আখাউড়ার যুদ্ধ, ব্রাক্ষণবাড়িয়া
ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলায় যে কয়েকটি বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল আখাউড়ার মুক্তিযুদ্ধ। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকবাহিনী ব্রাক্ষণবাড়িয়া থেকে পিছু হঠতে শুরু করে। এই যুদ্ধটি সংঘটিত হয় নভেম্বর মাসের শেষদিকে, ৩নং সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল কাজী মোহাম্মদ (কে.এম) সফিউল্লাহ আখাউড়া শত্রুমুক্ত করার একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। সে সময় আখাউড়া অবস্থান করছিল পাকবাহিনী ৩৩ বেলুচ রেজিমেন্ট, ৪৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, ২১ আজাদ কাশ্মীর রিজার্ভ ফোর্স (এ.কে.আর.এফ); যার অধিনায়ক ছিলেন লে. কর্নেল জায়দি। লে. কর্নেল কে. এম. সফিউল্লাহ এ পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে তিনটি পর্যায় ভাগ করেন। প্রথম পর্যায় হল, মনতলা এবং হরষপুর থেকে পাকবাহিনী যে সিলেটের দিকে পালিয়ে যেতে কিংবা সিলেট থেকে অতিরিক্ত সৈন্য যাতে তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসতে না পারে। এ কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় ১১ তম ইস্ট বেঙ্গলকে; যার দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন নাসিম। দ্বিতীয় পর্যায় হলো, উত্তরে সিঙ্গারবিল থেকে দক্ষিণে আখাউড়া পর্যন্ত শত্রুমুক্ত করা। ২য় ইস্ট বেঙ্গলকে এ দায়িত্ব দেয়া হয়। এ ব্যাটালিয়নের নেতৃত্ব যারা ছিলেন, তাঁরা হলে ব্যাটালিয়ান কমন্ডার মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী এবং কোম্পানি কমান্ডারদের মধ্যে ছিলেন এ কোম্পানি মেজর মতিয়র রহমান, বি কোম্পানী লে. বদিউজ্জামান, সি কোম্পানি লে. ইব্রাহিম, ডি কোম্পানি লে. মোরশেদ। তৃতীয় পর্যায় হল, ৩ নং সেক্টর থেকে দুই কোম্পানি সৈন্য নিয়ে আখাউড়ার পূর্ব দিকে আগরতলা বিমানবন্দরের উত্তর পশ্চিমে পরিখা খনন করে অবস্থান নেয়া। আর এই দুই কোম্পানির দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন মতিন ও লে. সাদেক। মুক্তিযোদ্ধারা ৩০শে নভেম্বরের মধ্যে যুদ্ধের আনুষাঙ্গিক সকল প্রকার কার্যক্রম সম্পন্ন করেন। মেজর নাসিম উত্তর দিকে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে মুকুন্দপুর, হরষপুর এবং মনতলা এলাকা তাঁর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন, এতে সীমান্ত এলাকার সড়ক এবং রেলপথ পাকবাহিনীর জন্য রুদ্ধ হয়ে যায়। পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ পরিচালনয়ার জন্য সময় নির্ধারণ করা হয় ১লা ডিসেম্বর রাত ১টা। নির্দিষ্ট সময় আক্রমণ শুরু করে উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে তা সকাল ৬টায় শেষ হয়। মেজর মঈনের ব্যাটালিয়ান আজমপুর রেল স্টেশনের উত্তরাঞ্চল থেকে পাকবাহিনিকে বিতাড়িত করে সেখানে শক্তিশালী ঘাঁটি স্থাপন করেন। এই যুদ্ধে পাকবাহিনীর একজন সৈন্য বন্দি হয় এবং নিহত হয় ২০ জন। ইয়াসিন খাঁ নামক মুক্তিফৌজের একজন সদস্য শহীদ হন আহত হন সিপাহি আবু জাফর, সিপাহি হুমায়ূন, সিপাহি আব্দুল লতিফ, হাবিলদার আক্তার হোসেন, হাবিলদার মুফাজ্জল হোসেন চৌধুরী, হাবিলদার নবীউল্লা প্রমুখ। পাকবাহিনী অতিরিক্ত শক্তি বৃদ্ধি করে ২রা ডিসেম্বর বেদখল হয়ে যাওয়া আজমপুর পুনরুদ্ধারের জন্য মুক্তিবাহিনী ওপর ২রা ডিসেম্বর সকালে পাল্টা আক্রমণ শুরু করে এবং দিনভর খণ্ড যুদ্ধ চলতে থাকে। পাকবাহিনী প্রবল আক্রমণের মুখে মুক্তিবাহিনী পিছু হটে সিঙ্গারবিলে জমায়েত হতে থাএ। আর্টিলারির সহায়তায় মারত্মক আক্রমণ চালিয়ে আজমপুর পুনর্দখল করা হয়। ফলে আজমপুর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। এই যুদ্ধে পাকবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি হয় অপূরণীয়। মুক্তিবাহিনী নায়েব সুবেদার আশরাফ শহীদ হন আর সিপাহি আব্দুল আওয়াল, হাবিলদার মাজু মিয়া, নায়েব সুবেদার আবসু সালাম, সিপাহি মিজানুর রহমান আহত হন। ৩রা ডিসেম্বর সকাল বেলা মুক্তিবাহিনী পাকবাহিনীর ওপরে হামলা পরিচালনা করে। ২রা ডিসেম্বর বেদখল হয়ে যাওয়া আজমপুর পুনরায় দখল করার জন্য উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গোলাগুলি হয়। এই অভিযানে মুক্তিবাহিনী গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় গোলাবর্ষণ করে। তারপরও মুক্তিবাহিনী তাদের সাহসিকতা দিয়ে আজমপুর রেলস্টেশন ও আখাউড়ার কিছু অংশ দখল করে নেন। এই যুদ্ধে পাকবাহিনী ১১ জন সৈন্য নিহত এবং অনেক আহত হয়। মুক্তিবাহিনী ২জন সৈন্য শহীদ এবং কিছু সংখ্যক আহত হন। দেশের অভ্যন্তরে অবিরাম গেরিলা মুক্তবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন বেসামাল হয়ে পড়েছিলো; তখন তারা সমস্ত দোষ ভারতের ওপর চাপিয়ে ৩ ডিসেম্বর ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে বিমান হামলা চালায়। ৩ ডিসেম্বর বিকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতায় এক বিশাল জনসভায় বক্তৃতায় ভারতের যুবকদের পাকিস্তানী হামলা প্রতিহত করার হুকুম দেন। ফলে ৪ঠা ডিসেম্বর জেনারেল আখাউড়ার আসে। ভারতীয় বাহিনী মিত্রবাহিনী নাম ধারণ করে এস ফোর্সের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় বাহিনী আখাউড়াকে দক্ষিণ ও পশ্চিমাংশ দিয়ে অবরোধ করে। এই অবরোধের মধ্য দিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর শহীদ হন লে. বদিউজ্জামান, সিপাহি রুহুল আমিন, সিপাহি সিদ্দিকুর রহমান। আহত হন সুবেদার চান মিয়া, হাবিলদার কামরুজ্জামান, কোম্পানি হাবিলদার মেজর নূরুজ্জমান প্রমুখ। পাকবাহিনী ১৩ জন মৃত ও ৪ জন বন্দী হয় এবং আহত হয় অনেক। অবশেষে ৫ই ডিসেম্বর পাকবাহিনী ওয যৌথবাহিনীর মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে পাকবাহিনী প্রায় ১৬০ জন মারা যায় এবং আহত হয় অনেকে। মুক্তবাহিনী যে ৬ জন শহীদ হন তারা হলেন, নাকেয়ক সুবেদার আশরাফ আলী খান, সিপাহি আমির হোসেন, সিপাহি শাহাব উদ্দিন, সিপাহি রুহুল আমিন, মুস্তাফিজুর রহমান এবং আহত হন সুবেদার চান মিয়া, হাবিলদার কামরুজ্জামান, কোম্পনাই হাবিলদার মেজর নূরুজ্জামান প্রমুখ। শেষ পর্যন্ত পাকবাহিনী অনেক ক্ষয়ক্ষতির পর চার ব্রিগেড সৈন্য নিয়ে যৌথবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে আখাউড়া যুদ্ধের গুরুত্ব ছিলো অপরিসীম। এখানকার যুদ্ধে উভয় পক্ষেই সর্বাধিক সংখ্যক আর্টিলারি ব্যবহার করেছে। বলাবাহুল্য, আখাউড়া পতনের পর পাকবাহিনী ব্রাক্ষণবাড়ীয়া হয়ে আশুগঞ্জ ও ভৈরব এসে জড়ো হয়।
[৫৭৪] মোঃ আবু মুসা
সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত