আবদুল আলী মালিক, ব্রিগেডিয়ার (২৩ ব্রিগেড)
মোহাম্মদ নেওয়াজ, লে. গোলান্দাজ অফিসার
ফজল করিম, লে. কর্নেল
আতাউল্লাহ খান, ক্যাপ্টেন
মোহাম্মদ নেওয়াজ, সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট (২৩ ব্রিগেড)
ইকরামুল হক, ক্যাপ্টেন (ইএসএস-৮১৪৪)
শাহিদ রেহমান, ক্যাপ্টেন (পিএসএস-৭৭৪৫)
ইকবাল শাহ, ক্যাপ্টেন (পিএসএস-৯৬১৪)
২৯ ক্যাভলরি। রংপুর।
অপরাধঃ মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে রংপুরে দায়িত্ব ছিল ২৩ ব্রিগেড, ২৯ ক্যাভলরি, ২৬ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স ও ২৩ ফিল্ড রেজিমেন্ট। এ সকল ইউনিটের ব্রিগেডিয়ার, কমান্ডার ও অন্যান্য পাক অফিসাররা রংপুর ও সৈয়দপুর অঞ্চলের সকল ধরনের নির্যাতন, হত্যা, ধ্বংস ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে। ২৩ ব্রিগেডের নেতৃত্ব দেয় ব্রিগেডিয়ার মালিক। ২৫ মার্চ দুপুর ১২টায় অপারেশন সার্চলাইটের কয়েকজন শীর্ষ স্থানীয় পরিকল্পনাকারী হেলিকাপ্টারযোগে রংপুরে এসে ব্রিগেডিয়ার মালিককে গণহত্যার নীলনকশার একটি সিল করা প্যাকেট প্রদান করে এবং রংপুরের গণহত্যা পরিচালনার দায়িত্ব দেন। ব্রিগেডিয়ার আবদুল মালিকের অধিনায়কত্ব, পরিচালনা ও নির্দেশে তাঁর অধীন পাক আর্মি অফিসাররা রংপুরেরে সকল হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে।
’৭১-এর দীর্ঘ নয় মাসে রংপুর জেলার লক্ষাধিক বাঙালীকে পাকবাহিনী ও তাঁদের দোসররা হত্যা করে। ১০ হাজার মা-বোন তাঁদের সম্ভ্রম হারান। ৫০-৭৫ হাজার বাড়িঘরে তারা অগ্নিসংযোগ করে ধ্বংস করে।
পাকবাহিনী রংপুরের নিশবেতগঞ্জের পুলের কাছে রাস্তার দক্ষিণ দিকে ১ এপ্রিল ১২ জনকে হত্যা করে। উত্তর দিক অপর একটি স্থানে ৫০ জনকে, সাতপাড়া ইউনিয়নে ৩২ জনকে, নাজিরহাটে ১৫০ জনকে জুমার নামাজের পর হত্যা করে। জাফরগঞ্জ পুলের নিকট ১০ জন এবং উলাপুর সেতুর কাছে বাঙালী ইপিআরসহ ৫০ জনকে হত্যা করে।
সাক্ষীঃ স্থানীয় অধিবাসী মেহেরউদ্দিন ও তার ছেলে এহসান উদ্দিন।
পাকবাহিনী সাহেবগঞ্জের মর্ডান সিনেমা হলের পেছনে ১ মে ১৯ জন বাঙালী সেনা অফিসার ও সৈনিককে রাত ১২ টার দিকে সেনানিবাস থেকে বের করে এখানে এনে হত্যা করে মাটিচাপা দেয়। ৩০ এপ্রিল কারমাইকেল কলেজের শিক্ষক রামকৃষ্ণ অধিকারী, কালাচাঁদ রায়সহ আরও অনেককে দমাদমা সেতুর নিচে নিয়ে হত্যা করে। প্রায় প্রতিদিনই এখানে বহু বাঙালীকে হত্যা করা হতো। এ ছাড়া রংপুর শহর ও সদরের নাবিরহাট, বৈরাগীগঞ্জ, দমদমা, হলদিপুকুর, মহিগঞ্জ, শ্মশানঘাট এবং দেবীপুর সহস্রাধিক লোককে এরা হত্যা করে।
রংপুরের উপশহর ব্যারকগুলোতে আর্মিদের বাঙ্কার মধ্যে ৩১৩ জন মহিলার লাশ পড়ে থাকতে দেখেন গাজী শাহ আলী সরকার। এদেরকে ক্যাম্পে আটকে রেখে দিনের পর দিন নির্যাতন করা হতো। শেষে নির্মমভাবে হত্যা করা হতো। এদের অনেকে যৌনাঙ্গ থেকে নাভি পর্যন্ত বেয়নেট দিয়ে ফেড়ে ফেলা হয়েছিল। শরীরের অন্যান্য অঙ্গও কাটা ছিল।
হামুদুর রহমান কমিশনের নিকট প্রদত্ত সাক্ষ্যে লে. কর্নেল আজিজ আহম্মদ খান জানান যে ব্রিগেডিয়ার মালিক হিন্দুদের হত্যা করার লিখিত নির্দেশ দিয়েছিল।
লে. কর্নেল ফজল করিম এখানকার কমান্ডিং অফিসার ছিল। তার নেতৃত্বেই এখানকার সকল গণহত্যা সংঘটিত হয়। ২৩ মার্চ একজন পাকিস্তানী সেনা অফিসারের হত্যাকে কেন্দ্র করে চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে তার নির্দেশে দা, ছুরি হাতে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণকারী বিক্ষুব্ধ জনতাকে প্রতিহত করতে নির্বিচারে পাকসেনারা হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, ঐদিন মৃত্যুর সংখ্যা ৫শ’র কম ছিল না।
পাকবাহিনীর ঘাঁটি ছিল স্থানীয় সরকারী স্কুল ভবন। স্বাধীনতার পর স্থানীয় সরকারি স্কুলের ৫০ নং কক্ষ থেকে শতছিন্ন শাড়ি পরা ২৫ জন মেয়েকে উদ্ধার করা হয়। অত্যাচার ও লাঞ্ছণায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন তাঁরা। স্থানীয় মাদ্রাসার শিক্ষক আঃ লতিফ তাঁর স্ত্রীকে পাকসেনাদের হাতে তুলে দিতে চাননি বলে তাঁকে হত্যা করা হয়। তাঁর স্ত্রীকে জোর করে ক্যাপ্টেন আতাউল্লাহর ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। যখন আমিনা খাতুনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় তখন তিনি গর্ভবতী ছিলেন। ধর্ষণে বাধা দিলে তাঁর তলপেটে লাথি মারে এক পাকিস্তানী সৈন্য। তীব্র যন্ত্রণায় মৃত একটি সন্তান প্রসব করেন তিনি। এরপর দীর্ঘ পাঁচ মাস ধরে ক্যাপ্টেন আতাউল্লাহ ও তার সহযোগীরা আমেনা খাতুনের ওপর অমানুষিক পাশবিক নির্যাতন চালায়।
২৯ ক্যাভলরির অন্তর্গত উপরোক্ত পাক ক্যাপ্টেন ও অন্যান্য সেনা অফিসার রংপুর, নওগাঁ ও ঠাকুরগাঁও অঞ্চলের সকল প্রকার নৃশংস গণহত্যা, নারী নির্যাতন ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মূল হোতা।
ব্রিগেডিয়ার আবদুল আলী মালিক ও তার সহযোগী অধনস্ত অন্যান্য পাকি অফিসারকে রংপুরে গণহত্যা, নারী নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত করার দায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করা যায়।
[১৪] ডা. এম. এ. হাসান
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত