You dont have javascript enabled! Please enable it!

কলাবাড়িয়া যুদ্ধ, ফরিদপুর

সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সভায় যোগ দেবার জন্য এরিয়া কমান্ডার আলমগীর হোসাইন তার ৪/৫ জন সহযোদ্ধাসহ নৌকাযোগে [মাদারীপুর] শিবচর যাচ্ছিলেন। ফরিদপুর-বরিশাল মহাসড়কের কলাবাড়ি ব্রিজের নিচ দিয়েই তাদেরকে শিবচরেরে পথে যেতে হবে। সকাল ন’দশটার দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকাটি ওই ব্রিজের কাছাকাছি আসতেই পাক দস্যুদের একটি গাড়িও ঠিক এই সময় ব্রিজের ওপর এসে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা তাদের নজরে আসতেই পাকসেনারা গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারাও তাড়াতাড়ি নৌকা থেকে নেমে খালের পাড়ে পজিশন নিয়ে পাল্টা গুলি ছুঁড়তে থাকে। ক্যাম্পে বসে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পেয়ে বুঝতে দেরি হয় না ঘটনা কি ঘটেছে। মুহূর্তে খানেকের ভেতরে তৈরি হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ৪০/৫০ জনের একটি গ্রুপ গোলাগুলির শব্দ লক্ষ্য করে মর্টার ও এল.এম. জি সহ ছুটে যায়। প্রায় ২ মাইল অগ্রসর হয়ে তারা পাকসেনাদের মোকাবেলা করতে শুরু করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের নিক্ষিপ্ত মর্টারের গোলায় হানাদার বাহিনীর বেশ ক’জন সদস্য হতাহত হয় এবং রণে ভঙ্গ দিয়ে তারা ফিরে যেতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে কেউ হতাহত না হলেও জিল্লুর রহমান নামে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। মাদারীপুর মুক্ত হওয়ার পর জিল্লুর হাসপাতালে সুস্থ শরীরে ছাড়া পান।

হানাদার বাহিনীর কমলাপুর ও কলাগাছিয়া ক্যাম্প এলাকা ঘেরাও এবং নৃশংস হত্যাকাণ্ডঃ অক্টোবর মাঝামাঝি সময় সেটা। বর্ষায় পানি তখন নেমে গেছে। জেগে উঠেছে উঁচু এলাকার মাটি। কেবল বিলের মধ্যে এখনো অনেক পানি। আমন ধানের বিস্তৃত শ্যামলিমা। সারাদেশের যুদ্ধে তখন মুক্তিবাহিনী একের পর এক জয় ছিনিয়ে নিয়ে চলেছে।মাদারীপুরেও মুক্তিযোদ্ধারা জয় ছিনিয়ে আনছেন প্রতিটি যুদ্ধে। ঠিক এই সময় মটকচর হাই স্কুলে রাজাকারদের একটি বড় ধরনের ক্যাম্পে আক্রমণ করে বসে মুক্তিযোদ্ধারা। আক্রমণ সফল হয়। তারা এখান থেকে অস্ত্রশস্ত্র ৭ থেকে ৮ জন জীবিত রাজাকারদের ধরে নিয়ে ভোররাতে ক্যাম্পে ফিরে আসেন। সারারাতের ক্লান্তিতে কেউ কেউ মাটিতেই শুয়ে পড়েন। কেউ কেউ রাজাকার ধরার আনন্দে হৈ-হুল্লোড়ে মত্ত। পুবের আকাশ ফর্সা হবার পথে। ঠিক এমনি অবস্থায় হঠাৎ মুক্তিযোদ্ধাদের কানে গোলাগুলি শব্দ ভেসে আসে। উৎকর্ণ-সজাগ হতেই মুক্তিযোদ্ধারা খবর পেলেন, মিলিটারি এসেছে। ৪টি ক্যাম্পের সমস্ত মুক্তিযোদ্ধা দ্রুততার সঙ্গে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন পাকবাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে। ক্যাম্প এলাকার বাইরে থেকেই পাকদস্যুরা যেখানে যাকে যে অবস্থায় পেল নিরীহ গ্রামবাসীকে গুলি করে মারতে লাগলো, আগুন ধরিয়ে দিতে থাকলো প্রতিটি বাড়ির প্রতিটি ঘরে। ফরিদপুর, বরিশিলা এবং অন্যান্য জায়গা থেকে তাদের সদস্যদের নিয়ে পাকবাহিনী সুপরিকল্পিতভাবে প্রকাণ্ড শক্তিতে বলীয়ান হতে একযোগে ক্যাম্প এলাকা আক্রমণ করে বসে। মুক্তিযোদ্ধারা তাই প্রাণপণে লড়েও তাদের পর্যুদস্ত করতে পারেনি। ফলে ৪/৫ ঘন্টা ধরে মরিয়া লড়াই শেষে মুক্তিযোদ্ধারা ধানক্ষেত ধরে পশ্চাদপসরণ করে লখণ্ডা বিলের ভেতরে আশ্রয় নেন। এ যুদ্ধে অলৌকিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ হতাহত না হলেও ক্যাম্প এলাকার দুশোরও বেশি নিরীহ নর-নারী-শিশুকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে পাকদস্যুরা। আর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয় অসংখ্য ঘরবাড়ি। এদিন ১০/১৫টি লাশ নিয়ে ফিরতে হয়েছিল বাহিনীকে।
[৪৪] জোবাইদা নাসরীন

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!