You dont have javascript enabled! Please enable it!

ওজলপুর যুদ্ধ, মেহেরপুর
[অংশ গ্রহণকারীর বিবরণ]

মহেশপুর থানার কেন্দ্রবিন্দুতে আমাদের অতর্কিত আক্রমণ মহেশপুর ক্যাম্পের হানাদারদের আতঙ্কিত করে তোলে। এত ভেতরে আক্রান্ত হওয়ায় ভীত হয়ে পড়ে ওরা। যে কোন মূল্যে পাস্তাপাড়ায় আমাদের ক্যাম্প আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয় পাক বাহিনী। বিশ্বস্ত সূত্রে ওদের আক্রমণের দিন তারিখ জেনে যাই। পাস্তাপাড়া গ্রামকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া ছিল হানাদারদের উদ্দেশ্য। পার্শ্ববর্তী ক্যাম্প থেকে অতিরিক্ত সৈন্য নিয়ে শক্তি বৃদ্ধি করে তারা।
পাস্তাপাড়া থেকে দুই কিলোমিটার দূরে ওজলপুরে শত্রুদের সাথে একটা বোঝাপড়ার স্থান নির্ধারণ করি। গ্রামটি লম্বায় প্রায় এক কিলোমিটার। একটা বড় বাওর গ্রামটিকে শত্রু অধ্যুষিত এলাকা থেকে পৃথক করেছে। ওজল্পুর আমাদের এলাকার মুক্তঞ্চলের শেষ গ্রাম।
গ্রামের প্রায় শেষ প্রান্ত থেকে একটা ছোট রাস্তা মহেশপুর যাওয়ার মূল সড়কের সাথে গ্রামটি সংযুক্ত করেছে। সংযোগ সড়কের পঞ্চাশ মিটারেরও কম দূরত্বে রাস্তার ওপর ছোট একটা কালভার্ট। রাস্তাটির ওজলপুর প্রান্তে আধা পাকা কয়েকটি টিনের ঘর। সংযোগ সড়কটির মাথায় অবস্থিত একটা ঘরে আমরা অবস্থান নেয়ার সিদ্ধান্ত নেই। শত্রুদের ওপর প্রথম আঘান হানার পরিকল্পনা করি অ্যাম্বুশের মাধ্যমে।
কালভার্টের উভয় প্রান্তে দুটি করে চারটি জাম্পিং মাইন স্থাপন করি। কালভার্টের বিপরীত প্রান্তে রাস্তার পাশে বেশ কিছু এন্টিপারসোনার মাইন পুঁতে রাখি প্রায় সমা দূরত্বে। প্রতিটি জাম্পিং মাইনকে পরস্পপরের সাথে সংযোগ সাধন করি তারের মাধ্যমে। আমাদের সম্বল একটি মাত্র এলএমজি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা মাহাতাব অনতিদূরে একটি পাকা ইদারার পাশে অবস্থান গ্রহণ করে। সাথে এস এল আর নিয়ে আরও দু’জন। শত্রুপক্ষকে বোকা বানানোর জন্য লম্বা গ্রামটি জুরে থ্রি নট থ্রি ও এস এল আর নিয়ে অবস্থান নেয় মুক্তিযোদ্ধারা। উল্লেখ্য গ্রামটি প্রবেশের জন্য সংযোগ সড়কের বিকল্প কোন পথ ছিল না। বিকল্প উপায়ে শত্রুর আসার জন্য একমাত্র অবলম্বন নৌকা। যা দৃষ্টিগোচর হওয়ার সাথে সাথে গুলি করে ডুবিয়ে দেয়ার ক্ষমতা ছিল আমাদের।
বরাবরের মতো সেদিনও সূর্য উঠে রঙ্গিন আলো ছড়িয়ে। নিঃশব্দ প্রকৃতির মাঝে আমরা অবস্থান নিয়েছি পরিকল্পনা মত। সংযোগ সড়কের সামনা সামনি একটা নিয়ের দোচালা ঘরে অবস্থান নিয়েছি আমি। সাথে শাজাহান, আনিস ও ইউসুফ। জাম্পিং মাইনের তারের এক প্রান্ত আমার হাতে। ভাঙ্গা চারটি জানালা খড়কুটো দিয়ে বন্ধ করে অবস্থান নিয়েছেন সঙ্গী যোদ্ধারা। এস এল আর তাক করা কালভার্ট দিকে। আমার এক হাতে শত্রুদের প্রাণ।
মাহাতাব এলএমজি’র ট্রিগারে হাত রেখে অপেক্ষা করছে শত্রুর আগমনের। বিভিন্ন পজিশনে থাকা বীর যোদ্ধারা চূড়ান্ত সিগন্যালের অপেক্ষায়। সকাল ৭টা, ৮টা, ৯টা। সময় এগিয়ে চলে। চরম উত্তেজনা সবার মাজেহ। হৃৎপিন্ডের দলটি চোখে পড়ে। সঙ্গী প্রতিটি যোদ্ধা একটু নড়ে চড়ে আবার স্থির হয়ে যায়। ফিস ফিস শব্দ। প্রস্তুত সবাই।
শত্রুরা চাইনিজ রাইফেল তাক করে সংযোগ সড়ক ধরে এগিয়ে আসে। খাকী ড্রেস। মাথায় হেলমেট। পাশে পাশে রাজাকার। ওদের তুলনায় খর্বাকৃতির। বিশ্বাসঘাতক, বেঈমানের দল। শত্রুরা এগিয়ে আসতে আসতে কালভার্টের একটু দূরে একটা বাঁশঝাড়ের নিচে থেমে যায়। দেখে ফেলোনিতো আমাদের? অজানা আশংকা।
না তেমন কিছুনা। ওরা নিঃসঙ্কোচে এগিয়ে আসে আবার। উর্দু কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। সামনে তিন জনের একটি সারি এগিয়ে আসছে আমাদের নাক বরাবর। পেছনে আরও পাক সেনা, রাজাকারদের একটা কলাম। কালভার্টের উপরে উঠে এলো তিনজন। কালভার্টের শেষ প্রান্তে আসার পর এক হানাদার ‘তসলিম, আ যাও’ বলে হাত উঁচিয়ে পেছনের সঙ্গীদের নির্ভয়ে অনুসরণের ইঙ্গিত করে। ঠিক তখনই আমার হাতে টান। বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে জাম্পিং মাইনগুলোর। কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে যায় কালভার্ট ও সংযোগ সড়ক। মাইন বিস্ফোরণের সাথে সাথে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি। গর্জে ওঠে মাহাতাবের এলএমজি। সংযোগ সড়কে পুঁতে রাখা কয়েকটা এন্টিপারসোনাল মাইনের বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাই।
শত্রুপক্ষ নিরব। কিছুক্ষণ পর ধোঁয়া কেটে যায়। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে ওঠে কালভার্ট ও সংযোগ সড়ক। হানাদারদের কয়েকটা লাশ কালভার্টের ওপর পড়ে আছে। কারো অর্ধেক শরীর রাস্তার ওপর। বাকিটা পানিতে। কয়েকটা দেহ ছিন্ন ভিন্ন প্রায়। হানাদারদের এই নির্মম পরিণতি দেখে সমন্বয়ে জয়বাংলা বলে চিৎকার দিয়ে উঠি। হানাদারা তখনও নিরব। আধ ঘন্টার মধ্যে ওদের প্রতিক্রিয়া জানা যায়। শত্রুর পেছনের দলটি পজিশন নিয়ে তীব্র গুলিবর্ষণ শুরু করে। ঝাঁকে ঝাঁকে গুলিতে আমাদের আশ্রয় নেয়া টিনের চালার অংশবিশেষ খুলে খুলে পড়ছে নিচে। সংযোগ সড়কের দিকে লক্ষ্য রেখে পজিশন নিয়ে আছি আমরা। সময় গড়িয়ে দুপুর হয়। কালর্ভাট ও রাস্তার ওপর তখনও পড়ে আছে হানাদারদের দেহ ক’টা। তীব্র রোদে ওদের কলুষিত রক্ত জমাট বাঁধে। হঠাৎ মর্টার শেল ছুঁড়তে শুরু করে পাকবাহিনী। শেল পড়ছে আশে পাশে। আমরা নিরুপায়। যে কোন মুহূর্তে আমাদের ঘরটা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। পজিশন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হই। মাত্র একশ মিটার দূরে দক্ষিণে মাহাতাবের কাছে যাওয়া সম্ভব ছিল না। বৃষ্টির মত গুলি ছুঁড়ছে পাকিবাহিনী। ক্রলিং করে যাওয়ার মতো অবস্তা না থাকায় আমরা পিছনের বিলের পানিতে নেমে যাই। শুধু মাত্র নাকটা ভাসিয়ে ধীরে ধীরে সরে যেতে থাকি উত্তরে, বিপরীত দিকে। গুলি পড়ছে পানিতেও। ধান গাছের পাতা পর্যন্ত ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। আমরা ক’জন তখন সৃষ্টিকর্তার নাম জপছি। মনে সাহস নিয়ে বিলের পাশ দিয়ে সাঁতার কেটে এক সময় প্রায় এক কিলোমিটার দূরে নিরাপদ স্থানে যেয়ে উঠি। দূর থেকে গোলাগুলি আওয়াজ শুনছি। মাহাতাব ও অন্যরা আমাদের অবস্থান প্রত্যাহারের বিষয়টি বুঝতে পারেনি। পাকবাহিনী ইতোমধ্যে সময় আমাদের গ্রুপের পক্ষ থেকে কোন শব্দ না পাওয়ায় আমাদের মৃত্যু অনুমান করেছিল। এক সময় মাহাতাব ও অন্যদের ধারণা হয়েছিল একই রকম।
এদিকে ডাঙ্গায় উঠে কয়েক কিলোমিটার ঘুরে পুনরায় মাহাতাবের সাথে মিলিত হই। ভূত দেখার মত চমকে ওঠে সে। অন্যরা আমাদেরকে জীবিত দেখে মহাখুশী। সহযোদ্ধারা সহস ও মনোবল বেড়ে যায় কয়েকগুণ। মাহাতাবকে বিশ্রাম দেয়ার জন্য এল এম জি পোস্টের দায়িত্ব নিয়ে কখনও আমি কখনও বা নাসির শত্রুদের গোলাগুলির দাঁত ভাঙ্গা জবাব দিয়ে চলেছি। দ্বিতীয় দফায় প্রচণ্ড মর্টার আক্রমণের ছত্রছায়ায় নিহত ও আহতদের লাশ নিয়ে গিয়েছিল শত্রুরা, এগুতে সাহস পায়নি ওরা।
বিকেলে হায়েনার দল পাগল হয়ে ওঠে। ভারী মেশিনগাণের প্রচণ্ড গোলাগুলির মাঝে অবস্থান ধরে রাখা খুব কষ্টকর হয়ে পড়ে আমাদের জন্য। অসীম সাহসী মাহাতাব চিৎকার দিয়ে ওঠে ‘আমরা পজিশন ছাড়ব না। কেউ যাবে না।’ গুলিবৃষ্টি মধ্যে পাকা ইদারার (কূপ) পাশে পজিশন নিতে গিয়ে মাথা সামান্য উঁচু হতেই আমার হেলমেট গুলির আঘাতে কয়েক মিটার দূরে ছিটকে পড়ে। একটা গুলি কপারের ডান পাশ স্পর্শ করে চলে যায়। মুহূর্তে মাটিতে শুয়ে পড়ি। কপালের রক্ত ঝরে পড়ে মাটিতে। লাল রক্তের ফোঁটায় ভিজে ওঠে মাটি, আমার মায়ের কোল। মাহাতাবের কোমরের গামছা দিয়ে বেঁধে নেই কপাল। আমি যেন ঐশ্বরিক শক্তিতে বলিয়ান হয়ে উঠি। দূরন্ত সাহস ভর করে মনে। শত্রুর সাতে শেষ বোঝাপড়া হবে এবার। আমরা মাত্র ক’জন। প্রতিরোধের মুখে ভারী অস্ত্র শস্ত্র নিয়েও হানাদাররা এগুতে পারেনি। ওদের মেশিনগাণের খই ফোটা শব্দ মিলিয়ে যেতে থাকে শূন্যে। হতাশা, চরম ব্যর্থতার মাঝে লাশের লাশের বোঝা কাঁধে নিয়ে শেষ বিকালে মহেশপুর ফিরে যায় হানাদার পাক বাহিনী। সারা দিনের যুদ্ধ ক্লান্তি মুছে পজিশন ছেড়ে বেরিয়ে আসি। একত্রিত হই। এগিয়ে যাই সামনের দিকে। কালভার্টের ওপর, আশেপাশে তখনও ছোপ ছোপ রক্ত। জমাট বেঁধে কালো হয়ে গেছে।
[৬] আব্দুল আজিজ

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!