ওসমানগঞ্জের যুদ্ধ, ভোলা
ওসমানগঞ্জ স্থানটি ভোলার সর্বদক্ষিণের উপজলেয়া চরফ্যাশনের অন্তর্গত। থানা সদর থেকে তিন মাইল উত্তর পশ্চিমে এবং গজারিয়া বাজার থেকে সরাসরি দক্ষিণে। একে কেউ কেউ বলেন পেয়ার আলী ব্যাপারী বাড়ির যুদ্ধ। কারণ, যে বাড়িকে ঘিরে ভোলার প্রথম যুদ্ধটি সংঘটিত হয়, একে ঐ নামেই ডাকা হয়। এটি ছিল এক সময়কার জয়নগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বেলায়েত মিয়াদের চরের বাসাবাড়ি। বছরের মাত্র দু’সময়ে এ বাড়িতে লোক থাকে, ফসল রোপণ ও ফসল কাটার সময়। অন্য সময়ে বলতে গেলে বাড়িটা ফাঁকাই পড়ে থাকে। বাসাবাড়ি বলে এখানে মহিলাও ছিল না। ফলে মুক্তিযোদ্ধারা এতে সহজেই ক্যাম্প বানানোর সুযোগ পায়। তাছাড়া স্থানটা ছিল থানা সদর থেকে বেশ দূরে এবং পথও ছিল যথেষ্ট দুর্গম। যোদ্ধাদের এখানে একত্রিত হওয়ার বিশেষ কারন ছিল এইঃ তারা চরফ্যাশন থানায় হামলা চালিয়ে একে নিজেদের দখলে নিয়ে আসবে। যেহেতু ভোলা শহরে ছিল পাকআর্মিদের অবস্থান। সুতুরাং ভোলায় হামলা চালিয়ে সুবিধা করা যাবে না। তার বদলে তারা যদি দক্ষিণ থেকে শুরু করে এবং এতে সফলতা আসে তাহলে ধীরে ধীরে উত্তর দিকে এগুতে থাকবে। এর উত্তরেই লালমোহন, তার কাছাকাছি তজুমদ্দিন থানা। পরিকল্পনা অনুযায়ী সিরাজ সিকদার গ্রুপের ১৩ জন এবং সিদ্দিকুর রহমানের নেতৃত্বে ২৭ জন সদস্য সে বাড়িতে এক সপ্তাহ ধরে অবস্থান করছিল। বাড়ির দুটি অংশ, উত্তর বাড়ি ও দক্ষিণ বাড়ি। এ দু’বাড়িতে চল্লিশজন লোক ভাগাভাগি করে থাকতো। সবসময় পরিকল্পনা করতো কিভাবে থানা আক্রমণ করা যায়। কিন্তু তাঁদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ ছিল সর্ব সাকুল্যে তিনটি ৩০৩ রাইফেল, একটি রিভলবার, একটি পিস্তল ও তিনটি গ্রেনেড যা লোকের তুলনায় অপ্রতুল এবং যুদ্ধ করার জন্য মোটেই আশাপ্রদ নয়। তবু তাঁদের বিশ্বাস তারা আক্রমণ করবে ও জয়লাভ করবে। দিন যায়। এর মধ্যে এক বৃষ্টির রাতে তারা থাকা আক্রমণ করতে গেল। কিন্তু চারদিকে ছিল যথেষ্ট আলো এবং রাস্তা দিয়ে লোকজন সরব চলাফেরা করছিল। তবু তারা ঘন্টা খানে আড়ালে ওঁৎ পেতে বসে থাকে। ঘন্টা খানেক ঠ্যাকার পর তারা আবার ক্যাম্পে ফিরে আসে। এ বাড়ির দক্ষিণ পাশের দেওয়ান বাড়িতেই ছিল রাজাকারদের আড্ডা। সে বাড়ির রস্তুম আলী দেওয়ানের এক ছেলে বেলায়েত দেওয়ান ও তার এক পুত্রবধূ দেলোয়ারের স্ত্রী মনোয়ারা বেগম স্পাই এর কাজ করতো। আর মুক্তিযোদ্ধাদের সকল গতিবিধির খবর থানায় পৌঁছাতো। একদিন বেলা ১২টার দিকে মনোয়ারা মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে এসে মুলিবাঁশের বেড়ার ফাঁকে উঁকিঝুঁকি মারছিল বিষয়টা একজন পাহারারত মুক্তিযোদ্ধার নজরে এলে তাকে তৎক্ষণাৎ ধরে আনা হয়। অতঃপর তাকে তল্লাসী করে সন্দেহজনক একটা চিরকুট পাওয়া যায়। এরপর তাকে পালাক্রমে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এক পর্যায়ে সে স্বীকার করে যে, সে থানার একজন ইনফর্মার। তার ভাসুর বেলায়েত দেওয়ানওঁ তার সাথে জড়িত। বিষয়টা নিশ্চিত হতে মুক্তিযোদ্ধারা বেলায়েতকে ধরে নিয়ে আসে। তাকেও মনোয়ারকে গুলি করে ও তাদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়। ঘটনাটা মুহূর্তের মধ্যে রাষ্ট্র হয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারাও প্রস্তুত হতে থাকে। যদি কোনো দিক থেকে হামলা হয়। তারা যেন এর যথাযথ প্রতিরোধ করতে পারে।
দিনটা ছিল বৃষ্টি ঝড়ের। আবহাওয়া খুব একটা ভালো ছিল না। ৯ আগস্ট বৃহস্পতিবার। কমান্ডার সিদ্দিকুর রহমান দুপুরের খাবার তখনও পুরোপুরি শেষ করেননি। কেউ খেয়েছে, কেউ খাবার অপেক্ষা করেছেন। এমনি সময়ে কেউ একজন জানালো-পুলিশ আসছে। সঙ্গে সঙ্গে কমান্ডার সাহেব সকলকে তৈরি হতে বললেন। চল্লিশজনের ছোট বাহিনী। কেউ আর্মি থেকে অবসরপ্রাপ্ত, কেউ পালিয়ে আসা সদস্য, আর ছিল ক’জন ছাত্র। সিদ্দিক সাহেব সকলকে পজেশন নিতে বললে কেউ ঘরের আড়ালে কেউ গাছের আড়ালে অবস্থান নিল। আগ্নেয়াস্ত্র কম খাকলেও সকলের কাছে পর্যাপ্ত লাঠিসোটা ছিল। মুক্তিযোদ্ধা মিজান বললেন, আমরা লক্ষ করছি ৩৫-৪০ জনের একটি গ্রুপ আসছে। ওসি রকিবউদ্দিন আসছেন সাইকেলে চড়ে কিন্তু প্যাডেলে চাপ দিচ্ছেন না। তাকে ধরে ঠেলে নিয়ে আসছে দুজন পুলিশ। পেছনে এবং আশপাশে ছিল ৯ জন পুলিশ মিলিশিয়া ছিল ৩১ জন। ব্যাপারী বাড়ির পূর্ব পাশ নিয়ে বয়ে গেছে মুখারবান্দা খাল। খালের উপর একটি বড় সাঁকো। তারা সাঁকোর কাছাকাছি এসে চিন্তা করছিল কিভাবে সাঁকো পার হওয়া যায়। দারোগা সাইকেল থেকে নামলেন মাত্র। তার মধ্যে একটা বিলাসী মনোভাব, কোনো রকম যুদ্ধের প্রস্তুতি পরিলক্ষিত হচ্ছিল না। বরং তথাকথিত স্পাই বেলায়েত ও মনোয়ার হত্যার তদন্ত করার জন্য তারা খুব ধীর গতিতে এগিয়ে আসছিল। তাদের কোনো একজন সবেমাত্র সাঁকোয় পা রাখল অমনি সিদ্দিক সাহেব ফায়ার ওপেন করলেন। সঙ্গে সঙ্গে দু’পক্ষে গুলি বিনিময় শুরু হতে গেল। মুক্তিযোদ্ধারা এগুচ্ছেন। আর মিলিশিয়া পিছাচ্ছে। অতঃপর অপ্রস্তুত মিলিশিয়াদের এবার পালোনোর পালা। কিন্তু পালিয়ে তারা যাবে কোথায়। পিছনে বিস্তৃত মাঠ, সরু রাস্তা এবং দুপাশে দিগন্তজোড়া ধানক্ষেত। একটা-দেড়টা থেকে শুরু করে যুদ্ধ চলল প্রায় সন্ধ্যা নাগাদ। যুদ্ধের কথা শুনে চারপাশের গ্রাম থেকে প্রচুর নারী পুরুষ সমবেত হল। তারাও প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা করল। মারা পড়ল ১১ জন। আর ধরা পড়ল চরফ্যাশন থানার ও.সি.সহ ৯ জন। রাইফেল উদ্ধার হলো ১৩টি। এতদিন ভোলার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে অস্ত্র ছিল না বললেই চলে। কিন্তু এই যুদ্ধে তাদের প্রচুর লাভ হলো। অস্ত্র এবং গোলাবারুদ পর্যাপ্ত এলো। সবচেয়ে বড় লাভ তাদের মনোবল বেড়ে গেল। তারা নিশ্চিত হলো- ঐক্যবদ্ধ থাকলে এবং সঠিক কম্যান্ডিং থাকলে যে কোনো যুদ্ধে তারা জয় লাভ করতে পারে।
[৩৭] কালাম ফায়েজী
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত