আলাইপুরেরে যুদ্ধ, ঝিনাইদহ
১৪ অক্টোবর শৈলকুপার কুমার নদের দক্ষিণ তীরে আলাইপুরে ইউনিয়নের গাঙুটিয়া বাজারে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। পাকিস্তানী হানাদারদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞে নিহত হয় ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ তাদের ৪১ জন সহযোগী। এ সময় শৈলকুপার আলাইপুর ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের শক্ত ঘাঁটি। এই দখলের জন্য হানাদাররা বারবার আক্রমণাভিযান চালায়। কিন্তু প্রতিবারই মুক্তিযোদ্ধারা তাদেরকের প্রতিহত করে। প্রথমবার মাগুরা থেকে খানসেনারা এসে আক্রমণ ঘাঁটি করে বগুড়া গ্রামে। মুক্তিসেনাদের সঙ্গে তাদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয় এবং হানাদার বাহিনী পিছু হটে যায়। কিছু দিন পর শৈলকুপা থানা সদর থেকে গিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো হানাদার বাহিনী আলাইপুর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প আক্রমণ করে। পরিস্থিতি প্রতিকূল দেখে মুক্তিসেনারা অবস্থান থেকে সরে যায়। তারা কুমার নদের উত্তর পাড়ে আলফাপুরে অবস্থান নেয়। সেসময় পাকিস্তানী সেনাদের এক প্লাটুন সৈন্য আলাইপুর সংলগ্ন কুমার নদের দুই তীর জুরে প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু করে কিন্তু মুক্তিসেনাদের দুর্বার প্রতিরোধের সামনে টিকতে পারে না পাকিস্তানী সেনারা। এই যুদ্ধে ৩০/৩৫ জন হানাদার নিহত হয়। তারা প্রাণহানি দেখে পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। আবারও দখলে আসে আলাইপুর ক্যাম্প মুক্তিবাহিনীর। এ সময় কমান্ডার সোনা মোল্লার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি বৃদ্ধি করা হয়। এলাকা ভাগ করা হয় কয়েকটি প্লাটুনে। এসব প্লাটুন কমান্ডারদের মধ্যে শেখপাড়া গ্রামের নজরুল ছিলেন অন্যতম। আলফাপুরের পরাজয়ের গ্লানি ভুলতে না পেরে হানাদার বাহিনী বাহিনী সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। শৈলকুপার পূর্ব সীমান্ত মাগুরার শ্রীপুর ছিল এ সময় সম্পূর্ণরূপে আকবর বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। হানাদার বাহিনীর উপস্থিতি টেল পেলে একে অপরকে সংকেত দিতে সতর্ক করে দেবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। সোনা মোল্লার বাহিনী ও আকবর বাহিনী এ সময় লিয়াজো রক্ষা করে চলতে থাকে। কিন্তু ১৪ অক্টোবর আকবর বাহিনী মাগুরা থেকে আসা হানাদার বাহিনী সঙ্কেত দিতে ব্যর্থ হয়। তারা নিজেরা নিরাপদ স্থানে চল যায়। এদিকে রাতের আঁধারে শত শত পাকিস্তানী সেনা এসে ঘিরে ফেলে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প। ভোর চারটার দিকে খানসেনারা অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। আকস্মিক আক্রমণে মুক্তিসেনারা হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। ছুটে গিয়ে যে যার ব্যঙ্কারে আশ্রয় নেয়। প্লাটুন কমান্ডার নজরুলের নেতৃত্বে শুরু হয় মরণজয়ী যুদ্ধ। হানাদার বাহিনীর মর্টার, কামান ও ভারি অস্ত্রের মুখে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা পিছিয়ে আসে হামিদুর রহমানের যোগ্য উত্তরসুরি নজরুলসহ ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা এবং তাঁর ৪১ জন সহযোগী দেশের জন্য তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেন। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে গোলাগুলির পর হানাদার বাহিনী ও রাজাকার সদস্যরা স্থানীয় গ্রামগুলোর নারী-পুরুষ, কিশোর-কিশোরী, শিশু ও বৃদ্ধদের ওপর চালায় অকথ্য নির্যাতন। অগ্নিসংযোগ করে বহু ঘরবাড়িতে। অনেকের লাশ সেদিন কুমার নদ দিয়ে ভেসে গেছে। আলাইপুর ইউপি অফিসের পেছনে দুটি গণকবরে ৮ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ তেরজনকে গণকবর দেয়া হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হলেও আলাইপুরেরে যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক কোনো তালিকা তৈরি করা হয়নি। ফলে চরম অবহেলা, অযত্ন আর রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ার সেই সব অমর শহীদের গণকবর আজ বিলুপ্ত প্রায়। এই যুদ্ধে অগ্রসেনানী কমান্ডার সোনা মোলা, বিশারত ওস্তাদ ও মালেক মিয়ার কাছ থেকে ১৩ জন শহীদের নাম পাওয়া গেছে। বাকিদের নামের তালিকা উদ্ধার করা যায়নি। আলাইপুর যুদ্ধের সময় ১৩ জন শহীদের নাম: নজরুল ইসলাম, আবু তালেব, ইয়ারউদ্দিন, দিদার আলী, আবুল হোসেন, আবু সুফিয়ান, মধু শেখ, আলম উদ্দিন, ইউসুফ, এরামত আলী, আবু জাফর, শহীদুল ইসলাম এবং এফেল উদ্দিন। অন্যদের নাম এখন আর উদ্ধার করা এক অসম্ভব ব্যপার। ১৯৭৩ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য কাজী খাদেমুল ইসলাম (শিশু) নজরুলের কবর স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় পাকা করলেও আজ তা ভেঙে পড়েছে। ওয়াপদার পেছনের কবরটি রক্ষার্থে এতো বছরেও কেউ এগিয়ে আসেনি। এখনো স্থানীয় লোকজনে কবরগুলো শনাক্ত করতে পারেন না।
[১১] সংকলন
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত