You dont have javascript enabled! Please enable it!

আগ্রাবাদ হোটেল অপারেশন, চট্টগ্রাম

প্রয়োজনীয় রেকি শেষ করেছে। ওরা বসেছে দলীয় অধিনায়কের সামনে। সুবোধ বালকের মতো। একান্ত মনোযোগী হয়ে শুনছে অধিনায়কের আদেস-নির্দেশ। হারিকেনের মিট মিট আলোয় ওরা ক’জন বিপ্লবী। সামনে আধা ভাঙ্গা একটি টেবিল। বর্ণনা দিচ্ছেন একজন কি করে গত তিনদিন হানাদার বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে হোটে আগ্রাবাদের সব গোপন তথ্য ও পাকসৈনিকদের অবস্থান বের করে আনলেন। কখনও মৌলবীর বেশে, কখনো পত্রিকার হকার হয়ে আবার কখনো বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীর বেশে। ডাঃ জাফর উল্লাহ বোরহান, ডাঃ সাইফুদ্দিন, ফয়েজুর রহমান, গরীব উল্লাহ, শফি (মুন্সী) সহ মুক্তির সৈনিকরা একান্ত অনুগত শিষ্যের মতো দল নেতাকে হোটেল আগ্রাবাদের অবস্থান জানালেন। দলীয় অধিনায়ক ভাবছেন কি করে অপারেশন সফল করা যায়। পাকসৈনিকরা হোটেল আগ্রাবাদকে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে এসেছে। তাদের রক্ষা ব্যুহ ভেদ করে ভিতরে আঘাত হানা অসম্ভব। চিন্তার রেখা সকলের মাঝে। সময় বেশি নেই। হাইকমান্ড থেকে নির্দেশ এসেছে হোটেল আগ্রাবাদ অপারেশন করতেই হবে। কারণ পাকসরকার রেডিও-টেলিভিশনে প্রচার করছে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা স্বাভাবিক। বিশেষ করে জাতিসংঘ তাদের দূত পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থান সম্পূর্ণ স্বাভাবিক বলে প্রচার করছে। পাকপ্রতিনিধির কথার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য এসেছে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক বাহিনী। তাদের একটি দল এসেছে চট্টগ্রামে। উঠেছে হোটেল আগ্রাবাদে। তাদের আগমনে পাকসৈনিক ও তাদের দোসররা হোটেল আগ্রাবাদসহ পুরো চট্টগ্রামের নিরাপত্তা জোরদার করেছে। অধিনায়ক টেবিলের উপর রাখা কাগজে রেকির বিবরণ চিত্র দেখছেন। অবশেষে আগ্রাবাদ হোটেলের উত্তর পূর্ব কোণের একটি স্থান কলম ঠেকালেন। তিনি সামনে উপবিষ্ট অন্যান্য সতীর্থগদের বললেন, ‘পুরো এলাকায় পাকসৈনিকদের কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী রয়েছে কিন্তু ঐ অংশে তুলনামূলকভাবে কম। কারণ এই অংশে রয়েছে একটি বিদ্যুৎ ট্রান্সফরমার। এ ট্রান্সফরমারই হচ্ছে হোটেল আগ্রাবাদের প্রাণ। এটার উপর হোটেল আগ্রাবাদের বিদ্যুৎ নির্ভর করছে। এ ছাড়াও এ-পথ দিয়ে তেমন কেউ চলাচল করে না। তাই কর্তৃপক্ষ ও পাকসৈনিকরা এ-পথের তেমন গুরুত্ব দেয়নি। তবুও প্রতিদিন পাকসেনারা ও স্থানীয় একজন ট্রান্সফরমারটি পাহারা দিয়ে থাকে। হোটেল আগ্রাবাদের অন্যান্য অংশের তুলনায় নিরপত্তা বেষ্টনী এ অংশে একেবারে দুর্বল। মুক্তিযোদ্ধারা ভাবলেন এ স্থানটিই হবে অপারেশনের জন্য উত্তম। সিদ্ধান্ত হল শুধু মাত্র ঐ ট্রান্সফরমারটিকে উড়িয়ে দিতে হবে এবং রক্তপাত পরিহারে সচেষ্ট থাকতে হবে। একদিন কেটে গেল। সংগ্রহ করা হয় প্রয়োজনীয় বিস্ফোরক ও অস্ত্র। বিভিন্নভাবে গোলাবারুদ পৌঁছে গেল মোগলটুলী কবির তোরণ মাতব্বর বাড়ির মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন আশ্রয়ে। বাড়িটির বৈশিষ্ট্য ভিন্ন। বাড়িটির মুখে রয়েছে কবির তোরণ নামের একটি বিরাট গেইট। দু’পাশে বড় বড় দু’টি কবরস্থান। দু’কবরস্থান মাঝ দিয়ে চলে গেছে একটি রাস্তা। গেইট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকলে অনেকগুলো আঁকাবাঁকা গলি। ভিতরে অনেকগুলো ঘর। সেখানের একটি ঘরে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়কেন্দ্র। আশ্রয়কেন্দ্রের পেছনে রয়েছে একটি পানা ভর্তি ডোবা ও পাড় জংলায় ভরা। এমনি একটি বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা গোপন ঘাঁটি স্থাপন করেছে। কোন অপরিচিত ব্যক্তির পক্ষে এ শেল্টারের খোঁজ পাওয়া কষ্টকর। বিশেষ করে এ বাড়ির মহিলা-পুরুষ সবাই মুক্তির সৈনিক। তাদের মনোবল, সাহস ও স্বাধীনতার প্রতি অকৃত্রিম একাগ্রতা ছিল বিস্ময়ের ব্যাপার। অর্থাৎ নিরাপত্তার ব্যাপারে এ আস্তানা বেশ ভাল। ইতিমধ্যে পবিত্র মাহে রমজান এসে গেছে। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা শত দুঃখ কষ্টের মধ্যেও সিয়াম সাধনায় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন। এরি মধ্যে অপারেশনের ক্ষণ ঠিক হয়ে হলে। বুদ্ধিবিবেক ও বাস্তব অবস্তান প্রেক্ষিতে অপারেশন সম্পন্ন করতে হবে। অপারেশন শেষ করে সবাই চলে যাবে পূর্ব মাদারবাড়ি শেল্টারে দ্বিতীয় রমজান। মোগলটুলীর গোপন শেল্টার তখনও মুক্তির সৈনিকরা অপারেশন আয়োজনে ব্যস্ত। দলীয় অধিনায়ক ডাঃ মাহফুজুর রহমানসহ অপারেশনে অংশগ্রহণকারী সকল যোদ্ধা এসে গেছে। প্রত্যেকের সাথে দলীয় অধিনায়ক আলিঙ্গন করলেন। ক্ষীণ স্বরে ‘জয় বাংলা’ বলে মাটি তুলে নিলেন হাতে। ঘড়ির কাঁটা ঠিক আটটার ঘর ছুঁয়েছে। মোগলটুলী শেল্টার থেকে হোটেল আগ্রাবাদের দূরত্ব অতি অল্প। পাড়ার অলিগলি দিয়ে তারা এসে গেল হোটেল আগ্রাবাদের উত্তর পূর্ব কোণের ট্রাস্নফরমারের প্রায় নিকটে। সামনের বাড়িটি সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। এ বাড়ির উপর দিয়ে যেতে হবে। বাড়ির মালিক ঈশা খান। তিনি গরীব উল্লাহ ও সফিকে চেনেন। দেখে ফেললে সমস্যা হতে পারে। সুকৌশলে দেয়াল ঘেঁষে ঘেঁষে একে একে পার হয়ে বাড়ির পেছনে এলেন। সেখান থেকে বাড়ির অংশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। জায়গাটি ভীষণ অন্ধকার। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশেষ সুবিধে হল। উত্তর পূর্বকোণের ট্রান্সফরমারটিও দেখা যাচ্ছে। ট্রান্সফরমারের পাশে একটি ছোট গেইট। গেইটের ভিতরে দু’জন প্রহরী বসে কথা বলছে। তাদের স্টেন ও রাইফেল একপাশে রেখে দিয়েছে। অন্ধকয়ারে দাঁড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের কাজ ঠিক করে ফেলল। কে কি করবে? দ্রুত নিঃশব্দে পা চালিয়ে ওরা এলেন ট্রান্সফরমারের গেইটে। নিরাপত্তা প্রহরী দ’জন তখনও গভীর আলোচনায় ব্যস্ত। আচমকা মুক্তির সৈনিকরা লাফিয়ে পড়ল তাদের সামনে। কেউ কিছু বুঝার আগেই তাদের বুকে রিভলবার চেপে ধরল। নিরাপত্তা প্রহরীদ্বয় ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল। তাদের নিয়ে আসা হল গেইটের বাইরে অন্ধকার স্থানে। রক্তপাত পরিহার করতে হবে। তাই তাদের না মেরে পিছমোড়া দিয়ে গাছের সাথে বেঁধে রাখা হল। একজন পাকসৈনিক অন্যজন স্থানীয় অবাঙালি রাজাকার। ট্রান্সফরমারের বিস্ফোরক স্থাপন করতে গিয়ে প্রথমত ফয়েজুর রহমানের হাত পুড়ে গেল। একই অবস্থা হলো গরীব উল্লাহর। তারপরও উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক বসানো হল। জাফর উল্লাহ বোরহান ও ডাঃ সাইফুদ্দিন পুরো অপারেশন স্থলের নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। তাঁরা দু’জনে পাকবাহিনীর অস্ত্রগুলো নিয়ে চলে এলেন। অবশ্য পূর্বেই প্রহরীদ্বয়কে নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসা হয়েছে। তারা বার বার মিনতি জানাচ্ছে যে তাদের হত্যা করা না হয়। ধমকের সুরে বলা হয় আওয়াজ করলেই গুলি করে দেব। তাদের মুখ বেঁধে দেয়া হল। তারা মৃত্যুর ভয়ে চুপসে গেল। ইঙ্গিত এল। সবাই একে একে নিরাপত্তা প্রহরীদের নিকট সরে এল। নিরাপত্তা প্রহরীরা বুঝতে পারেনি মুক্তিযোদ্ধারা প্রস্থান করছে। প্রহরীদ্বয় মনে করেছিল মুক্তিরা অস্ত্র হাতে পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অন্ধকারের মধ্যেই তারা সবাই ঈশা খানের বাড়ির ভিতর দিয়ে সকলের চুক্ষুকে ফাঁকি দিয়ে চলে এলেন কমার্স কলেজ রোড পেরিয়ে অন্য এলাকায়। রাত ৯.১২ মিনিট প্রচণ্ড শব্দ করে বিস্ফোরণ হল। অন্ধকার হয়ে গেল হোটেল আগ্রাবাদ। মানুষজন ভয় দৌড়াচ্ছে। হোটেল আগ্রাবাদের ভিতর শুরু হয়েছে চেঁচামিচি। হোটেল কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসেছে স্বদেশী-বিদেশী সবাই। হোটেল চত্বরে অবস্থানকারী পাকসৈনিকরা এদিক-ওদিক ছুটছে আর এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনের সময় দলীয় অধিনয়ায়ক ডাঃ মাহফুজুর রহমান মাথায় টুপি দিয়ে মোগলটুলীস্থ হাসান নামক এক বন্ধুর বাসায় বসেছিলেন। তারা প্রথমে বুঝতে পারেনি কেন মাহফুজ সাবে এসেছেন। বিস্ফোরণের শব্দ হওয়ার পর হাসা ও তাঁর স্ত্রী ব্যাপার বুঝতে পারলেন। আকারে ইঙ্গিতে অপারেশনের সফলতার জন্য ধন্যাব্দ জানালেন। মুক্তিযুদ্ধের স্থানীয় কর্মী আবদুল মতিন। তাকে নভেম্বরের ২৩ তারিখ আলবদর বাহিনী ধরে নিয়ে যায় নির্যাতন ক্যাম্প ডালিম হোটেল। নির্যাতন করেছে অমানবিক পদ্ধতিতে। তাদের অত্যাচার ভোগ করার চেয়ে মৃত্যু শত গুণে শ্রেয়। অবশ্য তিনি অলৌকিকভাবে তাদের নির্যাতন শিবির থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছিলেন। অপারেশন শেষ করে মুক্তিযোদ্ধারা মোগলটুলী বাজারে এসে বিস্ফোরণের আওয়াজ পেলেন। আনন্দে আত্মহারা হয়ে দ্রুত পা ফেলে চলে এলেন পূর্ব মাদারবাড়ি তৎকালীন ছাত্রনেতা মুক্তির সৈনিক আবদুল আহাদ চৌধুরীর বাড়িতে। হোটেল আগ্রাবাদের অপারেশন সবাইকে বিস্মিত করেছে। পাকসরকারের গর্ব চূর্ণ হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে বলে জাতিসংঘ পাকিস্তানের দূত যে প্রচা করছে তা মিথ্যা প্রমাণিত হল। জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক দল মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে নতুন ধারণা নিয়ে ফিরে গেল। পাকসরকারের মিথ্যাচারের সম্বন্ধে তারা সুস্পষ্ট ধারণা পেল। হোটেল আগ্রাবাদ অপারেশনের পরদিন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতারকেন্দ্র থেকে অপারেশনের সংবাদ প্রচার হল। বিবিসি’ও সংবাদ পরিবেশন করেছে। বিশেষ করে এম আর আক্তার মকুল রসালো করে চরমপত্রের মাধ্যমে হোটেল আগ্রাবাদ অপারেশনের বিবরণ দিয়েছেন।
[৬৩৭] সাখাওয়াত হোসেন মজনু

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধ কোষ ষষ্ঠ খণ্ড- মুনতাসির মামুন সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!