আটগ্রামের যুদ্ধ, জকিগঞ্জ, সিলেট
আটগ্রামের যুদ্ধ সিলেট রণাঙ্গনের অন্যতম ভয়াবহ যুদ্ধ। এখানে মুক্তিবাহিনী (নিয়মিত ও অনিয়মিত) ও মিত্রবাহিনী একযোগে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এলাকা মুক্ত করে। বস্তুত আটগ্রামের যুদ্ধই সিলেট সেক্টরে প্রথম সর্বাত্মক যুদ্ধ। ২২ নভেম্বর আটগ্রাম মুক্ত হলে সিলেট শহর অগ্রাভিযান বেগবান হয় ও অভিযানে নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়। আটগ্রাম সিলেট জেলার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত জকিগঞ্জ থানার একটি সীমান্তবর্তী গ্রাম। সীমান্তবর্তী জকিগঞ্জ ও আটগ্রাম অবস্থান থেকে পাকিস্তানিরা চরদের মাধ্যমে ভারতীয় রেললাইনে মাইন পুঁতে রাখত। ফলে ভারতীয় রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত এবং রেলগাড়িতে হতাহতের সংবাদ আসে। যেসব এলাকায় এই জাতীয় ঘটনা ঘটে সেগুলো ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই অবস্থার প্রেক্ষিতে ৪ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর সিআর দত্ত আটগ্রাম দখলের পরিকল্পনা করেন। বাংলাদেশ ও ভারত যৌথ বাহিনীর সিদ্ধান্তে ৪ নং সেক্টর ট্রুপস যৌথ বাহিনীর আটগ্রাম-চারখাই-সিলেট অক্ষে ও আটগ্রাম-কানাইঘাট-দরবস্ত-সিলেট অগ্রাভিযানের সুবিধার্তে আটগ্রাম আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ৯ নভেম্বর আটগ্রাম অবরোধ অভিযান শুরু হয়। ৯ নভেম্বর সন্ধ্যা প্রায় সমাগত। পশ্চিম দিগন্তে লাল আভা ছড়িয়ে ক্রমশ সূর্যটা ডুবে গেল। ঘনিয়ে এলো রাতের অন্ধকার। সুরমা নদীর তীরে অপেক্ষামাণ লেফটেন্যান্ট জহিরের নেতৃত্ব দুই কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা রাতের অন্ধকারে নদী অতিক্রম করে আটগ্রাম অভিমুখে যাত্রা শুরু করল। নিঃশব্দে মুক্তিযোদ্ধারা চারগ্রাম ও দর্পণনগর গ্রামের সন্নিকটে সুরমা নদী অতিক্রম করে পাকিস্তানী সৈন্যদের অগ্রবর্তী ঘাঁটি পাশে রেখে এবং মূল ঘাঁটির সামনে রাস্তার দু’পাশে অবস্থান নিয়ে চরম আঘাত হানার জন্য ওৎ পেতে রইল। অপর দিকে লেফটেন্যান্ট গিয়াস এক কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধাসহ শত্রু অধিকৃত আটগ্রাম-জকিগঞ্জ সড়ক মুক্র করার জন্য অগ্রসর হন। লেফটেন্যান্ট গিয়াস কামালপুরে অবস্থান গ্রহণকালে (রাত এগারটা) শত্রুর সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। তবে আধঘন্টা মধ্যে কামালপুর স্থান শত্রুমুক্ত হয়। ক্যাপ্টেন রব এক কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ১০ নভেম্বর ভোরে গোটাগ্রামে অবস্থান নিলেন। এখানে রাজাকারের একটি ক্যাম্প ছিল। প্রা ১০/১২ জন রাজাকার তখন ঘুমাচ্ছিল। ক্যাপ্টেন রবের অতর্কিত হামলার মুখে এরা সবাই আত্মসমর্পণ করে। একজন রাজাকার কোনোমতে পালিয়ে গিয়ে আটগ্রামে অবস্থানরত পাকিস্তানী সৈন্যদের খবর দিতে সক্ষম হয়। ক্যাপ্টেন রবের নির্দেশে রাস্তার দু’পাশে দ্রুত বাঙ্কার খুঁড়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের সংবাদ পেয়ে শত্রুর একটি প্লাটুন গোটাগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। এদিকে শত্রুরা কামালপুর ও দর্পনগরে (মুক্তিবাহিনী প্রতিবন্ধক অবস্থান) সৈন্য পাঠায়। ১০ নভেম্বর সন্ধ্যায় আটগ্রামের পাকিস্তানী বাহিনী সিলেট থেকে কিছু রি-ইনফোর্সমেন্ট পায়। তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসে একটি আর্টিলারি ব্যাটারী (১০৫ মি. মি. হাওয়ার্টজার)। ১০ নভেম্বর সন্ধ্যায় শত্রুবাহিনি গোটাগ্রামের (বিকাল পাঁচটা) দিকে অগ্রসর হয়। তখন তাদের সাথে বেশ কিছু বেসামরিক লোকজন ছিল। শত্রুবাহিনী মুক্তিবাহিনীর রেঞ্জের ভেতর এলে মুক্তিবাহিনী ফায়ার শুরু করে। গুলি শুরু হলে বেসামরিক ব্যক্তিরা পালিয়ে যায় কিন্তু পাকিস্তান বাহিনী আর্টিলারির সহযোগিতায় ব্যাপকভাবে আক্রমণ করে। শত্রুরা আক্রমণের মুখে মুক্তিবাহিনী নিজ অবস্থান থেকে শত্রুর মোকাবেলা করতে থাকে। রাত আটটার দিকে ক্যাপ্টেন রব- এর কোম্পানির গোলাবারুদ ফুরিয়ে আসে। গোলাবারুদের সরবরাহ সম্ভব ছিল না। এই পরিস্থিতিতে ক্যাপ্টেন রব গোটাগ্রাম অবস্থান থেকে পশ্চাৎপসরণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এভাবেই লজিস্টিক সাপোর্টের অভাবের আটগ্রাম অবরোধ ব্যররথ হয়। প্রথম পর্যায়ে অবরোধ ব্যর্থ হলে মুক্তিবাহিনী প্রথাগত আক্রমণের মাধ্যমে আটগ্রামে দখলের সিদ্ধান্ত নেন। ২১ নভেম্বর রাতে যৌথ বাহিনী দখলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এখানে উল্লেখ্য যে আটগ্রাম অবরোধ অভিযানের পর আটগ্রাম দখলের দায়িত্ব ভারতীয় বাহিনী ও জেড ফোর্সকে দেয়া হয়। চুড়ান্ত আক্রমণের তারিখ ২০/২১ নভেম্বর নির্ধারণ করা হয়। এর পুর্বের দিন ঈদ থাকায় পাকিস্তানিরা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। আটগ্রাম আক্রমণের জন্য ভারতীয় বাহিনীর ৪/৫ গুর্খা ও জেড ফোর্সের ১ ইস্ট বেঙ্গলের একটি কোম্পানিকে দায়িত্ব দেয়া হয়। মধ্যরাতে সর্বাধুনিক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে ভারতীয় বাহিনী আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করে। মিত্রবাহিনির ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানি রবার ডিঙ্গি দিয়ে আক্রমণকারী সৈন্যদের পারাপার করে। আর্তিলারির সাহায্য নিয়ে শেষ রাতে ৪/৫ গুর্খা ব্যাটালিয়ন আটগ্রাম এলাকায় শক্তিশালী পাক ঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালায় এবং কয়েক ঘন্টা প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে আতগ্রাম দখল করে। শত্রুবাহিনীর কমান্ডার একজন মেজরসহ প্রায় সকলেই হতাহত হয়। গুর্খা ব্যাটালিয়নের মেজর বিক্রম, ৬ জন সেকেন্ডে লেফটেন্যান্টসহ বেশ কয়েকজন নিহত হন। এদিকে ভারতীয় বাহিনীর গার্ড ব্যাটালিয় ট্যাংক ও আর্টিলারির সহযোগিতায় ২০/২১ নভেম্বর মধ্যরাতে আক্রমণ করে এবং ২১ নভেম্বর দুপুর এক্তায় জকিগঞ্জ শত্রুমুক্ত হয়। ক্যাপ্টেন রব এবং লেফটেন্যান্ট জহিরকে তাদের কোম্পানি নিয়ে সুরমা নদীর অপর পাড়ে সালাম টিলা এবং রাজ তিলা আক্রমণের নির্দেশ দেয়া হয়। মুক্তিবাহিনীর এই আক্রমণে পাকিস্তান বাহিনীর ব্যাপকভাবে ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং সালাম টিলা ও রাজ টিলা মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। ২১ নভেম্বর বিকালে ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে ১ ইস্ট বেঙ্গলের ব্রাভো কোম্পানি আটগ্রামের কাছে চারগ্রাম ইন্সপেকশন বাংলো আক্রমণ করেন। ২২ নভেম্বর ভোরে ১ ইস্ট বেঙ্গলের কোম্পানিটি চারগ্রাম ডাকবাংলো দখল করে। উক্ত কাম্পে প্যারা মিলিটারী বাহিনী থল স্টাউটের ২০ জন সৈনিক মুক্তিবাহিনীর হাতে বন্দি হয়। আহত হয় ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা। এখানে উল্লেখ্য যে, চারগ্রাম বাংলো দখল করার দায়িত্ব ৪/৫ গুর্খা ব্যাটালিয়নের ছিল কিন্তু আটগ্রামে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণে মিত্রবাহিনীর কমান্ডার বিগ্রেডিয়ার ওয়ার্টকে জেড ফোর্স কমান্ডারকে চারগ্রাম দখলের অনুরোধ করেন। যুদ্ধের ফলাফল এই যুদ্ধে আটগ্রামে অবস্থিত পাকিস্তানী বাহিনী ধ্বংস হয়। যুদ্ধের ফলে সিমান্তবর্তী দুইটি ঘাঁটি জকিগঞ্জ ও আটগ্রাম মুক্ত হয়। আটগ্রাম পতনের পর সুরমা নদীর পশ্চিম দিক মুক্তিবাহিনীর অবস্থান সুসংহত হয় এবং সিলেটের দিকে অগ্রাভিযান সহজতর হয়,
[৫৫] সংকলন
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত