You dont have javascript enabled! Please enable it!

ওডারল্যান্ড, বীর প্রতিক(১৯১৭-২০০১)

পুরো নাম ডব্লিও এ এস ওডারল্যান্ড। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র বিদেশী যোদ্ধা, যাকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাব দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় ওডারল্যান্ড ছিলেন টঙ্গিতে বাটা সু কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার। ঊনসত্তরের প্রবল পাকিস্তানবিরোধী গণ-আন্দোলনের সময়ও তিই সেদিঙ্কার পূর্ব পাকিস্তানে। কাজেই পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাতিত চেহারা দেখেছেন নিজের চোখে।
ওডারল্যান্ড জন্মগ্রহন করেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর হলান্ডের আমস্টারডাম শরে। চারদিকে তখন ভয়ঙ্কর ধ্বংস আর হত্যাযজ্ঞ। এরপর এলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। জন্মভূমিকে রক্ষা করতে ওডারল্যান্ড যোগ দিলেন যুদ্ধে। পদবি হলো তার ‘সার্জেন্ট’। নিজ প্রত্যক্ষ করলে হাজার হাজার দেশবাশীর সকরুণ মৃত্যু নাৎসি জার্মানির বোমার আঘাতে। জার্মান বাহিনীর হাতে এক সময় বন্দি হলে সার্জেন্ট ওডারল্যান্ড। কিন্তু বন্দিশিবির থেকে সুকৌশলে পালাতেও সক্ষম হলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। এরপর জীবিকার অন্বেষণে যোগ দিলেন বাটা সু কোম্পানিতে। দীর্ঘ চাকরিজীবনের পর এই কোম্পানি থেকেই তিনি অবসর নেন।
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে ওডারল্যান্ড পাকিস্তান বাহিনীর হাতে গণহত্যা ও বিভিন্ন নির্যাতনের ছবি সংগ্রহ করে গোপনে সেগুলোই পাঠিয়ে দিতেন পশ্চিমি দেশগুলোতে। তাঁর এই উদ্যোগের ফলেই অবরুদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে পাকিস্তানি সৈন্যদের বর্বরতার ছবি বাইরের বিশ্বে প্রকাশ পেতে থাকে একের পর এক। গড়ে উঠতে থাকে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত। এ ছাড়াও তিনি গোপন সংবাদ সংগ্রহ করে পাঠাতেন সীমান্তের ওপারে। কাজগুলো ছিল নিঃসন্দেহে বিপদজ্জনক। তথাপি ওডারল্যনান্ড তা করছেন। কৌশলগত কারণে তিনি ঢাকায় অবস্থানরত পাকিস্তান সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে সুসম্পর্ক রাখতেন। তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ খবরাখবর পাচার করতেন মুক্তিযুদ্ধের নানা কর্তৃপক্ষের কাছে। মুক্তিযুদ্ধের একাধিক রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃবৃন্দের সাথে তাঁর গভীর সম্পর্ক ছিল। কাজেই তাঁর পাঠানো খবরাখবরের বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল প্রশ্নাতীত। এ ছাড়া টঙ্গীর বাটা সু কোম্পানিতে কর্মরত একাধিক বাঙালী কর্মকর্তা ও কর্মচারী ওডারল্যান্ডের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের অবদান রাখতে।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে ওডারল্যান্ড অস্ত্র হাতে সরাসরি পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। অস্ত্র-গোলাবারুদ ব্যবহার সম্পর্কে তাঁর ছিল আগের অভিজ্ঞতা। সে অভিজ্ঞতা দিয়েই তিনি তাঁর সীমানার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষিত করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের উপযুক্ত করেছেন গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে। বাটা সু কোম্পানির নিরাপত্তা কর্মীদের প্রতিটি অস্ত্র তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। নিজের ব্যক্তিগত পিস্তল্টি পর্যন্ত তুলে দেন একজন মুক্তিযোদ্ধার হাতে।
ওডারল্যান্ডকে নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠে নতুন প্রজন্মে কেউ কেউ। আমি নিজে যুক্ত হয়েছিলাম সে উদ্যোগে। জীব সায়াহ্নে অস্ট্রেলিয়ার পার্থ শহর থেকে ২২ ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৭ তিনি ঢাকার হোস্পদ সাংবাদিক ও প্রকাশক আনোয়ার ফরিদীকে লেখেনঃ
‘Having escaped from the POW camp after short interment. I joined Dutch underground resistance movement. As I spoke fluent German and several Dutch dialects. I befriended the German high Command and was thus able to help the Dutch underground movement as well as the Allies forces with vital information. So when the events of March 1971 (in Bangladesh) started with tanks of the Pakistani forces rolling into the Dhaka. I was reliving my experience of my younger days in Europe. I could fully appreciate and understand the predicament of the Bengali people and this motivated me to spring into action on their behalf….. Deeply touched and moved by the almost unbearable suffering and atrocities, I witnessed of the cruel and oppressive occupying force. I secretly began a guerrilla movement with the brave Bengalese at BATA, Tongi and all around Sector 1 and 2.
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর এই বিদেশী নাগরিককে সম্মানিত করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এমএজি ওসমানী নিজে তাঁর সাথে দেখা করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। কিন্তু পরবর্তীতে ভিনদেশী এই বাংলাদেশপ্রেমীর কোনো খোঁজ রাখার প্রয়োজন বোধ করেনি কেউ। বাংলাদেশের কোনো সম্মানসূচক নাগরিকত্বও প্রদান করা হয়নি তাঁকে। এ অ-বাংলাভাষী মানুষটি নিজের জীবন বিপন্ন করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তিনি ছিলেন কিংবদন্তির মানুষ।
ওডারল্যান্ড পরবর্তী সময়ে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। ২০০১ সালের মে মাসে ৮৩ বছর বয়সে তিনি অস্ট্রেলিয়ার পার্থ শহরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ২৪ মে, ২০০১ অস্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত তাঁর কফিনে রাখেন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা তাঁকে সমাধিস্থ করার আগে বাজানো হয় বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত।
[১৮৬] হারুন হাবীব

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!