উড়িয়া অপারেশন, গাইবান্ধা
গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার ব্রক্ষপুত্র নদীর পূর্বাপাড়ে চর এলাকায় উড়িয়া অবস্থিত। আগস্ট মাসের প্রথম দিকে ফুলছড়ি থানাস্থ রতনপুর অপারেশনের পরের দিন তারা গ্রামে এসে ঘরবাড়িতে আগুন দেয়। গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী চাল-ডাল ও দামি মালপত্র লুণ্ঠন করে ণৌকাযোগে নিয়ে যেতে থাকে। গ্রাম থেকে চারজন যুবতীকেও জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছি। মাহবুব এলাহী রঞ্জুর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা নদীর অপরপাড় থেকে শত্রুর নির্যাতনের এহেন দৃশ্য দেখতে পায়। তাই তাঁরা নদীর সমান্তরাল ভাবে শত্রুকে অনুসরণ করে চলতে থাকে। এক পর্যায়ে মুক্ত বাহিনীর সম্মুখপথে একটি খাল থাকায় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। শত্রু তাদের আয়ত্তের বাহিরে চলে যাচ্ছে বলে বাধ্য হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুর ওপর গুলিবর্ষণ করে। পাকিস্তানীদেরকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে। অতঃপর লুণ্ঠনকৃত মালামাল ও চারজন যুবতীকে উদ্ধার করা সম্ভব হয় এবং গ্রামবাসীকে হস্তান্তর করা হয়। আগস্ট মাসের শেষের দিকের কয়েকটি স্টিমার নোংগর করা ছিল। সেগুলি ধ্বংস করার জন্য বিশেষ নৌ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা আরমগূর সামছু, ও জিল্লু এবং অপর একজন মোট চারজনকে দায়িত্ব দেয়া হয়। স্টিমার ধ্বংস করার জন্য মূল পরিকল্পনা তৈরি মাহবুব এলাহী রঞ্জু ও রোস্তম আলী। মুক্তিযোদ্ধারা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে স্টিমারের গায়ে মাইন স্থাপন করতে যায় কিন্তু তারা শত্রুকে ফাঁকি দিতে পারেনি। শত্রু তাঁদেরকে দেখে তাৎক্ষণাৎ ফায়ার করে ফলে দুই মুক্তিযোদ্ধা ঘটনাস্থলে মারা যায়। বাদিয়াখালী ব্রিজটি ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে কমান্ডার রুস্তম আলী, মজিবুল হক ছানা ও মহসীন আলীকে ব্রিজটি দিনের বেলায় রেকি করার দায়িত্ব দেন। একাধিকবার রেকি করার পর তারা নিশ্চিত হল যে ব্রিজটি দু’ ধারে দুটি করে মোট চারটি বাঙ্কার আছে, যেখানে দাঁড়িয়ে রাজাকাররা ভারী অস্ত্রসহ পাহারায় থাকে। বাংকারগুলোর ওপরে খড়ের চাল ছিল। রেকি গ্রুপের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে ১৭ অক্টোবর রাতে মুক্তিযোদ্ধারা কাতলামারী থেকে পায়ে হেঁটে ব্রিজের কাছাকাছি আসে এবং অবস্থান গ্রহণ করে। অধিনায়ক স্পেশাল টাস্ক গ্রুপের অধিনায়ক মহসিনকে তার কাজ বুঝিয়ে দিয়ে ব্রিজের নিকটবর্তী বাঙ্কারগুলির দিকে গুলিবর্ষণ শুরু করে। একই সাথে গর্জে উঠে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের এলএমজি, এসএল আর এবং স্টনগান। শত্রুপক্ষ পাল্টা গুলিবর্ষণ শুরু করে। এভাবে প্রায় আধঘন্টা গুলি বিনিময়ের পরে অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা বগুড়ার সারিয়াকান্দির ফারুক এবং সুন্দরগঞ্জের রাজা ক্রলিং করে ব্রিজের কাছাকাছি যায় এবং শত্রুর বাঙ্কারের ওপর গ্রেণেড নিক্ষেপ করে। ফলে বাঙ্কারের উপর ভাগে আগুন ধরে যায় এবং শত্রুদল প্রাণভয়ে নদীর পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শত্রুর এলএমজির বার্স্ট এঁদের ওপর পড়ে এবং তিন জনেরই গুলি লাগে সাথে সাথেই গ্রামের লোকজন তাদের একটা ঘরের মধ্যে লুকিয়ে রাখে। এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন ফজলুর রহমান রাজা। তার দলে প্রায় ১১০ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিল। ৮ জন বিমানসেনা, কর্পোরাল আনোয়ার হোসেন, কর্পোরাল আব্দুর রশিদ, এয়ারম্যান ইসলাম উদ্দিন, এয়ারম্যান ওপর ফারুক এবং এয়াম্যান রুহুল আমিন বাদশাও ছিল এ দলে। অপ্রস্তুত আক্রান্ত মুক্তিযোদ্ধা মারাত্নক বিপদের মধ্যে পড়ে সমূহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এয়ারম্যান ইসলাম উদ্দিন এবং এয়ারম্যান ওমর ফারুক ঘটনাস্থলেই মুত্যুবরণ করেন। কর্পোরাল আলী আশরাফ পশ্চাদ্দেশে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন এবং এ অবস্থায় শত্রুর হাতে বন্দি হন।
[৫৯৬] অমিত কুমার বিশ্বাস
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত