কনখাইয়া খাল অভিযান, চট্টগ্রাম
রাউজান ও ফটিকছড়ি থানার সীমান্তের মধ্যবর্তী এলাকায় ধর্মপুর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান করছিলেন। এই ক্যাম্পের দক্ষিণ দিক দিয়ে একটা বড় খাল পূর্ব-পশ্চিমে প্রবাহিত হয়েছে। এটিই কনখাইয়া খাল। এই খালের দক্ষিণে রাউজানের আমিরহাটে পাকসেনারাদের দৃঢ় প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুদের শক্তি ও দৃঢ় অবস্থান সম্পর্কে সম্যক ধারণা ছাড়াই অনেকটা আবেগের বশবর্তী হয়ে অপরিকল্পিত আক্রমণ চালিয়ে তীব্র প্রতিয়াক্রমনের সম্মুখীন হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের অবস্থান সংহত করে পুনরায় শত্রুদের সামনাসামনি মোকাবিলা করতে পেরেছিলেন। আনুমানিক ১০ ডিসেম্বর রাত ১১ টায় আবু বকর সিদ্দিকী ও শেখ আবু আহমেদ দলের সদস্যরা আবু-বকর সিদ্দিকির ঘরে বসে চা খাচ্ছিলেন। এমনসময় মোঃ। ইসমাইল নামের একজন মুক্তিযোদ্ধা খবর দে যে, তাঁর বাড়িতে পাকবাহিনী আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। এ খবর শোনার সাথে সাথে কামালউদ্দিন চৌধুরীর দলের কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের খাল এলাকার পাকসেনা অবস্তানের ওপর আক্রমণ করেন। এই আক্রমণের সাথে সাথে শত্রুরা তাদের দৃঢ় অবস্থান থেকে তীব্র প্রতিরোধ রচনা করে। শত্রুদের আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা হতবিহবল হয়ে পড়েন। সাথে সাথে তাঁরা প্রতি আক্রমণের পরিকল্পনা নেন। মুক্তিযোদ্ধাগণ তাৎক্ষণিক প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনার পর তাঁদের অবস্থান থেকে লক্ষ্য করেন যে, শত্রুপক্ষ প্রতিআক্রমণের জন্য অগ্রসর হচ্ছে। এমতবস্থায় শত্রুপক্ষ কার্যকর দূরত্বের মধ্যে আসামাত্রই মুক্তিযোদ্ধারা গুলিবর্ষণ শুরু করে। দু’ পক্ষের মধ্যে বেশকিছু সময় ধরে গুলি বিনিময় হবার পর শত্রুপক্ষ পিছু হটতে বাধ্য হয়। ইতোমধ্যে সকাল আনুমানিক আটটায় স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের অবস্থান আরো সুদৃঢ় করার চেষ্টা করেন এবং প্রতিরক্ষা অবস্থানেই থেকে যান। শত্রুপক্ষ শক্তিসঞ্চয় করে আবার আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধারাও তাঁদের তীব্র আক্রমণ প্রতিরোধ করেন। পরিদিন রাতেই মুক্তিযোদ্ধাদল তাঁদের প্রতিরক্ষা অবস্থানের কিছুটা পেছনে চলে আসেন। তৃতীয়বার শত্রুরা নতুন শক্তিতে বিনাবাধায় আনুমানিক সকাল ৬টায় সম্মুখ আক্রমণের জন্য এগিয়ে আসে। এবার মুক্তিযোদ্ধা দল তাৎক্ষণিকভাবে অবস্থান বিন্যস্ত করে। শেখ আবু আহমেদের নেতৃত্বে তৃতীয় দলে পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা বিভক্ত হয়ে তাঁদের প্রতিরক্ষা অবস্থানের পেছনের একটা পুকুরপাড়কে আড়াল হিসেবে ব্যবহার করে অবস্থান নেন। অবস্থান নেয়ার পর অত্যন্ত স্বল্পশক্তির কারণে দলনেতারা তাৎক্ষণিকভাবে শত্রু মোকাবেলার বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। কিন্তু সহযোদ্ধারা দলনেতাদের মনোবল শক্তিশালী করার জন্য বারবার প্রেরণা যোগালেঅ তাঁরা দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। ইতোমধ্যে সহযোদ্ধা বাবুল শীল দলনেতার কথা না শুনেই গুলির্ষণ শুরু করে শত্রুপক্ষকে হতবুদ্ধি করে দিয়ে সামনের খালে অবস্থান নেন। শত্রুপক্ষ পিছু হটতে থাকে। একঘন্টা গুলি বিনিময়ের পর মুক্তিযোদ্ধারা আবারও শক্তিবৃদ্ধি করার প্রয়োজন অনুভব করে। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা স্থানীয় জনগণসহ ৫০০-তে উন্নীত হয়েছিল। ঐ দিন দুপুর ১২টা থেকে শত্রুরা মর্টার শেলিং শুরু করে এবং ১টা পর্যন্ত এর তীব্রতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। দুপুর একটার পর গুলিবিনিময় স্তিমিত হয়ে আসে। ইতোমধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা অন্য গ্রুপ থেকে এলএমজি নিয়ে এসে নিজেদের শক্তিবৃদ্ধি করার চেষ্টা করেন। মুক্তিযোদ্ধারা নিজ অবস্থান থেকে তিন মাইল পেছনে নানুপর হাইস্কুলে সেক্টর ট্রুপসের একটি কোম্পানির অবস্থান ছিল কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন লে. শওকত। ঐ কোম্পানির প্রশাসনিক সহায়তার সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন এম পি মির্জা আবু মনসুর। মুক্তিযোদ্ধাদের একজন ঐ কোম্পানিকে তাঁদের প্রতিরক্ষা দৃঢ় করার জন্য অনুরোধ করেন। অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিত সরজমিনে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান দেখার জন্য কোম্পানি কমান্ডার ঐ এলাকায় যান। কেননা, এর আগে ঐ কোম্পানির এক প্লাটুন জনবল ভুল তথ্যের ভিত্তিতে নাজিরহাটে পাকিস্তানিদের হানা দিতে গিয়ে এগারজন সঙ্গীকে হারায়। এজন্য কোম্পানি কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা আবু আহমেদ ও সোলায়মান এই দুইজনকে ডেকে নিয়ে তাঁদের প্রতিরক্ষা অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্টভাবে জেনে নেন। পরবর্তীতে সুবেদার রহমত আলীর নেতৃত্বে একটি প্লাটুন তিন ইঞ্চি মর্টারসহ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগ দেয়। এরপর মুক্তিযোদ্ধাদের তাৎক্ষণিক রণনীই বদলিয়ে সম্মুখ আক্রমণ শুরু করে। তাঁরা শত্রু অবস্থানের ওপর মর্টার আক্রমণ শুরু করেন। এতে শত্রুদের মনোবল ভেঙে যায়। শত্রুরা তিন ঘন্টা ধরে যুদ্ধ পরিচালনার পর পিছু হটতে থাকে।
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত