ওয়ালিয়ার যুদ্ধ, নাটোর
বারী সাহেব জানালেন, ২৫ শে মার্চের কালরাত্রির সব ঘটনার কিছু কিছু তারা আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। এর কয়দিন আগে নাটোরে আনসারদের শীতকালীন প্রশিক্ষণ চলছিল। সরকারী সিদ্ধান্ত ছিল, ট্রেনিং এর শেষ দিনে প্রত্যক আনসার চাঁদমারিতে ২০০ রাউন্ড করে রাইফেলের গুলি খরচ করবে। কিন্তু মার্চের ২২ তারিখে ঢাকা থেকে আনসারের তৎকালীন ডেপুটি ডাইরেক্টর জনাব জহুরুল হক টেলিফোন করে অন্যান্য খবরাখবর নেয়ার পর আনসারদের চাঁদমারীতে গুলি কম খরচ করে কিছু গুলি বাঁচাতে নির্দেশ দেন এবং ঐ সমস্ত বাঁচানো গুলি পরে কাজে লাগতে পারে এই মর্মে ইঙ্গিত দেন এবং একই সঙ্গে তিনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আনসারদের রাইফেলগুলো যাতে প্রত্যেক থানায় সমানভাবে পাঠানো হয় সেই মর্মে নির্দেশ দেন। প্রথমে বুঝতে পারা যায়নি ডেপুটি ডাইরেক্টর কেন এই নির্দেশ দিলেন। ২৬ শে মার্চ সকাল দশটার দিকে তিনি অফিসে বসেছিলেন। এমন সময় নওগাঁর ই.পি আর-এই উইং কমান্ডার মেজর নাজমুল হক টেলিফোনে তাকে জানান যে, নগরবাড়ি ঘাট থেকে একদল পাকিস্তানী সৈন্য রাজশাহীর দিকে এগিয়ে আসছে। এই সৈন্যরা নিরাপদে রাজশাহী পৌঁছাতে পারলে ফল হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। যে কোনো অবস্থায় এঁদের প্রতিহত করতে হবে। আনসাররা এ ব্যাপারে কি ধরনের সাহায্য করতে পারেন তা যেন তাকে সত্বর জানানো হয়। সাথে সাথে বারী সাহেব আনসার অফিসার মিয়া আতাহার আলি, জাহিদুল হাকাম, আবদুর রশিদের সঙ্গে এই ব্যাপারে কি করা যায় সে সম্পর্কে তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করলেন। আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হল যে, যদি পাকবাহিনীকে প্রতিহত না করা হয় তাহলেও যেহেতু আনসাররা সামরিক শিক্ষায় শিক্ষিত তাই পাকবাহিনী নাগালে পেলে তাঁদেরকে জীবিত রাখবে না। তাই চাইতে বরং তাঁদের মোকবিলা করাই ভাল। হয় বাঁচা না হয় মরা। সাথে সাথে আনসার সংগ্রহের ব্যবস্থা হয়ে গেলো। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই চারশোর মতো আনসার, আট দশ জন কমান্ডার যুদ্ধের জন্য তৈরি হয়ে এলো। নাটোরের তৎকালীন এস. ডি. ও জনাব কামালউদ্দিন সাহেবকে বিষয়টি অবহিত করা হলে তিনি সঙ্গে সঙ্গেই এ ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করলেন এবং কয়েকটা ট্রাক ও একটি জীপ আনসার অফিসে পাঠিয়ে দিলেন। বিষয়টি সম্পর্কে মেজর নাজমুল হক সাহেবকে অবহিত করে ঐ দিনই সন্ধ্যায় পাবনা অভিমুখে রওনা হল আনসাররা। পানা থেকে যে রাস্তাটি রাজশাহীর দিকে গেছে তাঁর কাছে ‘মোলাডুলি’। ঐখানেই প্রথম আনসাররা পাকিস্তানীদের মুখোমুখি হয় এবং বৃষ্টির মত ওদের দিকে গোলাগুলি ছুঁড়তে থাকে। এই আচমকা আক্রমণ পাকবাহিনী আশা করেনি। তাই আনসারদের গুলির সামনে টিকতে না পেরে তারা পিছু হটতে শুরু করে। এরপর তারা পিছিয়ে গিয়ে অন্যপথে রাজশাহীর দিকে এগুতে থাকে। এই সময় আনসার কমান্ডার মোঃ ইউসুফ এই মর্মে মতামত দেন যে, পাকবাহিনী নিশ্চয় গোপালপুর-বনপাদা রাস্তা ধরে অগ্রসর হচ্ছে এবং তাঁদের প্রতিহত করতে হলে বনপাড়ায় একটি সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান নেয়া দরকার। সবাই ইউসুফের কথাতে একমত পোষণ করে দ্রুত বনপাড়ার দিকে এগিয়ে যায়। রাত ১০ টায় আনসার বাহিনী বনপাড়া পৌঁছে যায় এবং সাথে সাথেই খবর পাওয়া যায় যে, পাকবাহিনী গোপালপুরের দিকে অগ্রসর হতে আদেশ দেয়া হয়। ৫/৬ মাই যাওয়ার পর ‘ওয়ারিয়া’য় দ্বিতীয়বারের মত আনসাররা পাকবাহিনীর মুখোমুখি হয় এবং প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হয়। প্রকৃতপক্ষে, সমস্ত রাত এবং পরের দিন এক নাগাড়ে যুদ্ধ চলে। সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ পাকবাহিনী কভারিং ফায়ারের সাহায্যে পিছু হটতে শুরু করে। ঐ সময় কমান্ডার ইউনুস, মেহের আলী, জেহের আলী, মোজাম্মেল, সাত্তার (প্রাক্তন সৈনিক) এদের পরামর্শ অনুযায়ী ইউনুসের কমান্ডে দুই প্লাটুন আনসার (৬০ জন) ভিন্ন পথ ধরে দ্রুত গতিতে- যাতে করে পাকবাহিনীর আগেই গোপালপুর স্টেশনে পৌঁছান যায়, সেই জন্য রওনা হয়ে যায়। পাকবাহিনী পৌঁছানোর আগে তারা গোপালপুর ওয়াগন দিয়ে রাস্তায় বেরিকেড সৃষ্টি করা হয়। এই খবর এবং আনসারদের অবস্থান পাকবাহিনী আন্দাজ করতে পারেনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকবাহিনী গোপালপুর স্টেশনের কাছে পৌঁছে গিয়ে বেরিকেড দেখতে পেয়ে জোয়ানদের নামিয়ে দেয় ঐ বেরিকেড সরানোর জন্য। এই সুযোগেই আনসার বাহিনী অকস্মৎ পাকবাহিনীর উপর গুলি চালানো শুরু করে। গোলাগুলির শব্দ পেয়ে স্থানীয় জনসাধারণ তুমুল উদ্দীপনায় যার যা আছে তাই নিয়ে আনসারদের সঙ্গে যোগ দেয়। ঘন্টাখানেক যুদ্ধ চলার পর ২২ জন পাক সৈন্য নিহত হয়। ঐ যুদ্ধে পাকবাহিনীর অধিনায়ক মেজর আসলাম আহত অবস্থায় মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পরে। এর কয়েকদিন পর পাকবাহিনী গোপালপুর পুনরুদ্ধার করে এবং প্রতিশোধ হিসাবে গোপালপুর সুগার মিলের তৎকালীন ম্যানেজার ক্যাপ্টেন (অবঃ) আজিম এবং সুগার মিলে কর্মরত তিন/চারশো শ্রমিককে হত্যা করে এবং স্টেশুনের আশপাশের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। যুদ্ধের পর পাকবাহিনীর সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে নাটোরে আনসার অফিসে নিয়ে আসা হয়। পরের দিন মেজর নাজমুল হক নাটোরে এসে আনসারদের যুদ্ধের সাফল্যের বর্ণনা শুনে এবং অস্ত্রশস্ত্র দেখে মুগ্ধ হন এবং মর্মে প্রশ্ন রাখেন যে, সামান্য ৩০৩ রাইফেল দিয়ে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে সজ্জিত পাকবাহিনীকে পরাস্ত করে গেল কিভাবে। উত্তরে তাঁকে জানান হয় যে, আনসার ও জনগণ একত্রে কাজ করলে সব সম্ভব। এরপর তিনি ঐ সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নওগাঁতে ই.পি আর এর জোয়ানদের ব্যবহারের জন্য নিয়ে যান। এরপর এক সময় আনসারদের রাইফেলের গুলির স্বল্পতা দেখা দেয়। কিভাবে কি করা হবে তাই চিন্তা হচ্ছিল। হঠাৎ এপ্রিলের ৭ তারিখে এক অপরিচিত ভদ্রলোক বারী সাহেবের অফিসে তাঁর সাথে দেখা করতে আসেন। গোপনভাবে তিনি জানান যে, তিনি ভারতীয় সরকারের লোক এবং নাটোরের আনসারদের রাইফেলের গুলির স্বল্পতা সম্পর্কে তারা জানেন। এবং তাঁকে গুলির একটা নমুনা দিলে কাশীপুর অস্ত্রকারখানা থেকে কিছু গুলি তৈরি করে ৪/৫ দিনের মধ্যে আনসারদের দিতে পারেন। তখন তাঁকে ১টা গুলির নমুনা দেয়া হয়। পরে অবশ্য পরিস্থিতি অন্যরকম হওয়ার এবং আনসাররা ১২ এপ্রলি নাটোর ছেড়ে যাওয়ায় সেই রাইফেলের গুলি আর পাওয়া সম্ভব হয়নি।
নাটোর থেকে পালিয়ে আসা সম্পর্কে আর একটি করুণ কাহিনী। ১১ এপ্রলি রাত্রে খবর পাওয়া গেল যে, পাকবাহিনীর এক বিরাট দল নাটোরের দিকে এগিয়ে আসছে। এই বিরাট দলকে বাধা দেবার মত শক্তি আনসারদের ছিল না। তাই ঠিক হলও খুব ভোরে আনসাররা নাটোর ছেড়ে ভারতে চলে যাবে। কাজও হল সেই মতই। কিন্তু এই সময় এক দুঃসাহসিক ঘটনা ঘটে গেল। পাকবাহিনী নাটোর দখল করে রাজশাহীর দিকে এগুচ্ছে এই খবর পেয়েছিল স্থানীয় প্লাটুন কমান্ডার তৈমুর। চৌদ্দ-পনের জন আনসার নিয়ে সে নাটোর-রাজশাহীর মাঝামাঝি জায়গা ‘ঝলমলিয়াতে’ পাকবাহিনীকে বাধা দেবার জন্য প্রতিরোধ গড়ে তোলে। চৌদ্দ-পনের জন আনসারকে রাস্তার দুধারে বসিয়ে নিজে একটা ৩০৩ রাইফেল নিয়ে একটা উঁচু গাছের উপর অবস্থান নেন। বেলা ৮-৯টার দিকে পাকবাহিনীর বিরাট কনভয় ঝলমলিয়াতে অতিক্রম করার সম্য লুক্যে থাকা আনসাররা গুলিবর্ষণ শুরু করে পাকবাহিনীর উপর। আনসাররা রাস্তার উপর থেকে এবং কমান্ডার তৈমুর গাছের উপর থেকে আক্রমণ করে। কিছুক্ষণ যুদ্ধ করার পর ৮/৯ জন পাক সেনাকে নিহত করে ৪ জন আনসার শহীদ হন। বাকিরা পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়। কিন্তু কমান্ডার তৈমুরকে চারদিকে থেকে ঘিরে ফেলে পাকসেনারা। শেষ পর্যন্ত তৈমুরের সর্বশেষ গুলিটা যখন এক পাকসেনার বুক ভেদ করে চলে যায়, এবং আর গুলি না থাকায় বাধ্য হয়ে তাকে আত্মসমর্পণ করতে হয়। পাকবাহিনী প্রথমে তাঁকে পাকিস্তান-জিন্দাবাদ ধ্বনি দিতে বলে। তাঁর উত্তরে তিনি ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দেন। সাথে সাথে পাকবাহিনী গুলি করে তাঁর ডান হাতটা ভেঙে দেয়। পাকসেনারা আবার তাঁকে রাজশাহী নাটোর রাস্তার উপর চিত করে শুইয়ে ফেলে তাঁর দেহের উপর গাড়ি চালিয়ে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিতে দিতে রাজশাহীর দিকে অগ্রসর হয়। বারী সাহেব বললেন, “দেশ স্বাধীন হলে জাতি কমান্ডার তৈমুরের কথা নিশ্চয়ই মনে রাখবে
[৫৮৮] কাজী সামসুজ্জামান
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত