আশুগঞ্জের যুদ্ধ, ব্রাক্ষণবাড়িয়া
৫ ডিসেম্বর আখাউড়া ৬ ডিসেম্বর ব্রাক্ষণবাড়িয়া ও সরাইল থেকে পিছু হটে পাকবাহিনীর ৩৩ বেলুচ রেজিমেন্ট ও ৪৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট আশুগঞ্জ ও ভৈরব বাজারের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। যৌথবাহিনী সোহাগপুরে অবস্থানকারী পাক সেনাদের একটি গ্রুপের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। উক্ত সংঘর্ষে পাক বাহিনীর বেশ কিছু সৈন্য নিহত হয়। এই ঘটনার পর পাকবাহিনী পিছু হটে সোহাগপুর গ্রামের শেষ সীমানায় দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে এসে অবস্থান গ্রহণ করে। ৯ ডিসেম্বর পাকিস্তানী সৈন্যদের একটি গ্রপ আশুগঞ্জের বিদ্যু কেন্দ্রের সীমানা প্রাচীরের ভিতরে বাংকার খনন করে দেয়াল ঘেঁষে ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী কামানসহ অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেয়। অপর আরেকটি গ্রপ মেঘনা নদীর তীরবর্তী উত্তর পূর্বদিকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের রেস্ট হাউজ ও অফিসার কোয়ার্টারে বাংকার খনন করে অবস্থান নেয়। এ সময় রেষ্ট হাউজের পিছনে মেঘনা নদীতে পাকিস্তানী সৈন্যদের কয়েকটি গানবোট নিয়ে বিপুল সংখ্যক সৈন্য অবস্থান করছিল। ৯ ডিসেম্বর বিলা ৩টার দিকে মিত্রবাহিনীর ৮টি ট্যাঙ্কসহ বিপুল সংখ্যক ভারতীয় সৈন্য দুর্গাপুর গ্রাম থেকে সোহাগপুর গ্রামের উপর দিয়ে আশুগঞ্জের দিকে যাত্রা করে। মুক্তিযোদ্ধারা তখন দূর্গাপুর গ্রামেই অবস্থান করছিল। এখানে ভারতীয় সৈন্যরা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অনেকটা পাশ কাটিয়েই আশুগঞ্জ দখলের চেষ্টা করছিল বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়। ভারতীয় সৈন্যরা তাদের নিজস্ব পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে সেদিন আশুগঞ্জ দখলের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আশুগঞ্জ পাকিস্তানী বাহিনী নেই, একথা নিশ্চিত মনে করে ভারতীয় সৈন্যরা ত্বরিত গতিতে সোহাগপুর গ্রামের খোলামাঠ পেরিয়ে আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সীমানা প্রাচীরের মাত্র ৫০ গজের মধ্যে ঢুকে পড়ে। সাথে সাথে পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী অত্যন্ত সুনিপুণভাবে তিন দিক থেকে আক্রমণ চালায়। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল ভারতীয় সৈন্যরা কিছু বোঝার আগেই তাদের প্রায় ৭০/৮০ জন সৈন্য মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। পাকিস্তানী সৈন্যরা ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী গোলার আঘাতে ভারতীয় ৩টি ট্যাংক সোহাগপুরের মাঠে সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়। মাত্র ৫ মিনিটের মধ্যে ভারতীয় সৈন্যরা পিছু হটে দৌড়ে দুর্গাপুরের দিকে সঅরে আসে। অপর দিকে পাকিস্তানী সৈন্যরা যুদ্ধ বিজয়ের উন্মদনায় বাংকার থেকে তাদের অবস্থান ছেড়ে ভারতীয়দের ধাওয়া করে সোহাগপুরের মাঠ দিয়ে দুর্গাপুরের দিকে এগোতে থাকে। এদিকে আশুগঞ্জে ভারতীয় সৈন্যদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সংবাদ পেয়ে ব্রাক্ষণবাড়িয়া, সরাইল, শাহাবাজপুর থেকে যৌথবাহিনীর সদস্যরা এসে দুর্গাপুরের অবস্থান করো। পাকবাহিনী দুর্গাপুর পৌঁছা মাত্রই যৌথবাহিনী পাকবাহিনীর উপর আক্রমণ করে। প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখে পাকিস্তানীদের অগ্রবর্তী প্রথম দলটি এলোমেলো হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে তা সম্মুখ-সমরে রূপ নেয়। এতে করে পাকবাহিনী অনেক সদস্যদকে এল.এম.জির বাট দিয়ে পিটিয়েও হত্যা করা হয়। এই আক্রমণে পাকবাহিনী ৫০ জন সৈন্য নিহত ও ৫৫ জন আহত হয়। পাকিস্তানিরা যে গতিতে যৌথবাহিনীর উপর আক্রমণ করেছিলো, তার চেয়ে বেশি গতিতে তাদের পশ্চাদপসরণে বাধ্য করা হয়। পাকবাহিনী তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে ৯ ডিসেম্বর বিকালে যৌথবাহিনীর অবস্থানের উপর আক্রমণ করে। কিন্তু সন্ধ্যার বেশ পূর্বেই ভারতীয় বিমান আশুগঞ্জ ও ভৈরবে পাকবাহিনীর অবস্থানের ওপর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় গোলান্দাজ বাহিনীও সক্রিয় হয়ে ওঠে। বিমানগুলি আশুগঞ্জ ও ভৈরবের পাকবাহিনীর লক্ষ্যবস্তুদের দফায় দফায় আক্রমণ চালায়। ভৈরবে যৌথবাহিনী নাপাম বোমাও নিক্ষেপ করে। সূর্যাস্তের পূর্বেই পাকিস্তানিদের আশুগঞ্জ সাফল্যের চরম খেসারত দিতে হয়। পাকবাহিনী ১০ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর থেকেই ভারি মর্টার ও কামানের সাহায্যে যৌথবাহিনীর অবস্থানের উপর লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ শুরু করে। গোলাবর্ষণের আড়ালে পাকবাহিনী আশুগঞ্জ ত্যাগ করে। ১০ ডিসেম্বর পাকবাহিনী আশুগঞ্জ ত্যাগ করার পর মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় নি। কারন, রাস্তার বিভিন্ন স্থানে মাইন পুঁতে রাখা হয়েছিল। ভারতীয় মাইন বিশেষজ্ঞগণ মাইন অপসারণের কাজে ব্যস্ত থাকেন। তখনও নদীর পশ্চিম দিকে ভৈরবে পাকবাহিনীর অবস্থান থেকে আশুগঞ্জের ওপর শেল নিক্ষেপ করা হয়। ১০ ডিসেম্বর সকাল বেলা সমস্ত রণাঙ্গনে জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে অসংখ্য লাশ। গলিত লাশের গন্ধে সমস্ত এলাকা এক নারকীয় রূপ ধারণ করে। ভারতীয় সৈন্যরা রণাঙ্গন হতে তাদের সহযোদ্ধারা লাশ উদ্ধার করে এক জায়গায় স্তূপ করতে থাকে। পরে ভারতীয় হেলিকপ্টার এসে তাদের লাশগুলো এবং আহতদেরকেও নিয়ে যায়। এই যুদ্ধে ভারতীয় চারজন সেনা কর্মকর্তা নিহত হন, তাদের মধ্যে ছিলেন বিহার রেজিমেন্টের মেজর টেটা সিং এবং ওড়িষ্যার মেজর টি.এল.শর্মা প্রমুখ।১১ ডিসেম্বর বিকাল, বেলায় মুক্তিযোদ্ধারা আশুগঞ্জে প্রবেশ করে। বাজারে সাধারণ মানুষজনের প্রবেশের ব্যাপারে মিত্র বাহিনী বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করে। ১১ ডিসেম্বর ভোরে পাকবাহিনীর গোলাবর্ষণের মধ্যে মেজর সুবিদ আলী ভূঁইয়া আশুগঞ্জ-ভৈরব রেললাইনের দক্ষিণ দিয়ে অগ্রসর হয়ে নদীর তীর ঘোষে চরচারতলায় অবস্থান নেন। ক্যাপ্টেন নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বে ডেলটা (‘ডি’) কোম্পানি আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিরাপত্তা দেয়াল পর্যন্ত মেঘ্নার কুল ঘেঁষে অবস্থান নেন। আর ভারতীয় বাহিনী আশুগঞ্জের মদ্ধাঞ্চলে অবস্থান গ্রহণ করে। ১১ ডিসেম্বর সকাল ১১ টায় পাকিস্তান সৈন্যরা মেঘনা সেতুর ভইরব দিকের একাংশ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়। প্রচণ্ড আওয়াজে সেতুর দুটি অংশ নদীতে পড়ে যায়। পাকবাহিনীর গোলাবর্ষণের তিব্রতায় সমগ্র এলাকা ধূয়াছন হয়ে পড়ে। এর কিছুক্ষণ পরই ভারতীয় বিমান বাহিনীর ভৈরবের উপর দু’দুবার আক্রমণ চালায়। এভাবে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ চলতে থাকে।১৫ ডিসেম্বর পাকবাহিনিকে আত্নসমর্পণের প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু তারা তা প্রত্যাখান করে। নিয়াজি ১৬ ডিসেম্বর বিকাল ৪টা ২১ মি আত্নসমর্পণ করেন। পাকবাহিনী আশুগঞ্জের প্রচুর অস্ত্রসস্ত্র গোলাবারুদ ফেলে যায়। লেবার অফিস মাঠে অত্যাধুনিক চাইনিজ ৫টি আর. সি. এল্গান, মেঘনা নদীর তীরে শামীম কোম্পানি বরাবর ২টি পাকিস্তানী ট্যাংক অক্ষত অবস্থায় ছিল। সাইলো গোদাউনে প্রবেশ পথে ৮টি বৃহৎ ভ্রমন-ট্রাক, ফোর্ড জিপ ৪টি, সাইলোর ভিতরে ৭/৮টি জিপ, কয়েকটি কক্ষভর্তি অস্ত্রসস্ত্র ও গোলাবারুদ,ওয়াপদা রোডে কলাবাগানের কাছে দুটি নতুন জিপ, ৫/৬টি সামরিক ট্রাক, স্টেনগান, শর্টগান, মেশিনগানসহ বহু সংখ্যক অস্ত্র গোলাবারুদ, বিভিন্ন স্থান থেকে লুট করে আনা দামি জিনিসপত্র। এই সকল জিনিসপত্র ওয়াপদা স্কুলে ভারতীয় বাহিনী কাম্পে রাখা হয়।
[৫৭৪] মোঃ আবু মূসা
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত