You dont have javascript enabled! Please enable it! আতাউল গনি ওসমানী, এম, জেনারেল (১৯১৮-১৯৮৪) - সংগ্রামের নোটবুক

আতাউল গনি ওসমানী, এম, জেনারেল (১৯১৮-১৯৮৪)

মুহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী ১৯১৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বৃহত্তর সিলেটের সুনামগঞ্জে জন্মগ্রহণ করে। তাঁর পৈতৃক নিবাস বালাগঞ্জ উপজেলার দয়ামীরে। জেনারেল ওসমানীর পিতা খান বাহাদুর মফিজুর রহমান; মাতার নাম জোবেদা খাতুন।
১৯২৩ সাকে আসানাএর ডিব্রুগড়ে ওসমানীর শিক্ষা জীবন শুরু। গৃহশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। পারিবারিক রীতি অনুযায়ী তাঁকে আরবি পড়ানো শুরু করেন মাওলানা আবদুর রহমান বেগ এবং বাংলা ও ফার্সি শিক্ষার শুরু মায়ের কাছে।
১৯২৯ সালে আসামের কটন স্কুলে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ আরম্ভ হয়। ১৯৩২ সালের আসাম থেকে সিলেট সরকারী হাইস্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন ও ১৯৩৪ সালে তিনি প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। ম্যাট্রিক পাস করার পর তিনি আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ও আইএ ও ১৯৩২ সালে কলা বিভাগে বিএ পাস করার পর ভূগোলশাস্ত্রে এমএ (প্রিভিয়াস) পাঠ করেন। এমএ শেষ পর্ব পড়ার সময় তিনি পাবলিক সার্ভি পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হন কিন্তু ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে যোগদান না করেন ১৯৩৯ সালের জুলাই মাসে ব্রিটিশ ভারতের সেনাবাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন।
তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন ঐচ্ছিক বিষয় ইতিহাস ও ফার্সি নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় এসে নেন ইতিহাস, ফার্সি ও তর্কবিদ্যা। কিন্ত পরে কঠিন বোধ করায় ফার্সি ও তর্কবিদ্যা বদলে ভূগোল ও ইসলামের ইতিহাস বিষয়ে পড়াশোনা করেন; বিএ ক্লাসে নেন ভূগোল ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান। এমএ ক্লাসে ভূগোল নেয়ার কারণ সেনাবাহিনীতে যোগদানের ইচ্ছা।
১৯৩৯ সালের জুলাই মাসে ওসমানী ব্রিটিশ ভারতের সেনাবাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। সে সময় প্রতি বছর ৩০০ অফিসারের মধ্যে মাত্র ৩০ জন রিক্রুট হতে ভারত থেকে। সর্বভারতীয় এই ত্রিশের কোটা থেকেই তিনি নির্বাচিত হন সেনাবাহিনীতে। এখানে উল্লেখ্য যে, আইএ শেষ বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন অবস্থায় তিনি বিশ্ববিদ্যালয় অফিসার্স ট্রেনিং কোরের (UOTC) সদস্য হন এবং সামরিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। বিএ পড়ার সময় তিনি সার্জেন্ট পদে উন্নীত হন, এ সময়ই তিনি সামরিক বাহিনীতে যোগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
১৯৪০ সালের ৫ অক্টোবর তিনি ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমি দেরাদুন হতে সামরিক শিক্ষা সমাপ্তি করে ব্রিটিশ ইন্ডীয়ান ‘আর্মি সার্ভিস কোর’ বিভাগে কমিশন লাভ করেন।
তারপর দ্রুত পদোন্নতি লাভ করে ১৯৪১-এর ফেব্রুয়ারী মাসে ক্যাপ্টেন এবং ৪২-এর ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সর্বকনিষ্ঠ মেজর হন। ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে তিনি পাকিস্তানে আসেন এবং ঐ দিনই তাঁকে লে. কর্নেল পদে উন্নীত করা হয়। এর কিছুকার পর তিনি কোয়েটা স্টাফ কলেজে ১৯৪৮ সালের স্টাফ কোর্সে যোগদান করেন এবং পিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৫১ হতে ৫৫ সালের মধ্যে তিনি খুলনা, যশোর, ঢাকা ও চট্টগ্রামের স্টেশন কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৪ সালের তদানীস্তন ইপিআর-এর অতিরিক্ত কমান্ড্যান্ট (বর্তমান ডেপুটি ডাইরেক্টর জেনারেল) হিসেবে পূর্ববাংলা সরকারের অধীনে তাঁকে বহাল করা হয়। বাঙালী সৈনিকদের ওপর পশ্চিমাদের অবিচারের প্রতিবিধান করতে চাইলে তাঁকে কর্তৃপক্ষ টেলিগ্রাম আদেশের মাধ্যমে বদলি করেন।
১৯৫৬ সালে তিনি মিলিটারি অপারেশন ডেপুটি ডাইরেক্টর পদে এবং ১৯৫৭ সালে তিনি কর্নেল পদে উন্নীত হন।
১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে কর্নেল ওসমানী ডেপুটি ডাইরেক্টর অব মিলিটারি অপারেশনসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। চাকরি জীবনের শেষের দিকে তিনি সেনাবাহিনীর ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন।
১৬ মে, ১৯৬৬ সালের কর্নেল ওসমানী অবসরের প্রাক্কালে ছুটি নেন এবং ১৯৬৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
ষাটের দশকের গোড়ার দিকে যুক্তরাজযে ছুটি কাটানোর সময় লন্ডনে বসবাসরত প্রবাসী বাঙালী নেতা জনাব আব্দুল মান্নান আওয়ামী লীগ তথা সোহরাওয়ার্দী এবং শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে কর্নেল ওসমানীকে চাকরি থেকে অবসর নিয়ে রাজনীতিতে যোগদানের আহ্বান জানান। কর্নেল এর জবাবে জানিয়েছিলেনঃ আমি আমার বাঙালি জাতির স্বার্থে আমাদের ন্যায্য পাওনা ও অধিকার আদায়ের জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকরিরত রয়েছি।
১৯৬৯ সালে কারাগার থেকে বের হবার পর শেখ মুজিব লোক মারফত তাঁর সাথে যোগাযোগ করেন এবং রাজনীতিতে যোগদানের অনুরোধ জানান, সশস্ত্র বাহিনীর জুনিয়র বাঙালি অফিসারদের অনুরোধ ও আত্মীয়-স্বজনদের চাপে ১৯৭০ সালের জুলাই মাসের মাঝামাঝি তিনি রাজনীতি (তাঁর ভাষায় গণনীতি) ও আওয়ামী লীগ যোগদান করেন।
’৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে ওসমানী আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সিলেটের ৪টি থানা (বালাগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, গোপালগঞ্জ ও বিশ্বনাথ) সমন্বয়ে গঠিত পাকিস্তানের বৃহত্তম নির্বাচনী এলাকা থেকে তাঁর চারজন প্রতিদ্বন্দ্বীকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের একজন সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন।
১৯৭১ সালের ২৫ এবং ২৬ মার্চের মধ্যবর্তী রাতে পাকিস্তানি কমান্ডোদের একটি কোম্পানি বনানীতে ওসমানী যে বাড়িতে থাকতেন তার ওপর আক্রমণ করে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে তিনি রক্ষা পান।
ছদ্মবেশে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে কুমিল্লা সীমান্তে সালদা নদীর অববাহিকায় পৌঁছে বিক্ষিপ্তভাবে যুদ্ধরত বাঙালী যোদ্ধাদের সংগঠিত করেন।
এপ্রিল মাসে প্রথম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন হলে ওসমানী Active List- এ আহূত হন এবং সরকার তাঁকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করে ১২ এপ্রিল হতে মন্ত্রীর মর্যাদাসহ বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সেনাপতি নিযুক্ত করেন।
সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করে তিনি যুদ্ধরত শত্রুর বিরুদ্ধে একটি নিয়মিত সেনাবাহিনী ও একটি গেরিলা (গণবাহিনী) গড়ে তোলেন। সীমিত শক্তি নিয়ে চরম বিপর্যয়ের মোকাবিলায় অসম সাহস ও অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি একটি সুশিক্ষিত ও সুসজ্জিত শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে মাত্র নয় মাসে সশস্ত্র যুদ্ধকে বিজয়ের দিকে নিয়ে যান।
১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হবার পর জাতির প্রতি তাঁর চরম ত্যাগ ও মহান সেবার স্বীকৃতিস্বরূপ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মেজর জেনারেল এমএজি ওসমানী পিএসসিকে জেনারেল পদ উন্নীত করেন এবং ১৬ ডিসেম্বর ৭১ থেকে তা কার্যকর হয়।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকারের জাহাজ চলাচল, অভ্যন্তরীণ নৌ ও বিমান চলাচল মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে তাঁকে পূর্বের দায়িত্ব ছাড়াও ডাক, তার, টেলিফোন ও যোগাযোগে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনীয় মাধ্যমে একদলীয় (বাকশাল) রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার চালু হলে তিনি এ প্রক্রিয়ায় বিরোধিতা করে আওয়ামী লীগ ও সংসদ সদসয থেকে পদত্যাগ করেন। ২৯ আগস্ট (১৯৭৫) দেশে সামরিক শাসন চলাকালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদের আমন্ত্রণে রাষ্ট্রপতির প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ৩ নভেম্বর পদত্যাগ করেন। ১৯৭৬-এ তিনি জাতীয় জনতা পার্টি নামে একটি দল গঠন করেন।
তিনি ১৯৭৮ ও ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং পরাজয় বরণ করেন।
জেনারেল ওসমানী একজন সুদক্ষ সেনানায়ক ছিলেন। বেঙ্গল রেজিমেন্ট গড়ে তোলার ব্যপারে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। এ জন্য তাঁকে ‘ফাদার অব দি বেঙ্গল রেজিমেন্ট’ আখ্যায় ভূষিত করা হয়। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন।
তিনি ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রবাসে (লন্ডনে) ১৯৮৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী মৃত্যুবরণ করেন
[৮৩,১৪৩] সংকলন

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত