের জন্যে সুগার কর্পোরেশন, কৃষি দপ্তর, সমবায় বিভাগ ও স্ব স্ব সংশ্লিষ্ট জেলা কর্তৃপক্ষের যুক্ত উদ্যোগের অভাবেই নাকি উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। যার দরুণ কর্তৃপক্ষকে বিশ কোটি আমদানী করতে হয়েছে। সংবাদে আরও বলা হয়েছে, গত বছর আখচাষীদের জন্যে ঋণদানের যে লক্ষ্য স্থিরীকৃত হয়েছিলো তা ঋণদানের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। সমবায়, কৃষি ব্যাংক, সুগার কর্পোরেশনের এই ব্যর্থতা আখ উৎপাদনে নিদারুণ ব্যাঘাত সৃষ্টি করেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবের দরুণ যে সংকট সৃষ্টি হয়েছিলো কর্তৃপক্ষ সেটাও মোকাবেলা করতে পারেন নি। গরীব কৃষকরা আখ উৎপাদনে গতবার যথেষ্ট পরিমাণ কর্তৃপক্ষীয় সহযোগিতা পেলে আরো উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হতো। এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিদারুণ ব্যর্থতা দেখিয়েছেন বলে সংবাদটি দাবী করেছে। সরকারের আগ্রহ ও প্রচেষ্টার জন্যে আমরা অবশ্য ধন্যবাদ জানাবো এবং আশাবাদও প্রকাশ করবো। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক ঘাপলাকে আমরা অস্বীকার করতে পারিনা। যদি উল্লেখিত সংবাদটির সত্যতা থাকে তাহলে শিল্পমন্ত্রী ঘোষিত চিনি উৎপাদনের স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথাটিও পুরোপুরি আশ্বাসের বাণী বহন করতে সক্ষম হয়না। জনগণ মন্ত্রী সাহেবের ভাষণের প্রতি সম্পূর্ণ নির্ভরও করতে পারেনা। এ কারণে তাই আমাদের বক্তব্য শুধু ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ হবো’ বলে আশাবাদ প্রকাশ করেই আমরা যেন ক্ষান্ত না হই। চিনি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত সকল বিভাগকেও সৎ ও কর্মক্ষম করে তুলতে হবে। নইলে কর্তাব্যক্তিদের ঘাপলাবাজীতে সরকারের সদিচ্ছা নৈরাশ্যের মাঝে হাবুডুবু খাবে।

হুমকি দিয়ে টলানো যাবেনা

সৌদি আরবের তেলমন্ত্রী জনাব জাকি ইয়ামানী কোপেনহেগেনে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, আরবদের তেল বয়কটের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ কিম্বা জাপান পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করলে সৌদি আরব তেল উৎপাদন শতকরা ৮০ ভাগ কমিয়ে দেবে। জনাব ইয়ামানী যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপারে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে সৌদি আরব তার তেলখনিগুলো বিস্ফোরকের মাধ্যমে উড়িয়ে দেবে।
ইতিপূর্বে সৌদি আরবের বাদশাহ ফয়সল বলেছেন, আরবদের তিনটি দাবী পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তিনি কয়েকটি দেশে তেল পাঠানোর উপর নিষেধাজ্ঞার অবসান ঘটাবেন না। বাদশাহ বলেন, অধিকৃত সমস্ত আরব ভূ-খন্ড থেকে ইসরাইলী সৈন্য অবশ্যই সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করতে হবে, প্যালেস্টাইনীদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার মেনে নিতে হবে এবং স্বীকার করতে হবে যে, জেরুজালেম একটি ঐতিহ্যমন্ডিত আরব শহর।
এদিকে মার্কিন প্রতিনিধি সভার পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিশনের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, আরব দেশগুলোতে মার্কিন খাদ্যশস্য সরবরাহের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে তা হবে যুক্তরাষ্ট্রে আরবদের তেল রফতানী বন্ধ করে দেবাপর প্রতি একটি নিষ্ফল জবাব। শুধুমাত্র কমিশনের রিপোর্টই নয়, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ হেনরী কিসিঞ্জারও এই বলে হুমকি দিয়েছেন আরবরা তেল বন্ধ করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। পাল্টা ব্যবস্থাটা কি তা অবশ্য ডঃ কিসিঞ্জার ব্যাখ্যা করেন নি।
ডঃ কিসিঞ্জার যাই বলুন না কেন, নিয়মিতভাবে তেল সরবরাহের অভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আজ ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। তেল অস্ত্রের আঘাতে সকলেই কুপোকাৎ। বিশেষত জাপান তো বুদ্ধিমান বিবেচকের মতো আগেভাগেই নীতিগতভাবে স্বীকার করে নিয়েছে যে, ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পূর্বেকার সীমারেখায় ইসরাইলের উচিত সৈন্য সরিয়ে নেওয়া। যদি ইসরাইল অধিকৃত আরব এলাকা ছেড়ে না দেয় তাহলে জাপান তেলআবিবের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, ডঃ কিসিঞ্জার চলতি মাসে জাপান সফরকালে জাপান সরকারকে অনুরোধ করেন যে, মার্কিনী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যেন কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়া হয়। কিন্তু গরজের নাম বাবাজী। জাপানের শতকরা ৯০ ভাগ তেলই বিদেশ থেকে আমদানী করতে হয়। এমতাবস্থায় জাপানের পক্ষে সম্ভব নয় মার্কিনী অনুরোধ রক্ষা করা।
ডাঃ কিসিঞ্জার যতই হম্বিতম্বি করুন না কেন আরব দেশগুলো যে সিদ্ধান্তে অবিচল থাকবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধ ও তেল সংকেটর মারপ্যাঁচে হারাধনের দশটি ছেলের মতো একে একে সকলেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশ থেকে সরে যাবে। শেষ পর্যন্ত থাকবে একা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তখন হারাধনের একটি ছেলে কাঁদে ভেউ ভেউর মতো একটা করুণ সমস্যা ও সংকটের সম্মুখীন হতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাধ্য। কারণ স্বরূপ মার্কিন প্রতিনিধি সভার পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিশনের রিপোর্টের উল্লেখই করা যায়। রিপোর্টে বলা হয়েছে, আরবরা তাদের অপেক্ষাকৃত অল্প পরিমাণ খাদ্য আমদানীর প্রয়োজন বিশ্ববাজারের অন্যান্য উৎস থেকে আমদানী করে মেটাতে পারে। অথচ অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র তার তুলনামূলকভাবে বিপুল পরিমাণ পেট্রোলের প্রয়োজন অন্যান্য উৎস থেকে আমদানী করে মেটাতে পারে না।

বাংলার মাঠই বাংলার অর্থনীতি

সাধনা ও শ্রম ব্যর্থ হয় না কখনো। ওদের বেলায়ও ব্যর্থ হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের একদল ছাত্র তাদের বিভাগীয় জনৈক শিক্ষকের নেতৃত্বে গ্রাম বাংলার মাঠে ছুটে গিয়েছিলো ফসল ফলানোর বাসনা নিয়ে। পুঁথিগত এবং শিক্ষাঙ্গনের শিক্ষার সাথে সাথে মাঠে হাতে কলমে কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন এবং সবুজ বিপ্লব সাধনের বাস্তব কর্মসূচীর প্রতীক হিসেবে এটা ছিলো তাদের একটি ক্ষুদ্র পরীক্ষামূলক প্রকল্প।
ঢাকার অদূরে তারা খানিকটা পতিত জমি ইজারা নিয়েছিলো। সে জমিতে তারা নিজেরাই চাষ করেছে, মই দিয়েছে, পানি সেচ করেছে, বাঁধ দিয়েছে, চারা লাগিয়েছে, সার ও ঔষধ ছিটিয়েছে এবং নিড়ানী, কাটামলা ইত্যাদিও তারা নিজেরাই করেছে। সঙ্গে সহযোগী কর্মী বন্ধু হিসেবে রেখেছে গ্রামের চাষী ভাইদেরকে। এর ফলে পতিত জমিতে একর প্রতি ফলন হয়েছে ৫৬ মণ ধান।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, একটি ছাত্র প্রতিষ্ঠান গত গ্রীষ্মাবকাশের ছুটিতে ছুটে গিয়েছিলো বিভিন্ন কল-কারখানায়। সেখানে তারা শ্রমিক ভাইদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছে, উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে সমাজতন্ত্র কায়েমের বাস্তব কর্মসূচী সম্পর্কে এবং শ্রমিকদের মধ্যে সর্বপ্রকার প্রভেদ ও আঞ্চলিকতা ইত্যাদি ভুলে গিয়ে সমবেত প্রচেষ্টায় কাজের সুফল সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান প্রদান করেছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শিক্ষিত ছেলেদের সঙ্গে একত্রে কাজ করতে পেরে শ্রমিক ভাইয়েরা মুগ্ধ হয়েছে, নতুন প্রেরণা পেয়েছে। তেমনি আনন্দ এবং অনুপ্রেরণা পেয়েছে জিরাবো গ্রামের চাষী ভাইয়েরাও।
বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে। সুতরাং সবুজ বিপ্লবের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে সর্বপ্রথম। এ কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমরা মনে করি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগের মুষ্টিমেয় ছাত্ররা যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তা কেবল একটি বিভাগে কিংবা মুষ্টিমেয় ছাত্রের শুভ প্রচেষ্টাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না অথবা ক্ষুদ্র পরীক্ষামূলক প্রকল্প হিসেবেই বিবেচিত হবে না, বরং তা দেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই ছড়িয়ে পড়বে। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ছাত্র-শিক্ষকের এই যৌথ প্রচেষ্টা পথ প্রদর্শক হিসেবেও কাজ করবে। আমরা আরো মনে করি, কেবল ছুটিতে নয়, বরং শিক্ষা বিষয়ের বাধ্যতামূলক একটি বিষয় হিসেবে অনুরূপ প্রকল্প প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই প্রচলনের ব্যবস্থা করা উচিত। সমাজতান্ত্রিক শিক্ষা ব্যবস্থায় অনুরূপ কর্মসূচী শিক্ষারই একটি অঙ্গ বলে আমরা মনে করি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!