You dont have javascript enabled! Please enable it!

ওগারিয়া বাজারের যুদ্ধ, চাঁদপুর

১৯৭১ সালের ১৫ জুলাই চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি থানার ওগারিয়া নামক স্থানে তৎকালীন মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার ক্যাপ্টেন জহিরুল হক পাঠান (অব.টি.জে)- এর বাহিনীর দিনভর প্রচণ্ড লড়াই হয়। এই যুদ্ধে নেতৃত্বে দেন সুবেদার আলী আকবর পাটোয়ারী (রামগঞ্জ) তাঁর সহযোদ্ধারা হলো নায়েক মোহাম্মদ আলী (টি.জে) সিপাহি রহমত আলী বালিথুবা, আঃ মান্নান (ই.পি.আর), সিপাই করিম (ভাওয়াল), হাবিলদার বাসার (সাচনমাগ), জয়নাল চৌধুরী (নেভাল অফিসার) আরও অনেকে। মুক্তিযোদ্ধারা রাত ৪টার সময় ওয়ারিয়া মোল্লা বাড়ির কাছে পাক বাহিনীর টেলিফোনের তার কেটে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে। মুক্তিযোদ্ধারা ভোর ৪টার সময় এসে বগৌড় পাটোয়ারী বাড়ির (খাদুয়া বাড়ি) শেষ মাথায় পজিশন নেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে থেকে পাকবাহিনীর আক্রমণের স্থানটি ছিল মাত্র ২৫ গন দূরত্ব। মাঝখানে ধানক্ষেত, ছোট খাল। পজিশনে ছিল পানি কাদা মশা আর লাল পিঁপড়া। ভিজা মাটি মশার কামড়ে হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। মুক্তিযোদ্ধারা প্রতীক্ষায় আছে কখন পাক সেনারা আসবে। তাদের কাছে খবর আছে প্রতিদিন সকালে রুটিন মাফিক ১৫/২০ জন পাক সেনা এই রাস্তা দিয়ে সকালে এবং বিকালে অফিস চিতশী আসা-যাওয়া করে। সূর্য ওঠার সাথে সাথেই সেটি নারায়ণপুর মোল্লা বাড়ি থেকে একজন বৃদ্ধলোক গরু নিয়ে রাস্তায় এসে দেখে তারকাটা। বৃদ্ধে চিৎকার দেয়ার সাথে সাথে এলাকার লোকজন বিভিন্নভাবে জীবন বাঁচানোর জন্য পালিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনীর আগমন টের পেয়ে খোড়িহর বগৌনের জনগনও পালাতে লাগল। সকাল প্রায় ৮টা আমাদের ওপি খবর দিল মেহমান আসছে। দেখা গেল ১৪/১৫ জন পাক সেনা হেলেদুলে এগিয়ে আসছে। মুক্তিবাহিনীর হাতিয়ার ২টি ব্রিটিশ এল.এম. জি. ২টি স্টেনগান ও রাইফেল। পাক বাহিনীর কমান্ডার মুক্তিবাহিনীর টার্গেট মতো পৌঁছে গেছে। এমন সময় হানাদার বাহিনীর কমান্ডার ইশারায় সবাই রাস্তার উপর বসে পড়ল। কমান্ডার কাঁটা তাঁর হাতে নিয়ে বলে উঠল, আলেকা মেরি গাল শুন, হামারি কমিউনিকেশান কোন হেলক করদিয়া বলেই চতুর্দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ইয়ে যায়গা কেয়া নজর আতাহে…। বলার সাথে সাথে সুবেদার আলী আকবর হুকুম করলেন ফায়ার। শুরু হলো জালিম হায়েনাদের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ। ফায়ারের সাথে সাথে তারা ৪/৫ হাত লাফিয়ে কেউ রাস্তার পাশে, কেউ রাস্তার ওপর লুকিয় পড়ল। মুক্তিবাহিনী জীবনপণ গুলি করা যাচ্ছ। ওদের কান্নার স্পষ্ট আওয়াজ আসছে হামকো বাঁচাও, হামকো লে লও ভাইয়া, হামকো বাঁচাও। ৪/৫ মিনিট পর ওদের তরফ থেকে শুরু হলো আক্রমণ। এবার উভয় পক্ষে চলছে লড়াই। ১৫/২০ মি. পর মুক্তিযোদ্ধারা ফায়ারের রেট কমিয়ে দিল। মাথা তুলে দেখা গেল পাকবাহিনী পায়ে ধরে টেনে রাস্তা থেকে লাশ সরাচ্ছে। কেউ কেউ অনবরত গুলি করা যাচ্ছে। উভয় পক্ষে থেমে থেমে লড়াই হচ্ছে। হঠাৎ ৫০/৬০ মি. পর ৩টি হেভি মেশিনগান ও ইঞ্চি মর্টারের অনবরত গোলা মুক্তিবাহিনীর সামনে পিছনে পড়তে শুরু করল। সাথে ৬/৭ চাইনিজ এল.এম.জি. থেকে ওস্তাদ মোঃ আলী গুলি করে যাচ্ছেন, উদ্দেশ্য তাদের ব্যস্ত রাখা। উভয় পাশে প্রায় ৭ ঘন্টা একটানা লড়াই চলছে। মুক্তিযোদ্ধাদের বুলেট প্রায় শেষ হয়ে আসছে। কমান্ডারের নির্দেশে তারা ধীরে ধীরে পিছে চলে আসতে থাকে। পাকবাহিনী টের পেয়ে শুরু করল তাদের বর্বরতার বহিঃপ্রকাশ। তারা বেলা ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বগৌড়, খেড়িহর, জয়নগর, মশত পাড়া, নারায়ণপুর, সেটি নারায়ণপুর, নোয়াপাড়া ও ওগারিয়ার ১০৮ খানা বাড়ি সম্পূর্ণ পুড়িয়ে ফেলে। তারা বগৌড় ভূঁইয়া বাড়ির জনাব জয়নাল মাতাব্বরের বৃদ্ধ মাকে এবং পাটোয়ারী বাড়ির রশিদ পাটোয়ারীর মাকে আগুনে পুড়িয়ে মারে। তাঁদের গুলিতে বহু নারী-শিশু আহত ও নিহত হয়। এই যুদ্ধে ১০ জন পাকবাহিনী ও বহু আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের একজন যোদ্ধা সামান্য আহত হন।
[২৪] ডা.মোঃ দেলোয়ার হোসেন খান

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!